ঢাকা     বুধবার   ০৮ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৫ ১৪৩১

মাশরাফির আয়নায় বিশ্বকাপ

ইয়াসিন হাসান,ধর্মশালা থেকে: || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৮, ৮ অক্টোবর ২০২৩   আপডেট: ১৩:৪৬, ৮ অক্টোবর ২০২৩
মাশরাফির আয়নায় বিশ্বকাপ

তামিম ইকবাল মন থেকে তাকে নেতার চেয়েও বেশি কিছু মানেন! তার কথায় শুরুর দিকে কেবল বিশ্বাস ছিল, সেই বিশ্বাস পরবর্তীতে এমন রূপ নেয় যে, তামিম বলতে দ্বিধা করেননি, ‘উনি কেন যেন আমাকে নিয়ে যা বলতেন তাই হতো...আমাকে মাঠে নামার আগে কি মনে যেন বলেছিলেন, আজকে সেঞ্চুরি পাবি। টিকে থেকে রান করিস। হয়ে যাবে।’ 

২০১৫ বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে মাঠে নামার আগে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা ওপেনার তামিমকে সেঞ্চুরির ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিলেন। অসামান্য তামিম প্রথম ওয়ানডেতে ১৩২ রানের পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় ম্যাচে করেন যথাক্রমে ১১৬ ও ৬৪। জিম্বাবুয়ে বাদে যে কোনো বড় দলের বিপক্ষে তামিমের ৩১২ রান এখনও তিন ম্যাচের দ্বিপক্ষীয় সিরিজে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ। 

ওই সিরিজের পর তামিম বুঝে যান, মাশরাফির ভেতরে ভবিষ্যদ্বাণীর অনন্যগুণ রয়েছে। তামিমের ক্ষেত্রেও আরেকবার এমনটা ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর তাকে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরেকটি তিন অঙ্কের দেখা পেতে। যা আগেভাগে বলে দিয়েছিলেন সেই মাশরাফি। 

সেই মাশরাফি ২০২০ সালে ম্যাচ গড়াপেটার প্রস্তাব গোপন রাখার অভিযোগে সাকিব আল হাসান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষিদ্ধ হওয়ার পর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, ‘দীর্ঘ ১৩ বছরের সহযোদ্ধার আজকের ঘটনায় নিশ্চিতভাবেই কিছু বিনিদ্র রাত কাটবে আমার। তবে কিছুদিন পর এটা ভেবেও শান্তিতে ঘুমাতে পারব যে, তার নেতৃত্বেই ২০২৩ সালে আমরা বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলব। কারণ নামটি তো সাকিব আল হাসান...!!!’ 

অদ্ভুত হলেও সত্য, ওয়ানডে বিশ্বকাপের ৬৩ দিন আগে নিয়মিত অধিনায়ক তামিম নাটকীয়ভাবে দায়িত্ব থেকে সরে যান এবং ৮ দিন পর নেতৃত্বের ভার ওঠে সাকিবের কাঁধে। তিন বছর আগে মাশরাফির সেই ভবিষ্যদ্বাণী আবার চলে আসে সামনে। ভক্তদের হৃদয়েও দোলা দেয় উন্মাদনা! কেবল হৃদয় বলছিল বলেই এমন বিশ্বাস ছিল না মাশরাফির। সাকিবের প্রতি তার বিশ্বাসের কারণ এটা, ‘সাকিব সে তো পরীক্ষিত। আমি মনে করি সাকিব নিজের সেরা সময়ে আছে। সে জানে তার কাজটা কি, দলের চাওয়া কি। সাকিবের নেতৃত্বে এই বিশ্বকাপে আলো ছড়াবে বাংলাদেশ।’

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভালো খেলা মানেই তিন জয়। যার শুরুটা হয়েছিল মাশরাফি, সাকিব, তামিমদের দিয়ে ২০০৭ সাল থেকে। ভারত, বারমুডার পর বাংলাদেশ হারায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এরপর ২০১১ ও ২০১৫ এবং সবশেষ ২০১৯ বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ মাশরাফির নেতৃত্বে তিন জয় পেয়েছিল। এবার সেই তিনের গেরো ছুটানোর পালা। তা মোটেও অসম্ভব নয় বলছেন ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের বাক বদলের অধিনায়ক। বরং সাবেক অধিনায়কের প্রত্যাশার পারদ অনেক উচুঁতে, ‘বিশ্বকাপে আমরা তিনটার বেশি ম্যাচ কখনো জিতিনি। আমাদের এখন বিশ্বকাপ জেতার সময়। আর এই স্বপ্ন দেখাটা অমূলক নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে আশা করছি দল কমপক্ষে সেমিফাইনাল খেলবে।’

এবারের বিশ্বকাপ হচ্ছে সবশেষ আসরের মতো। অংশগ্রহণকারী দশ দল প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে খেলবে। যেমনটা এর আগে হয়েছিল ’৯২ বিশ্বকাপে। গ্রুপপর্বের ভিত্তিতে খেলা হলে দেখা যেত একটা কিংবা দুইটা ম্যাচ জিতলে পয়েন্টের মারপ্যাচে নকআউট পর্যন্ত যাওয়া যায়। কিন্তু এখানে রাউন্ড রবিন লিগ অনুযায়ী খেলা হওয়ায় টুর্নামেন্ট হতে যাচ্ছে বেশ লম্বা। সঙ্গে এই শহর থেকে ওই শহরে ভ্রমণের ঝক্কি তো আছেই। তবে লম্বা এই প্রতিযোগিতারও সুবিধা দেখেন মাশরাফি, ‘ফরম্যাট তো সবার জন্যই এক। এই ফরম্যাটে সুবিধা হলো, একটা খারাপ ম্যাচ গেলেও ফিরে আসার সুযোগ থাকবে। ভারত স্বাগতিক দল হিসেবে খানিকটা সুবিধা পাবে। এছাড়া সব দলই সমান।’ 

লম্বা সফরের টোটকাও দিয়ে দিলেন সাবেক অধিনায়ক, ‘একে-ওকে হারাবো এসব চিন্তা করে বিশ্বকাপে যাওয়া ঠিক হবে না। পরিকল্পনাও করা যাবে না। নির্দিষ্ট কোন দলকে টার্গেট করাও ভুল হবে। আমি মনে করি নয়টা ম্যাচ খেলতে হবে, নয়টা ম্যাচ নিয়েই আমাদের আলাদা আলাদা পরিকল্পনা থাকতে হবে। ওয়ান ম্যাচ অ্যাট এ টাইম।’

ঠিক বিশ্বকাপের আগে ঝড় বয়ে যায় বাংলাদেশ ক্রিকেটে। তামিম ইকবালের আচমকা অবসর। এরপর ফিরে আসা। চিকিৎসা করিয়ে দেশে ফিরে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেয়া। সাকিবের পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব পাওয়া। প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ে এলোমেলো হয়ে যাওয়া সব কিছুর সাক্ষী ছিলেন মাশরাফি। তবে এই দলের ওপর তার যে ভরসা তাতে বিশ্বাস করেন, ‘মাঠের বাইরের কোনো ইস্যুতে আমার মনে হয় না ভেতরে সমস্যা হবে। দলের প্রত্যেকে যথেষ্ট পেশাদার। খেলায় মনোযোগ দিলে এসব পাশ কাটিয়ে যাবে।’  

মাশরাফি শুরুতে সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন ও বিশ্বকাপ জেতার সময় চলে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন তার ভিত্তি এই দলের ক্রিকেটার ও ম্যাচ উইনারের কারণেই। আগে কেবল দুয়েকজন ছিলেন ম্যাচ উইনার। এখন নিজেদের দিনে যে কেউ পার্থক্য গড়ে দিচ্ছেন। পারফরম্যান্স গড়পড়তার চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। চোখে চোখ রেখে, বুক ভরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রতিপক্ষের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছেন ক্রিকেটাররা। যা সাফল্যের বড় পরিমাপক বলেই বিশ্বাস করেন মাশরাফি।  

‘দারুণ একটি বোলিং আক্রমণ হয়েছে আমাদের। তাসকিন, মোস্তাফিজ, শরিফুল, হাসান-সবাই ভালো করছে। ইবাদত থাকতে পারলে খুব খুশি হতাম। বোলিং বিভাগ এই দলকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। ভারতের উইকেট ব্যাটিং বান্ধব। ব্যাটিংটাও ক্যালকুলেটিভ করতে হবে। দুই দিকে সমানতালে ভালো খেললে এই দলের পক্ষে অসম্ভব নয় কিছুই। আপনি ম্যাচ জিতবেনই।’

দেশের জার্সি গায়ে জড়িয়ে টিভির পর্দার সামনে প্রিয় দলের খেলা দেখবেন মাশরাফি। চিয়ার্স করবেন সতীর্থদের জন্য। উড়াবেন পতাকা। নিয়মিত পারফর্মারদের থেকে তার অনেক প্রত্যাশা। তবে বিশেষ নজর রাখবেন তিনজনের দিকে, ‘একজন দর্শক হিসেবে আমি চাইবো ঘুরে ফিরে সবাই পারফর্ম করে দলকে ভালো জায়গায় নিয়ে যাক। তাসকিন, লিটন, শান্ত আলো কেড়ে নিক; এটা খুব চাইব। ওরা শেষ কয়েক বছর ধারাবাহিক পারফর্মার। এরকম বড় মঞ্চে এখনই সময় ওদের প্রবলভাবে মেলে ধরার।’

উপসংহারে মাশরাফি একটি কথা মনে করিয়ে দিলেন, ‘বিশ্বকাপ জিততে হলে কেবল ভালো খেললেই হয় না। জটিল ও কঠিন মুহুর্তগুলোতে ভাগ্যের সহায়তারও প্রয়োজন হয়।’

ধর্মশালা/ইয়াসিন/বিজয়

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়