স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়ার ভূমিকা
নিউজ ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে হাতেগোনা যে কয়েকজন ব্যক্তিত্ব কিংবদন্তির আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, বেগম খালেদা জিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। সাবেক রাষ্ট্রপতির স্ত্রী থেকে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং তিন বার রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন তিনি।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন যেমন বর্ণাঢ্য, তেমনি উত্থান-পতনে ভরা। তাকে তার অনুসারীরা ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। সামরিক শাসনের জাঁতাকল থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তার অসামান্য অবদান, দেশপ্রেমে অবিচল থাকা এবং রাজনৈতিক জীবনে বারবার কঠিন পরিস্থিতির মুখেও আদর্শের প্রতি আপস না করার মানসিকতা—এগুলোই তাকে ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধি এনে দিয়েছে।
গৃহবধূ থেকে রাজনীতির পাদপীঠে
১৯৮১ সালের ৩০ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আকস্মিক হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) যখন নেতৃত্ব সংকটে ভুগছিল, ঠিক তখনই খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আগমন এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্ম দেয়। তিনি অনেকটা বাধ্য হয়েই রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের জন্য দলের হাল ধরেন। গৃহবধূ থেকে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে তার এই উত্তরণ ছিল নাটকীয়।
শুরুতে অনেকেই খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করলেও খুব দ্রুতই তিনি তার সাংগঠনিক দক্ষতা ও দৃঢ়তা প্রমাণ করেন। এই সময়কালটি ছিল সামরিক শাসনের অধীনে। সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে, দলকে সুসংগঠিত করে তিনি দেশব্যাপী এক নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করেন। তার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এ লক্ষ্য অর্জনের পথে তাকে অসংখ্যবার বাধা, ভয়-ভীতি এবং কারাবরণের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই অসম সাহসী ভূমিকাই তাকে জনমনে আপসহীন নেত্রীর ভাবমূর্তি দিতে শুরু করে।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় হলো— ১৯৮০-এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তার নেতৃত্ব দেওয়া। সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসে তিনি যে দৃঢ়তা দেখান, তা দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে তাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে তিনি ছাত্র, যুব, মহিলা, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। একাধিকবার গৃহবন্দি ও কারাবন্দি হওয়া সত্ত্বেও তিনি আন্দোলন চালিয়ে যান। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার আপসহীন অবস্থান ছিল এমন যে, ক্ষমতার প্রলোভন বা ব্যক্তিগত সুবিধা দিয়ে তাকে দ্বিধান্বিত করা সম্ভব হয়নি।
১৯৮৩ সালের বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। একই সময়ে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ হয়। খালেদা জিয়া প্রথমে বিএনপিকে নিয়ে ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেন। একই সময় তার নেতৃত্বে সাত দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন পনেরো দলের সঙ্গে যৌথভাবে আন্দোলনের কর্মসূচির সূত্রপাত করে।
১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফা আন্দোলন চলতে থাকে। কিন্তু, ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে বাধার সৃষ্টি হয়। ১৫ দল ভেঙে ৮ দল ও ৫ দল হয়। ৮ দল নির্বাচনে যায়। এরপর বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল, পাঁচ দলীয় ঐক্যজোট আন্দোলন চালায় এবং নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৮৭ সাল থেকে খালেদা জিয়া ‘এরশাদ হটাও’ শীর্ষক এক দফার আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। এর ফলে এরশাদ সংসদ ভেঙে দেন। তারপর পুনরায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের উপক্রম হয়।
অবশেষে দীর্ঘ আট বছর অবিরাম, নিরলস ও আপোসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিএনপি এবং খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়া মোট পাঁচটি আসনে অংশ নিয়ে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিজয় এবং সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন- সবকিছুই প্রমাণ করে যে, তিনি কেবল সামরিক শাসনের একজন কঠোর সমালোচকই না, বরং গণতন্ত্রের জন্য একজন সফল যোদ্ধা।
ঢাকা/রফিক