খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সাফল্য
বেগম খালেদা জিয়া
১৯৮১ সালের ৩০ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সময় তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন গৃহবধূ। রাজনীতি নিয়ে ভাবনা তো দূরের কথা, কোনো অনুষ্ঠানেও তাকে খুব একটা দেখা যেত না।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। একপর্যায়ে সাত্তারকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থেকে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাত্র কয়েক বছর পর তিনি নিহত হন। বিএনপি তখন সংগঠিত ও জনগণের দল হয়ে উঠতে পারেনি।
জিয়াউর রহমানের অবর্তমানে একদিকে দলীয় কোন্দল, অন্যদিকে দলের অনেক নেতার এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগদান— এই দুই পরিস্থিতিতে বিএনপি তখন অনেকটা ছত্রভঙ্গ, বিপর্যস্ত এবং দিশেহারা।
এমন পরিস্থিতিতে সিনিয়র কিছু নেতার পরামর্শ এবং অনুরোধে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা ও পুনরুজ্জীবিত করার দায়িত্ব নিয়ে রাজনীতিতে আসতে হয় বেগম খালেদা জিয়াকে। দেশের অস্থির সময়ে দলের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কঠিন দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ে। দলকে নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় পড়ে যেতে না দেওয়ার জন্য বিএনপি খালেদা জিয়াকে সামনে নিয়ে আসে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে।
১৯৮২ সালের মার্চে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দমনে নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। প্রধান দলগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, শীর্ষ নেতাদের ওপর নজরদারি ও হয়রানি বাড়ে।
সেই সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে দেশব্যাপী খালেদা জিয়ার ব্যাপক পরিচিতি গড়ে ওঠে। তিনি এই আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে বিএনপিকে গণমানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। এটা খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অর্জন।
১৯৯০ সালের উত্তাল গণআন্দোলনে সব রাজনৈতিক দল, ছাত্রসমাজ এবং সাধারণ জনগণের চাপের মুখে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন। এ আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন খালেদা জিয়া, যা তাকে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে শক্ত অবস্থান এনে দেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খালেদা জিয়ার দৃঢ়তা, আপসহীন অবস্থান এবং আন্দোলনের সময় রাস্তায় নেমে দলের নেতাকর্মীদের উৎসাহিত করা তাকে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক নেত্রী হিসেবে পরিচিত করে তোলে। বিভিন্ন দমন-পীড়ন, গ্রেপ্তার, মামলা ও বাধা সত্ত্বেও তিনি আন্দোলন চালিয়ে যান। এতে তরুণ-ছাত্র এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ আরো বেড়ে যায়।
জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিএনপি জয়লাভ করে। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যে নতুন একটি দলকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত করে ক্ষমতায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব ছিল খালেদা জিয়ার।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির অধীনে একটি বিতর্কিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে খুব অল্প সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঘটনা বাদ দিলে খালেদা জিয়া ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের দুই পূর্ণ মেয়াদে সরকার পরিচালনা করেন।
প্রথমবার যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন দেশ পরিচালনায় তিনি ছিলেন একেবারেই অনভিজ্ঞ। সংসদেও তিনি ছিলেন নতুন। কিন্তু, জীবনের প্রথম নির্বাচনে খালেদা জিয়া পাঁচটি আসন থেকে লড়ে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন।
খালেদা জিয়া রাজনৈতিক জীবনে যতগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তার কোনোটিতেই পরাজিত হননি তিনি। সেই হিসাবে তিনি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘদিন কারাবন্দি ও গুরুতর অসুস্থ থাকলেও তাকে দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
দুই দফায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন, সামরিক শাসনোত্তর গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ সুগম করা, নির্বাচনভিত্তিক ক্ষমতার পালাবদলকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া— এসব অর্জনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন বহুদলীয় রাজনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। নানা বিতর্ক, তীব্র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংকটের মধ্যেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বতন্ত্র অধ্যায় তৈরি করেছে। তার এই রাজনৈতিক অর্জন অনন্য।
খালেদা জিয়া জিয়াউর রহমানকে ঘিরে তৈরি হওয়া আবেগকে সংগঠনের শক্তিতে রূপ দিতে সমর্থ হন। কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ, জেলা–উপজেলায় সভা-সমাবেশ এবং সাংগঠনিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে তিনি দলকে সক্রিয় করেন। তার নিরহংকার জীবনযাপন ও শান্ত স্বভাব কর্মীদের কাছে তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে, যা একটি গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব স্থাপনে বড় ভূমিকা রাখে।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কৌশল ছিল সরল কিন্তু কার্যকর। সাংগঠনিক শক্তি পুনর্গঠন, রাস্তায় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া এবং বৃহত্তর গণতান্ত্রিক শক্তিকে একত্র করতে পারা তার বড় রাজনৈতিক অর্জন। তার দৃঢ়তা, ধৈর্য এবং ব্যক্তিগত সাহস জনগণ ও দলের কাছে তাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
খালেদা জিয়ার পরিচ্ছন্ন ইমেজ, নিরহংকার স্বভাব এবং পরিবারিক পটভূমি তাকে কর্মীদের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য করে। সব কঠিন সময়ে তিনি পিছপা হননি। সংকট যত গভীর হয়েছে, তার অবস্থান তত দৃঢ় হয়েছে। এই দৃঢ়তাই নেতাকর্মীদের আস্থা বাড়িয়েছে।
খালেদা জিয়া ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিএনপির চেয়ারপার্সন হন। বিএনপির নেতৃত্বে চার দশক ধরে থেকে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা এবং দুঃসময়ে দলকে টিকিয়ে রাখার কৃতিত্ব তার। এটা তার বড় রাজনৈতিক অর্জন।
ঢাকা/বকুল/রফিক