ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

আর্কিমিডিসের নাম বিভ্রাট এবং তার আবিষ্কার

অহ নওরোজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৬, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আর্কিমিডিসের নাম বিভ্রাট এবং তার আবিষ্কার

অহ নওরোজ : কে না চেনে পৃথিবীখ্যাত বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসকে? যারা স্কুলে অন্তত একবার গিয়েছে তারা সবাইই চেনেন এই বিজ্ঞানীকে। কিন্তু আর্কিমিডিস নামে যে বিজ্ঞানীকে আমরা চিনি তার প্রকৃত নাম কি আর্কিমিডিস ছিল?

আসলে আর্কিমিডিসের নাম নিয়ে এই বিভ্রান্ত্রি ছড়িয়েছে মূলত একটি গল্পকে কেন্দ্র করে। আর্কিমিডিস ২৮৭ সালে সিসিলি শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবার জন্মগ্রহণ করে। তার পিতা ফিডিয়াস ছিলেন সে যুগের অন্যতম প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ। শৈশব থেকেই তাই এক বড়সড় পরিবারে বেড়ে উঠেছেন আর্কিমিডিস। ছোটবেলা থেকেই জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করার অভ্যাসটা শুরু হয়েছিল পরিবার থেকেই থেকেই। যে কারণে গল্পটি বিশ্বাসযোগ্যও মনে হয়।

গল্পটি এরকম- আর্কিমিডিস যেহেতু জন্মেছিলেন একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে সেহেতু তার বাড়িতে দাসদাসীর অভাব ছিল না। আর্কিমিডিস যখন কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছেন সে সময়ে গবেষণার মধ্যে ঝুঁকে পড়েন। এ সময় প্রায়ই বাড়ির একটি রুমে একাকী গবেষণায় নিয়জিত থাকতেন, যে কারণে স্ত্রীকেও সময় দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় তার ছিল না। ফলে স্ত্রীর জন্য বেশকিছু দাসদাসী নিয়োগ করতে হয়েছিল। এই দাসদাসী প্রায়ই যখন উচ্চস্বরে হাসাহাসি করতো, আর্কিমিডিসের জন্য অসুবিধা হতো। তার চিন্তায় মাঝে মাঝে ছেদ পড়তো। যে কারণে প্রায়ই তিনি ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে চিৎকার করে বলতেন ‘হার্ক-ই-মেইডস’(Hark Ye maids)। গ্রিসের প্রাচীন ডোরিক উপভাষায় এর অর্থ হল ‘চুপ করো, নইলে বের করে দেবো’। আর্কিমিডিসের চিৎকারে তারা কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও পরবর্তীতে আবার হাসাহাসি করতো যে কারণে প্রায়ই আর্কিমিডিস ‘হার্ক-ই-মেইডস’ বলে চিৎকার করতে। এই চিৎকারের কারণে দাস-দাসীরা তাকে দেখলেই ফিসফিস করে বলতো, ‘চুপ ‘হার্ক-ই-মেইডস’ আসছেন।

এই ঘটনা থেকেই নাকি ধীরে ধীরে ‘হার্ক-ই-মেইডস’ আর্কিমিডিসে রুপান্তিত হন। অনেকেই আর্কিমিডিসের নামের সঙ্গে এই ঘটনার যৌক্তিকতা বিশ্বাসও করেন। তবে আর্কিমিডিসের আসল নাম কি ছিল বা না ছিল তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তার আবিষ্কার।

আর্কিমিডিসের অধিকাংশ গবেষণা-ই সুসম্পন্ন হয়েছিল প্রাচীন গ্রিসের সাইরাকিউজে বসে। আর্কিমিডিস সর্বকালের সেরা গণিতবিদদের একজন হলেও বলবিদ্যা, পদার্থ, জ্যোতির্বিদ্যাতেও তার অনেক বড় বড় অবদান রয়েছে। বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখাতেই তার কিছু না কিছু আবিষ্কার আছেই। এই পর্যন্ত আর্কিমিডিসের লেখা বারোটি বইয়ের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। বাংলায় এগুলোর নাম এমন- ‘গোলক ও বেলন’, ‘সমতলে ভারসাম্য’, ‘বৃত্তের পরিমাপ’, ‘শঙ্কু সাদৃশ্য ও গোলক সাদৃশ্য’, ‘সর্পিল বস্তু সমূহ’, ‘ভাসমান বস্তু’, ‘অধিবৃত্তের পদসংস্থান’, ‘বালুকা গণনা’, ‘স্টমাকিয়ন’, ‘পদ্ধতি’, ‘লেখা সংক্রান্ত’ এবং ‘গরু সমস্যা বা ক্যাটেল প্রবলেম’। আর্কিমিডিস এই বইগুলো লিখেছিলেন গ্রিসের ডোরিক উপভাষায়। পরবর্তীতে এগুলো বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়।

বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে জ্যামিতিতে আর্কিমিডিসের সবচেয়ে বেশি উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। তিনি তার লেখা প্রতিটি বইয়েই জ্যামিতির কোনো না কোনো সমস্যা উল্লেখ করেছেন। জামিতি সংক্রান্ত তার সকল আবিষ্কার ছিল মৌলিক। এছাড়া গবেষণার প্রতি যার জিদও ছিল অত্যাধিক। একবার সারাকিউজের রাজা হিরোন স্বর্ণকারকে দিয়ে একটি মুকুট তৈরি করেছিলেন, এটি দেখতে অতি সুন্দর হয়েছিল। কিন্তু রাজার কাছের ব্যক্তিরা বলছিলেন এতে নাকি খাঁদ মেশানো হয়েছে। রাজা পড়লেন বিপাকে। এদিকে মুকুটটি সুন্দর হওয়ায় তিনি এটি ভাঙতেও চান না, যে কারণে তিনি আর্কিমিডিসকে দায়িত্ব দিলেন না ভেঙে এতে খাঁদ আছে কিনা সেটা প্রমাণ করতে। এরপর থেকে আর্কিমিডিস সবকিছু ভুলে লেগে যান গবেষণায়। শোনা যায়, স্নানরত অবস্থায় তিনি এটি প্রমাণের সূত্র আবিষ্কার করেন। তরল ও কঠিন বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় উদস্থিতিবিদ্যায় এটি ছিল তার যুগান্তকারী আবিষ্কার। সূত্রটি ছিল এমন- ‘তরল পদার্থে কোনো কঠিন বস্তু আংশিক বা সম্পূর্ণ নিমজ্জিত করলে সেই বস্তু কিছুটা ওজন হারায়, এই হারানো ওজন বস্তুটি দ্বারা অপসারিত তরলের ওজনের সমান।’ এটি আর্কিমিডিসের সূত্র নামে পরিচিত।

বিভিন্নি জ্যামিতিক আকৃতির বস্তুগুলো তরল পদার্থে কিভাবে ভাসমান থাকবে সে সম্পর্কে তিনি তার দুখণ্ডে লেখা ‘ভাসমান বস্তু’ বা ‘অন ফ্লোটিং বডিস’ বইয়ে প্রমাণসহ বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। ভাসমান বস্তু সম্পর্কে ১৯টি প্রতিজ্ঞা তিনি এই বইয়ে যুক্ত করেছেন, যা তরল বস্তু সম্পর্কিত কোনো আবিষ্কারে এক বিশাল সহায়ক।

বৃত্তের ক্ষেত্র, গোলকের উপরিভাগের ক্ষেত্র এবং আয়তন নির্ণয়ের জন্য পাই (π) এর মানের প্রয়োজন হয়। নিঃশেষীকরণ পদ্ধতির (Method of Exhaustion) সাহায্যে আর্কিমিডিস তার ‘বৃত্তের পরিমাপ’ বইতে পাই (π) এর মান ও বৃত্তের ক্ষেত্র ও গোলকের আয়তনের সঙ্গে পাই ও ব্যাসার্ধের সম্পর্ক আবিষ্কার করেন এবং এর মান সম্পর্কে মতামত দেন। যা পরবর্তীকালের গণিতবিদদের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে এবং পাই এর মান সম্পর্কে গণিতবিদগণ একটি মতামতে পৌঁছান। অনেক গণিতবিদ মনে করে এই ব্যাখ্যার মধ্য দিয়েই গণিতের আরেকটি শাখা ‘ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস বা সমাকলন-আবিষ্কারের ধারণা পেয়েছিলেন গণিতবিদ লিবনিজ।

আর্কিমিডিসের যে বারোটি বইয়ের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে সর্ববৃহৎ হল ‘গোলক ও বেলন’ (On sphere and Cylinder)। বইটি দুইখণ্ডে বিভক্ত, এই বইতেই তিনি সর্বপ্রথম দেখান কোনো গোলকের গুরু বৃত্তের ব্যাসার্ধ যদি পাই একক হয় তবে গোলকের উপরিতলের ক্ষেত্রফল হবে ফর পাই আর স্কয়ার (4πr2)। এছাড়া সর্পিল বস্তু, অধিবৃত্ত, ত্রিভুজ প্রভৃতি বিষয়ে তিনি যেসব সূত্র আবিষ্কার করেছেন তা পরবর্তীতে গণিতকে দেখিয়েছে এক নতুন পথ।

এছাড়া পদার্থবিদ্যাতেও তার বেশ অবদান আছে। তিনি প্রথম হাইড্রোলিক স্ক্রু আবিষ্কার করেন। এছাড়া তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন ‘কপিকল’। কপিকল আবিষ্কারের কাহিনিটাও একটু অন্যরকম- একবার দ্রব্যসামগ্রীর বিশাল জাহাজকে বহু মানুষমিলে ডাঙা থেকে জলে ভাসাতে হিমশিম খাচ্ছে সে সময় আর্কিমিডিস কপিকল আবিষ্কার করে মিশ্র পুলির সাহায্যে কয়েকজনের সাহায্য নিয়ে জাহাজটিকে জলে ভাসিয়ে দেন। এই দেখে সেদিন সাইরাকিউজের রাজা ঘোষণা করেন, ‘আর্কিমিডিস যা বলবে দেশে সেভাবেই সবকিছু চলবে।’

কিন্তু রাজার সন্মানে নিজেকে বড় ভেবে বিলাসিতায় জীবন কাটিয়ে দেননি আর্কিমিডিস। দীর্ঘ দীর্ঘ গবেষণার পর আবিষ্কার করে করতে থাকেন নতুন নতুন সূত্র। যা পরবর্তীতে আধুনিক গণিতের নতুন রাস্তার সূচনা ঘটায়। তার নাম আর্কিমিডিস যেভাবেই হোক না কেন নিজের দক্ষতা, বুদ্ধি আবিষ্কার দিয়ে জায়গা করে নিয়েছে মহাকালে। সর্বকালের মানুষ তাকে স্মরণ করতে বাধ্য।

তথ্য সহায়তা : বিজ্ঞানের ইতিহাস, সমরেন্দ্র নাথ সেন; সংখ্যা এলো কেমন করে, কমল বিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়; আর্কিমিডিস, বিবিসি হিস্টোরি; রিট্রিভড ২০১২-০৬-০৭, উইকিপিডিয়া।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়