বাউল নির্যাতন, ন্যাড়া মাথা ও ধর্মান্ধতা
মাথা মুণ্ডন বা ন্যাড়া করা নিয়ে প্রায় সব ধর্মেই কিছু বিধান আছে। সেই বিধান একসময় পালন করতেই হয়। বিধান কে পালন করলো বা করলো না তা নিয়ে পরিবার বা আত্মীয়স্বজন ছাড়া আর কারো মাথা ব্যথার কারণ নেই। যদিও মাথা সবার থাকে। সেই মাথায় চুলও থাকে।
তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মাথাব্যথা শুধু শফিউল ইসলাম (৫০), মেজবাউল ইসলাম (৫২) ও তারেক রহমান (২০) নামের তিনজন ব্যক্তির। বিস্ময় লাগছে? এরা আবার এলো কোথা থেকে? এরা বগুড়ার শিবগঞ্জ থাকে। এদের মাথায় অনেক দায়িত্ব। দায়িত্বের ভারে তারা কয়েক বাক্স প্যারাসিটামল শেষ করে ফেলেছেন নিশ্চয়ই! তারপরও তাদের মাথাব্যথা কমেনি।
বলছিলাম, শফিউল, মেজবাউল ও তারেক নামের মাথাওয়ালা তিনজনের কথা। এরা দেখতে মানুষ। মগজে-মননে যে মানুষ না সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তারা ১৬ বছর বয়সী মেহেদী হাসানের মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছেন। শাস্তি হিসেবে। কারণ হলো, মেহেদী বাউলগান গায়।
শফিউল, মেজবাউল ও তারেকের কাছে বাউলগান ভালো গান মনে হয়নি। মনে হতেই পারে। কারণ তাদের মনও মাথার মতো ব্যথায় জর্জরিত। এই কারণে এই তিনজন মিলে এই ঘৃণ্য অপকর্ম করেছে। ১৮ আগস্ট, শনিবার রাতে মেহেদী নিজ ঘরে ঘুমিয়ে ছিল। অভিযুক্তরা ডাক দিলে সে দরজা খুলে দেয়। তখন অভিযুক্ত শফিউল বলতে থাকে, ‘ওর মাথার চুল কেটে ন্যাড়া করে বাউল গানের সাধ মিটায়ে দে’। হুকুম পেয়ে অন্য অভিযুক্তরা মেহেদীকে ন্যাড়া করে দেয়।
ভাবুন, আমরা কোন যুগে বসবাস করছি! একটা বাচ্চা ছেলে বাউলগান গায় দেখে এরা তাকে শাস্তি দিলো! এই ঘটনা কোনোভাবেই ছোট ঘটনা না। আপনি বা আমি যদি মনে করি, এটা ছোট ঘটনা তাহলে ভুল ভাবছি।
এ রকম ছোট ছোট ঘটনা বড় ঘটনার জন্ম দেয়। এ রকম ঘটনা মানুষের মনের গোপন বাসনা প্রকাশ করে। অর্থাৎ শফিউল, মেজবাউল ও তারেকসহ বাকিরা মনে করছে বাউলগান খারাপ। কেন খারাপ? সেই ব্যাখ্যা তারা দিতে পারবে না। কখনোই কি পেরেছে? পারেনি। আজ পর্যন্ত যারা বাউলদের উপর শারীরিক আঘাত করেছে তারাও পারেনি। কারণ তাদের কাছে ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যা নেই দেখেই তারা গায়ের শক্তি দিয়ে অন্যকে দমন করতে চায়। এই কারণে লালন বলেছেন, গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায় তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়, লালন বলে জাত কারে কয় এই ভ্রমও তো গেল না।
এই কথার পেছনে যে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আছে তা কেউই বুঝতে চায় না। সবাই বেশ্যাকে গালি দেয়। বেশ্যার ভাত যে খেতে চায়, বেশ্যার ঘরে যে যায়, মনে যে বেশ্যা লালন করে তাকে খোঁজে না। তার নাম জানে না। জানলেও না জানার ভান করে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’ উপন্যাসে ১৮৪০-১৮৭০ সালের বিকাশমান কলকাতা নগরীর আখ্যান পাওয়া যায়। সেখানে জমিদার বাবুদের মনোরঞ্জনের মাধ্যমে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করা এক বাইজির গল্প তুলে ধরা হয়েছে। বাইজির হঠাৎ ইচ্ছে হলো তার ছেলেকে নামিদামী স্কুলে ভর্তি করানোর। বাইজির ছেলে স্কুলে পড়বে- এইটা কেমন না?
স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্যরা শহরের নামিদামী মানুষ। নামিদামী স্কুলের মতোই! বাইজি স্কুলে যেতেই স্কুল কমিটি ছেলের বাবার নাম জানতে চায়। বাইজির সাহস অসীম। ঘাবড়ে না গিয়ে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিদ্রূপের হাসি হাসেন। সত্যিই কি বলবেন ছেলের বাবার নাম কী? বাইজির প্রশ্ন শুনে কমিটির সদস্যরা উল্টো ঘাবড়ে যায়।
এটি গল্প, তবে বাস্তবতা। সমাজের অন্ধকার দিক সবসময় জোটবদ্ধ হয়ে মানুষের বিচার করতে থাকে। কে কী কাপড় পরলো, কে বাউলগান গাইলো? কার বাসায় কে আসে? এ সব নিয়ে অন্ধকার মানুষের মাথাব্যথা। লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, এই শ্রেণির লোকের অভাব নেই। এরা নিজেরা থাকে অসুস্থ। ভাবে সবাই বুঝি অসুস্থ। তাদের অসুস্থতা মাথা থেকে পা পর্যন্ত।
শফিউল, মেজবাউল ও তারেকরা গোটা দেশ ভর্তি। তাদের সমূলে উৎপাটন জরুরি। কিন্তু কেউই করছে না। সবাই প্রশ্রয় দিচ্ছে। এ কারণে তারা কখনো মেহেদী কখনোবা অন্যদের ধরে মাথা মুণ্ডন করে দেয়। গুগলে বাউল লিখে সার্চ দিলে বাউলের তত্ত্ব বা তথ্যের চেয়ে বাউল নির্যাতনের খবর বেশি চোখে পড়ে। কখনো বাউলদের আখড়া গুঁড়িয়ে দেওয়া, কখনো তাদের শারীরিক নির্যাতন করা, কখনো তাদের চুল-দাঁড়ি কেটে দেওয়া, কখনো তাদের আখড়া থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই। অথচ প্রতিকার নেই।
মূলত, অসততা তাদের পেছনে টেনে রাখে। লালন তাই বলেছেন: ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।’ এই মানুষ কোন মানুষ? তা বোঝার মতো জ্ঞান শফিউল, মেজবাউল ও তারেকের নেই। তারা বুঝতেও চায় না। তাদের কাছে ধর্মই মহান। মানুষ নয়। না হলে মেহেদীর মতো একটা বাচ্চার সঙ্গে কেউ এ রকম বর্বর আচরণ করে?
শফিউল, মেজবাউল ও তারেকের মতো মাথাওয়ালা আরেকজন মানুষ বগুড়ায় ছিলেন। তার নাম তুফান সরকার। বগুড়ায় মা-মেয়েকে নির্যাতনের পর মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছিল। তুফান সরকারের শাস্তি এখনো হয়নি। যদিও পুলিশ শফিউল, মেজবাউল ও তারেককে গ্রেপ্তার করেছে। সমস্যা হলো, সংস্কৃতি আর ধর্ম এক নয়। এই বিষয়টা অনেকের কাছেই পরিষ্কার না। তাই তারা ধর্মের সাথে সংস্কৃতিকে মিশিয়ে ফেলে। একজন মানুষ তার মতো জীবনযাপন করতেই পারে। সে বাউল হয়ে যদি আজীবন চলতে পারে তাতে কারো কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। কিন্তু ধর্মান্ধরা মনে করে, তারাই সর্বেসর্বা। তাদের বাইরে আর কিছুই সঠিক নেই।
সব বিষয়ে মাথা ঘামানোর চর্চা যে সঠিক নয় এই জ্ঞান তাদের নেই। এর প্রতিকার জরুরি। তাদের জানাতে হবে তারা সর্বেসর্বা নয়। তাদের চর্চিত জীবনের বাইরেও মানুষের জীবনাচার আছে। এই বিষয়ে আর ছাড় দেওয়া নয়। ছাড় দিলেই ধর্মান্ধরা প্রশ্রয় পাবে। যদি তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা না যায় তাহলে এই ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
শুরু থেকে বাউল নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে আজকে শফিউল, মেজবাউল ও তারেকের মতো ধর্মান্ধ লোকের জন্ম হতো না। শাস্তি দিলে তাদের চিন্তায়ও মেহেদীর মাথা ন্যাড়া করার ভাবনা আসতো না। তাই এখনই সময় তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
ঢাকা/তারা
আরো পড়ুন