ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সামাজিক মূল‌্যবোধের অবক্ষয়ে বাড়ছে কিশোর অপরাধ

মাকসুদুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৫৯, ১৫ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ২২:২৪, ১৫ জানুয়ারি ২০২১
সামাজিক মূল‌্যবোধের অবক্ষয়ে বাড়ছে কিশোর অপরাধ

প্রতীকী ছবি

ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে গত ৮ জানুয়ারি মো. সিফাত (১৪) নামের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত‌্যা করে শুভ নামের আরেক কিশোর। এ ঘটনায় ছয় কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। চলতি বছরে রাজধানীর মহাখালী, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় কিশোরদের মধ‌্যে দ্বন্দ্বের জের ধরে আরও ৫ কিশোর হত‌্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। সামাজিক মূল‌্যবোধের অবক্ষয় দূর করতে না পারলে কিশোর অপরাধ আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে বলে সতর্ক করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

সিফাত হত‌্যা মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানতে পেরেছেন, জন্মের পর থেকেই কামরাঙ্গীরচরে নানার কাছে ছিল সিফাত। ৮ জানুয়ারি সে অন্য বন্ধুদের নিয়ে হালিম খেতে গিয়েছিল। পথে দেখা হয় শুভ ও তার বন্ধুর সঙ্গে। পথচলার সময় শুভর সঙ্গে ধাক্কা লাগে সিফাতের। এর জের ধরে তাদের মধ‌্যে কথা কাটাকাটি হয়। পরে শুভ তার বন্ধুর সহায়তায় সুইস গিয়ার চাকু দিয়ে সিফাতকে এলোপাথারি ছুরিকাঘাত করে।

সিফাতের নানা রহমত আলী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার এতিম নাতিকে বাঁচতে দিলো না ওরা। সিফাতের কী অপরাধ ছিল যে তাকে কুপিয়ে মারতে হবে? আমি এর বিচার চাই।’

কামরাঙ্গীরচরে সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, শুভ এক দুর্ঘটনায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। এ কারণে তার প্রতি স্থানীয়দের সহানুভূতি ছিল। তবে এর অপব‌্যবহার করত সে। এলাকায় সংঘাতে লিপ্ত থাকত শুভ। সুজন, মুন্সী, আকাশসহ ১০-১২ জনকে নিয়ে গ্যাং গড়ে তোলে সে। তারা মাদক সেবন, মাদক বিক্রিসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত।

১ জানুয়ারি ড্যান্ডি (নেশাদ্রব‌্য) খাওয়া নিয়ে বিরোধের জের ধরে মহাখালীতে কিশোর মো. আরিফকে (১৬) কুপিয়ে ও ও ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা করে এক কিশোর গ‌্যাংয়ের সদস‌্যরা।

র‌্যাব-১ এর সহকারী পুলিশ সুপার মুশফিকুর রহমান তুষার জানিয়েছেন, আরিফ হত‌্যাকাণ্ডে প্রধান সন্দেহভাজন টিপুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই হত‌্যাকাণ্ডে কিশোর টিপু, জনি, নুরু ও জোনাকী অংশ নেয়।

২০১৯ সালের ২১ মার্চ উত্তরার বাহরেরটেক এলাকায় হাসান হৃদয় নামের এক কিশোরকে খুন করে কিশোর গ‌্যাংয়ের সদস‌্যরা। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছোটন ও কাশ্মীরী গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। পরে কাশ্মীরী গ্রুপের হৃদয়কে ছুরিকাঘাতে হত‌্যা করা হয়। একইভাবে অন্য কিশোর হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটে।

২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরায় ইংরেজি মাধ‌্যম স্কুলের শিক্ষার্থী আদনান কবির হত্যাকাণ্ডের পর কিশোর গ্যাংয়ের তথ‌্য প্রকাশ্যে আসতে থাকে।

এলাকায় আধিপত্য বিস্তারসহ নানা কারণে কিশোর গ‌্যাং তৈরি হচ্ছে। এসব গ‌্যাংয়ের সদস‌্যরা ইভটিজিং, ছিনতাই, মাদক ব‌্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িত। পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত এসব কিশোরের অনেকে ইংরেজি মাধ‌্যম স্কুলসহ ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। তারা হিরোইজম দেখাতে গিয়ে অনেক সময় গ‌্যাংয়ের সদস‌্য হয়ে যায়।

রাজধানীতে প্রায় ৫০টি কিশোর গ্রুপ আছে। এসবের মধ্য আছে—উত্তরার পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার, নাইন এমএম বয়েজ, এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, কাকরা, ডিএইচবি, ব্ল‌্যাক রোজ, রনো, কে নাইন, ফিফটিন গ্যাং, পোটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আফজাল জিহরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, থ্রিগোল গ্যাং, শাহিন-রিপন গ্যাং ও নাজিমউদ্দিন গ্যাং। তেজগাঁওয়ে মাইনুদ্দিন গ্রুপ। মিরপুর ১১-১২ নম্বর সেকশনে বিহারী রাসেল গ্রুপ, বিচ্চু বাহিনী, পিচ্চি বাবু ও সাইফুলের গ্যাং। সি ব্লকে সাব্বির গ্যাং। বি ব্লকে রাজু-বাবু গ্যাং। চ ব্লকে রিপন গ্যাং। ধ ব্লকে মোবারক গ্যাং। কাফরুলের ইব্রাহিমপুরে নয়ন গ্যাং। তুরাগ থানা এলাকায় তালাচাবি গ্যাং গ্রুপ। ধানমন্ডিতে নাইন এমএম, একে ৪৭ ও ফাইভ স্টার গ্রুপ। রায়েরবাজারে স্টার বন্ড ও মোল্লা রাব্বি গ্রুপ। মোহাম্মদপুরে গ্রুপ টোয়েন্টি ফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল, চিনে ল, কোপাইয়া দে এবং ঝিরঝির গ্রুপ। আটিপাড়ায় শান্ত গ্যাং ও মেহেদি গ্যাং। খ্রিষ্টান পাড়ায় সোলেমান গ্যাং। ট্রান্সমিটার মোড়ে রাসেল গ‌্যাং। হাজারীবাগে বাংলা ও লাভলেট গ্রুপ। বংশালে জুম্মন গ্যাং। মুগদায় চান-যাদু ডেভিট কিং ফুল পার্টি, ভলিউম টু ভাঙ্গরী গ্যাং গ্রুপ। চকবাজারে টিকটক ও পোটলা সিফাত গ্যাং। শ্যামপুরে  ফইন্নি গ্রুপ। রাজধানীর অন্যান‌্য এলাকাতেও এ ধরনের গ‌্যাংয়ের অস্তিত্ব মিলেছে।

এসব গ‌্যাংয়ের সদস‌্যদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের কর্মকর্তারা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, জীবন বোঝার আগে ভয়ঙ্কর পথে পা দেওয়া এসব কিশোর মেয়েদের উত‌্যক্ত করা, অস্ত্র বহন ও কেনাবেচা, মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দেওয়া, মাদক সেবন ও বিক্রি, অপহরণ, মানুষ হত্যাসহ সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।

সম্প্রতি কিশোর গ‌্যাং কালচারকে অশনি সংকেত হিসেবে আখ‌্যায়িত করে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, ‘সন্তান কোথায় যাচ্ছে, তার খবর বাবা-মাকেই রাখতে হবে। অভিভাবকদের কিশোর অপরাধ রোধে এগিয়ে আসতে হবে।’

র‌্যাবের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে ২৯২ জন ও ২০১৯ সালে ২৬৪ জন কিশোরকে আইনের আওতায় আনা হয়। এর মধ্যে ৪০ জনকে অর্থদণ্ড কিংবা মুচলেকা নিয়ে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। একই বছর মাদক সেবন, ছিনতাই, চাঁদাবাজির অভিযোগে ১৪৪ জন কিশোর অপরাধীকে সংশোধানারে পাঠানো হয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, ২০২০ সালে সারা দেশে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী ২৬৪ জন কিশোর নিহত হয়েছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ‌্যম বিভাগের পরিচালক লেফটেন‌্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ রাইজিংবিডিকে বলেছেন, ‘সম্প্রতি আমরা দেখেছি, কিশোর গ্যাং রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে জেলা শহরগুলোতে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম‌্য বেড়েছে। তাদের দৌরাত্ম‌্য রোধে র‌্যাব বিশেষভাবে কাজ করছে। যেসব কিশোর ফৌজদারি অপরাধে সংশ্লিষ্ট তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনেককেই সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে।’

অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। এসব অপরাধ রোধে দরকার সামাজিক আন্দোলন।

ঢাকা/মাকসুদ/রফিক

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়