ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ভোজ‌্য তেলে তেলেসমাতি, থামাবে কে

মেসবাহ য়াযাদ ও রেজাউল করিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৩, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১  
ভোজ‌্য তেলে তেলেসমাতি, থামাবে কে

দেশে ভোজ‌্য তেলের বাজারে আগুন। লাফিয়ে-লাফিয়ে বাড়ছে নিত‌্যপ্রয়োজনীয় পণ‌্য সয়াবিন তেলের দাম। নিম্ন-মধ্যবিত্তের পাশাপাশি এখন মধ্যবিত্তদেরও নাভিশ্বাস অবস্থা। সরকারিভাবে ভোজ‌্য তেলের দাম নির্ধারণ করে দিলেও কেউ তা মানছে না।  রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল, নিউমার্কেট ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে সরেজমিনে ঘুরে এমন তথ‌্য পাওয়া গেছে। 

রাজধানীর হাতিরপুল খুচরা বাজারে দেখা গেছে—কোম্পানি ভেদে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। ২ লিটার ২৫৮ থেকে ২৭২ টাকা। ৫ লিটার ৬২৫ থেকে ৬৮০ টাকা। অথচ এক সপ্তাহ আগে এই তেলের দাম ছিল ১ লিটার ১২০ থেকে ১২৫ টাকা, ২ লিটার ২৪০ থেকে ২৬০ টাকা এবং ৫ লিটার ৫৯০ থেকে ৬২০ টাকা।

নিউমার্কেটে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১২৮ থেকে ১৪০ টাকা করে। ২ লিটারের দাম ২৬০ থেকে ২৭৪ টাকা এবং ৫ লিটারের দাম ৬২০ থেকে ৬৮০ টাকা করে।

সবচেয়ে বেশি ‘তুঘলকী’ অবস্থা চলছে কারওয়ান বাজারে। এই বাজারের কিচেন মার্কেটের দোতলায় কোম্পানি-ভেদে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, ২ লিটার ২৪০ থেকে ২৫৫ টাকা। ৫ লিটার ৫৯০ থেকে ৬১০ টাকায়। খোলা বিক্রি হচ্ছে লিটার ১১৫ টাকায়। গত সপ্তাহে যা ছিল ৯৫ থেকে ১০০ টাকা।

আর নিচতলায় খুচরা বাজার। সেখানে বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা থেকে ৫০টাকা পর্যন্ত বেশি দামে। এই বিষয়ে ভোজ্য তেলের পাইকারি ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন বলে, ‘কোম্পানি থেকে যেই দামে তেল কিনেছি, তার চেয়ে সামান্য বেশি দামে বিক্রি করছি। অথচ খুচরা ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি দামে ভোক্তাদের কাছে তা বিক্রি করছেন।’
সব তেল কোম্পানি এক জোট হয়ে প্রায়ই বিভিন্ন অজুহাতে তেলের মূল্য বাড়িয়ে বাজার অস্থিতিশীল করে তোলে এবং কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন আরেকজন প্রবীণ ব্যবসায়ী আবুল কাশেম।

বেশি দামে ভোক্তাদের কাছে তেল বিক্রির জন্য পাইকারি ব্যবসায়ীরা খুচরা দোকানিদের দায়ী করেন। কিন্তু খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা গত বৃহস্পতিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) থেকে সরকারের নির্ধারিত মূল্যেই (১ লিটার ১৩৫ টাকা, ২ লিটার ২৭০ টাকা ও ৫ লিটার ৬৩০ টাকা) বিক্রি করছেন।

নিউ মার্কেটের পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হোসেন স্টোরে বেশ কয়েক বছর থেকে নিয়মিত কেনাকাটা করছেন ব্যাংকার ফখরুল আবেদীন। তেলের দামের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কয়েক দিনের ব্যবধানে প্রতি লিটার সয়াবিনে ২০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। আগে একসঙ্গে ৫ লিটার তেল কিনতাম, এখন ২ লিটার করে কিনছি। তেল না খেয়ে তো থাকতে পারবো না। যখন-তখন এই দাম বাড়ার বিষয়টা দেখার কেউ নেই?’

এদিকে, হোসেন স্টোরের সেলসম্যান আরিফ বলেন, ‘তেল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন অজুহাতে প্রায় প্রতি মাসেই দাম বাড়াচ্ছে। তবে, এই সপ্তাহে অনেক বাড়িয়েছে। মাঝে মাঝে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েও বাজারে সংকট তৈরি করে। দাম বাড়িয়ে দেয়। তারা বেশি লাভ করার জন্যই দাম বাড়ায়। আমরা কী করবো? বেশি দামে কিনি, বেশি দামে বিক্রি করি। কম দামে কিনলে কম দামেই বিক্রি করি।’

সয়াবিন তেলের দাম আবারও বেড়ে যাওয়া সম্পর্কে মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন বলেন, ‘তেল মালিকরা যদি কম দামে তেল বাজারে না ছাড়েন, তাহলে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কিছু করার নেই। বেশি দামে কিনলে বেশি দামেই বিক্রি করতে হবে। এজন্য ভোগান্তি হয় সাধারণ জনগণের। এই দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’

রাজধানীর বাজারগুলোর মতো বাণিজ‌্য নগরী চট্টগ্রামেও নিয়ন্ত্রণহীন ভোজ্য তেলের বাজারও। নগরীর কর্ণফুলী বাজারে দেখা গেছে, সবচেয়ে নিম্নমানের সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১২৮ টাকা থেকে ১৩০ টাকা লিটার। ভালো ব্র্যান্ডের ৫ লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৬৮০ টাকা থেকে ৭০০ টাকায়। 

খাতুনগঞ্জের তেলের আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও প্রতিদিনই পাইকারিতে দাম বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে খুচরা বাজারে। গত দুই দিনে পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে ভোজ্যতেলের দাম প্রতিমণে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। 

খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘তেলের দাম এখন অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সারাদেশের তেলের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়াসহ আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে এই অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।  সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি লিটারে ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

খাতুনগঞ্জে ভোজ্যতেলের পাইকারি ব্যবসায়ীরা রাইজিংবিডিকে জানিয়েছেন এক সপ্তাহে প্রতি মণ ভোজ্য তেলে ৩০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। সরকার মিল গেইটে ১০৭ টাকা দাম নির্ধারণ করে দিলেও সেখানে তেলের দাম পড়ছে ১১০ টাকা থেকে ১১৩ টাকা। যা খুচরা পর্যাযে যেতে যেতে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা হয়ে যায়।

গত সপ্তাহে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে প্রতিমণ সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৩০০ টাকা। অথচ চলতি সপ্তাহে এই দাম মিলগেটে প্রতিমণ (৪০ দশমিক ৯০ লিটার) ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

খাতুনগঞ্জের বৃহৎ ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী মের্সাস আর এম স্টোরের মালিক মোহাম্মদ আলমগীর জানান, সরকারি ভোজ্য তেলের দাম নির্ধারণ করে দিলেও এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এখনো তেলের দামের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে।

নগরীর বহদ্দারহাট বাজারে সয়াবিন তেল কিনতে আসা গৃহিণী মনোয়ারা সুলতানা বলেন, ‘১৫ দিন আগে যে সয়াবিন তেল লিটার ১১৫ টাকায় কিনেছি, এখন তা ১৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তেলের বাজারে যেভাবে অস্থিরতা চলছে, তা সাধারণ মানুষের সামর্থ‌্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। 

সরকার দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও বেশি দামে ভোজ্যতেল বিক্রি প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘কোনো পণ্যের মূল্য সরকার নির্ধারণ করে দেওয়ার পর সেই পণ্য তার বেশি দামে বিক্রি করার কোনো সুযোগ নেই। দাম নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিকারের অভিযান চলছে।’

এক মাসের মধ্যে দুই বার ভোজ্য তেলের অস্বাভাবিক দাম বেড়ে যাওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আবদুল জব্বার মণ্ডল বলেন, ‘বাজারে ভোজ্য তেলসহ সব পণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশে রাজধানীসহ সারাদেশে তদারকি অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া বাজারে পণ্যের দাম বাড়ানো নিয়ে আমাদের আসলে কিছু করার নেই।’

কয়েকদিন পর পর প্রায় সব কোম্পানির ভোজ্য তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার চিত্র পাওয়া গেছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর দৈনিক পণ্যমূল্য তালিকায়ও। টিসিবির হিসাবে, গত এক মাসে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ।

তেলের দাম নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে টিসিবির করণীয় সম্পর্কে জানতে চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে চেয়ারম্যানের দপ্তর থেকে তার ব্যক্তিগত সহকারী হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী বিশ্ববাজার থেকে পর্যাপ্ত ক্রুডওয়েল পাওয়া যাচ্ছে না। আর পাওয়া গেলেও তার দাম অনেক বেশি। প্রতিটন বর্তমানে সাড়ে চারশো ডলার বেশি দাম দিয়ে আমদানি করতে হচ্ছে। এই কারণ দেখিয়ে কোম্পানিগুলো তাদের তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।’

এই অবস্থায় টিসিবির চলমান কর্মকাণ্ড সম্পর্কে হুমায়ূন কবির বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের ভ্যাট দিতে হয় না, তাই আমরা বিভিন্ন কোম্পানি থেকে তেল কিনে বাজারের চেয়ে অনেক কম দামে, ট্রাকে করে খোলা বাজারে বিক্রি করছি।’

কয়েকদিন পর পর ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের ওপর এর বিরাট প্রভাব পড়ে বলে জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো ভোজ্য তেলের দাম বাড়িয়ে দেন। এজন্য সরকারিভাবে গত বৃহস্পতিবার থেকে সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ১ লিটার ১৩৫ টাকা, ২ লিটার ২৭০টাকা আর ৫ লিটার ৬৩০ টাকা।’ সরকারের পক্ষ থেকে নিবিড়ভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

মেসবাহ/রেজাউল/এনই

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়