ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ঝিনুক থেকে চুন

এস এম জাহিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৪, ২৪ জুন ২০২৫   আপডেট: ১৫:১৩, ২৪ জুন ২০২৫
ঝিনুক থেকে চুন

ঝিনুক, চুন। ছবি: লেখক

‘পান খাইতে চুন লাগে’ গানটি শোনেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া কঠিন। পানের সঙ্গে চুনের যুগলবন্দি যুগ-যুগান্তরের। এই চুন ঘিরে আমাদের দেশের মানুষের জীবন ও যাপনের সংস্কৃতিতে গানতো আছেই, আরও আছে এই অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি।

আমি ছোট বেলায় দেখেছি, কেউ কারও বাড়িতে চুন ধার করতে গেলে চুনকে চুন বলতো না। চুনকে বলতো পান খাওয়ার দই। বা অন্য কিছু। কিন্তু আতিথেয়তায় পানের অনুসঙ্গ হিসেবে চুন দিতেই হতো। পানের পরেই চুনের কদর, এরপরে আসে সুপারির কথা। চুন সাধারণত চার প্রকার হয়— শঙ্খ চুন, ঝিনুক চুন, পাথর চুন, শামুক চুন।

আরো পড়ুন:

ঝিনুকের খোলস। ছবি: লেখক

শঙ্খ এবং ঝিনুকের চুনই সাধারণত পানের সঙ্গে খাওয়া হয়। বাকি যে পাথর চুন বা অন্য  চুন বিভিন্ন কাজের ব্যবহৃত হয়। যেমন বিল্ডিংয়ে চুনকাম করার জন্য পাথর চুন ব্যবহার করা হয়। পুকুরের পানি পরিষ্কার করার জন্য চুন ব্যবহার করা হয়। সেগুলো অনেক সময় শামুক থেকে তৈরি করা হয়।

কারা তৈরি করে: আগে প্রায় প্রতি গ্রামে না হলেও দুই, এক গ্রাম পর পর চুন তৈরির লোকজন পাওয়া যেত। যাদেরকে বলা হতো তাম্বুলী। তখন গ্রাম-গঞ্জের ছোট-বড় জলাশয়ে আগে প্রচুর শামুক ও ঝিনুক পাওয়া যেত। কালক্রমে কৃষিজমিতে অতিরিক্ত সার-কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এবং অতিরিক্ত চুন তৈরির কারণে প্রকৃতি থেকে শামুক এবং ঝিনুক হারিয়ে গেছে। 

বর্তমানে প্রাকৃতিকভাবে আর শামুক ও ঝিনুক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বললেই চলে। তাহলে চুন তৈরি হচ্ছে কীভাবে?—বর্তমানে বিভিন্ন খামারে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তা চাষ হচ্ছে। ঝিনুক থেকে মুক্তা আহরণ করার পরে স্বাভাবিকভাবেই ওই ঝিনুকটা মারা যায়। মৃত ঝিনুকের খোলসটা চুন তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। 
তাম্বুলিরা বিভিন্ন ঝিনুকের খামারিদের কাছ থেকে ঝিনুকের খোলস সংগ্রহ করে থাকে। এগুলোর বেশিরভাগই পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, যশোর অঞ্চলগুলোতে পাওয়া যায়। কম-বেশি ছয়শো টাকা কেজি দরে তারা কেনে। আগে তারা প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করতো। বলা চলে বিনামূল্যে কাঁচামাল পেয়ে যেতো। ঝিনুক ভেঙে মাঝের অংশটা হাঁসকে খাওয়াতো আর  খোলসটা নিয়ে চুন তৈরি করতো।

চুন বানানোর ধাপ: শামুক, ঝিনুকের খোলস সংগ্রহের পরে এগুলো বিশেষ এক ধরণের চুলায় পোড়াতে হয়। তার আগে পরিষ্কার করে নেয়। তারপর চুলায় পুড়িয়ে ছাইয়ের মতো করে ফেলে। তারপরে চালের গুঁড়ার মতো চেলে নেয়। যে অংশটা পোড়ানোর পরেও ছাই হতো না, সেই অংশ বাদ দেয়। 

ঝিনুক যেখানে মন্থন করা হয়। ছবি: লেখক

ছাইয়ের সঙ্গে পানি মিশিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বড় একটা হাতল (বাঁশ বা কাঠের দণ্ড) দিয়ে এটাকে মন্থন করা হয়। ঘুটতে ঘুটতে পানি এবং ঝিঁনুক পোড়া গুঁড়া মিশে মণ্ডের মতো হতো। যতক্ষণ পর্যন্ত সুন্দর মিশ্রণ তৈরি না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাড়া এই নাড়াচাড়াটা করতে থাকে। নাড়াচাড়া করতে করতে একটা সময় চুন তৈরি হয়ে যায়। 

এরপর একটি পাতলা কাপড়ে অনেকটা তালের ক্বাথ থেকে পানি ঝরানোর মতো করে পানি ঝরানো হয়। পানি ঝরে গেলেই এই চুন ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। অনেক সময় তাম্বুলিরা নিজেরাই চুন বিক্রি করে থাকে। আবার অনেক সময় পাইকাররা তাম্বুলিদের কাছ থেকে চুন সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। 

এক তাম্বুলির সঙ্গে লেখক।

মানুষ, পশু ও পাখির রোগ নিরাময়েও চুনের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে ছিলো। মানুষের পেঁট ফাঁপা হলে চুনের পানি খাওয়ানো হতো। চুনের ভেতর পানি দিয়ে রাখা হতো। তারপর যে পানিটা উপরে উঠে আসতো সেই পানিটা খাওয়ানো হতো। বোলতা বা মৌমাছি কামড়ালে আক্রান্ত জায়গার চারপাশে চুন লাগিয়ে দেওয়া হতো, এতে ব্যথা কমে যেত। এবং সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। পশুপাখি আঘাতপ্রাপ্ত হলে ও নির্দিষ্ট জায়গায় হলুদ মিশ্রিত চুন লাগিয়ে দেওয়া হতো। যাতে ব্যথা কমে।

বলা যায়, বাঙালির অবসর- আমোদে, আপ্যায়নে রোগে-নিরোগে চুন ছিল অনেক চেনা ও বহুল ব্যবহৃত এক অনুসঙ্গ।

বর্তমানে প্রযুক্তির সাহায্যে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হচ্ছে চুন। তাম্বুলীরাও চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানার শিবকাঠুরী গ্রামে এখনও তিন ঘর তাম্বুলী চুন তৈরির কাজ করছেন। মিনতী রানি তাম্বুলীর কণ্ঠে আক্ষেপের সুর।  কেননা, এই পেশার উপযোগীতা দিন দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে।  

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়