‘আগেভাগেই বিচার করে ফেলেছিল, আমাকে দিয়ে হবে না’
‘সোজা ব্যাটে খেলতে খেলতে ১০ হাজার রান করে ফেললি’ - বিসিবির পরিচালক ও ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যান নাজমুল আবেদীন ফাহিম ফোনে এভাবে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মার্শাল আইয়ুবকে। বাংলাদেশের চতুর্থ ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০ হাজার রান পেরিয়েছেন মার্শাল।
জাতীয় দলের হয়ে কেবল ৩টি টেস্ট খেলেছেন। এরপর হুট করে বাদ দিয়ে দেওয়া। পছন্দের পজিশনে না খেলিয়ে অনভ্যস্ত জায়গায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার খেসারত তাকে দিতে হয়েছে। অথচ তাকে মনেই করা হয়েছিল, লম্বা রেসের ঘোড়া। বাদ পড়ার পর তার দিকে ফিরেও তাকায়নি সংশ্লিষ্টরা!
কিন্তু নিজের রান ক্ষুধা কমাননি মার্শাল। ২২ গজে মন খুলে খেলেছেন, নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছেন বছরের পর বছর। একই নিবেদন, তাড়নায় নিত্যদিন একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছেন।
কেমন ছিল তার পুরো সফর, বর্তমানে ক্যারিয়ার নিয়ে কী ভাবছেন, মাঝে কী হয়েছিল সব কিছু নিয়ে রাইজিংবিডি-র সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলেছেন মার্শাল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইয়াসিন হাসান,
১০ হাজার রানের অর্জনকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মার্শাল আইয়ুব: অনেক দিনের ক্যারিয়ার। ১৬-১৭ বছরের (আসলে ২০) ন্যাশনাল লিগ। এর মধ্যে অনেক কিছু উঠা-নামা করেছে। প্রথমে এত কিছু চিন্তা করে খেলিনি। তখন একটাই মাথার মধ্যে ছিল যে, ন্যাশনাল লিগে খেলা, কিভাবে ভালো করে খেলা যায়। আস্তে আস্তে যখন একটু ম্যাচিউর হলাম: আমি, শুভ তখন আমরা চিন্তা করতাম যে, ৫-৬ হাজার রান হয়েছে আমাদের। অন্তত ১০ হাজার রান করা উচিত। আমরা ঐরকম স্কিলফুল খেলোয়াড় ছিলাম। তখন বলতাম যে, চাইলে পারা যাবে, একটু কষ্ট করতে হবে আর-কি। এখন আসলে ভালোই লাগছে, অর্জন করার পরে।
আপনার কীর্তি দিনে পরিবার আপনার সাথেই ছিল। তারা কতটা খুশি?
মার্শাল আইয়ুব: বাচ্চারা আসলে ছোট। ওরা এখানে আসবে তেমন পরিকল্পনা ছিল না। এই মৌসুম শুরুর আগে দরকার ছিল তিনশ-চারশ রানের মতো। প্রথমে ওই ১০০ করার পর ভেবেছি হয়তো পরের ম্যাচে হয়ে যাবে। হয়নি।
তৃতীয় ম্যাচে হয়তো হবে। সেখানেও হয়নি। এবার কক্সবাজার এসে হলো। কক্সবাজারে ওরা আসছে। তবে পরিকল্পনা ওরকম ছিল না। ওরা ফ্রি ছিল তাই আসছে। আসার পর ওদের অবশ্যই ভালো লাগছে।
খেলাটা যখন শুরু করেছিলেন, এখন যেখানে আছেন পুরো সফরটাকে কিভাবে দেখছেন। কতটুকু সন্তুষ্ট?
মার্শাল আইয়ুব: সন্তুষ্ট বলতে, আমাদের যেরকম খেলা হয়, আমরা কিন্তু এই অর্জনগুলো আরো আগে করে ফেলতে পারতাম। যেমন আমি, শুভ, নাঈম ভাই, তারপর ফরহাদ হোসেন। যদি আমাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ম্যাচ একটু বেশি হতো।
আমরা যখন শুরু করছি তখন আমাদের ১০টা ম্যাচ ছিল। পাঁচ বিভাগ আমরা দুইবার করে ম্যাচ খেলতাম। মাঝে যখন বিসিএল শুরু হয়েছে তখন আমাদের ম্যাচ কিন্তু একটু বেড়ে গিয়েছিল। আবার শেষ চার-পাঁচ বছর কিন্তু বিসিএলও হচ্ছিল না। এসব খেলা যদি খেলতে পারতাম, আরো আগে মনে হয় ১০ হাজার রান হয়ে যেত।
আমার আগে নাঈম ভাইয়ের হয়েছে। উনার আরো আগে হতে পারত। এখন ১২ হাজার রানের পরিকল্পনায় খেলতে পারতেন।
তুষার ইমরানও কী একই?
মার্শাল আইয়ুব: নাহ। তুষার ভাই আবার বিসিএল ডাবল লিগ পেয়েছিল। কিছু ম্যাচ টানা বেশি পেয়েছিল। শেষ কয়েক বছর সিঙ্গেল রাউন্ড হয়েছে।
৫ ডিসেম্বর ৩৭ এ পা দেবেন। পরের পরিকল্পনা করেছেন?
মার্শাল আইয়ুব: এরপরে তো প্রিমিয়ার লিগ আছে। প্রিমিয়ার লিগে এখনো আমার ডিমান্ড আছে। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে ভালো পারিশ্রমিক পাই। অনেকে এরকম পায় না। যদি পারিশ্রমিক আবার কমে যায় তাহলে কঠিন হয়ে যাবে আমার জন্য। এজন্য পারফর্মটা করতে হয়। এরপর তো আবার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। যদি রান কমে যায় তাহলে অবসর নিয়ে নেব।
আরেকটা বিষয়ও আছে, আমাদের যেটা হচ্ছে যদি কোনো তরুণ ব্যাটসম্যান মিডল অর্ডারে আসে তাহলে ভালো লাগে। কিন্তু ঢাকা মেট্রোতে শেষ কয়েক বছর ধরে মিডল অর্ডারে তেমন কেউ নেই। আমি, শুভ- বাবুল ভাইকে (কোচ) বলেছি, তরুণ কাউকে সুযোগ দিতে চাইলে দিতে পারেন। কিন্তু তিনি ওই রকম ভরসা তিনি করতে পারেননা। অনেকেই হয়তো মনে করেন, আমরা সব সময় শুধু খেলতেই চাই। আসলে জিনিসটা ওরকম না।
রান আসলে অনেকেই করে। কিন্তু আপনার ব্যাটিং অনেকেই পছন্দ করতেন। আলাদা করে চোখে লেগে থাকত। বিশেষ করে কাভার ড্রাইভ। নিজের ব্যাটিং আসলে নিজের কাছে কেমন লাগে?
মার্শাল আইয়ুব: ১০ হাজার রান করার পর ফাহিম স্যার আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। উনি আমার অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ। একেবারে অনূর্ধ্ব-১৩ থেকেই আমাদের দেখেছেন। আমাকে বললো, ‘‘এই ছোট ছেলের সোজা ব্যাটে খেলতে খেলতে এখন ১০ হাজার রান হয়ে গেছে।’’ আমার ছোটবেলা থেকে ঐ সোজা ব্যাটে খেলার অভ্যাস ছিল। ঐ কারণেই কাভার ড্রাইভটা এত ভালো হইতো।
আর আমি যাকে পছন্দ করতাম, যার খেলা ভালো লাগতো, রাহুল দ্রাবিড়…দ্রাবিড় কাভার ড্রাইভে অনেক রান করতেন। ওই চিন্তা থেকেই নিজেই চেষ্টা করতাম।
বছর বছর ঘরোয়া ক্রিকেটের খেলা কতটা পরিবর্তন হতে দেখেছেন?
মার্শাল আইয়ুব: আমি যখন প্রথমে খেলতাম তখন আমাদের ঐরকম প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছিল না। উইকেটের কারণে ফলাফল কম হতো। যখন আমি শুরু করছি তখন দেখা গেছে ফ্ল্যাট ট্র্যাক থাকতো। পেস বোলারদের ওরকম সাহায্য থাকতো না। স্পিনারদের সাহায্য থাকতো। এখন দেখা গেছে পেস বোলাররাও ভালো করছে। ডিউক বল এসেছে।
লাস্ট ১০-১২ বছর ধরে ২০০০-২০১১ এর পরের থেকে স্পিনিং উইকেট প্রস্তুত করার চেষ্টা করে বাংলাদেশ। কিন্তু দুই-তিনটা জায়গা ছাড়া হয় না। এখন দেখা গেছে যে, সিলেটেও আপনার স্পোর্টিং উইকেট থাকে। একটু উন্নতি হইছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যদি আপনি লড়াই করতে চান তাহলে নিশ্চিতভাবেই অনেক ভালো উইকেট লাগবে। ধরেন রাজশাহী, বগুড়া, ঐ ধরণের উইকেটে যদি আমরা বেশি খেলি তাহলে আমাদের লড়াই করাটা সহজ হবে।
প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে দুই দশক পেরিয়ে গেলেন। কোন সময়টাকে মনে হয় সেরা সময় ছিল?
মার্শাল আইয়ুব: আমি যে বছর জাতীয় দলে ঢুকলাম। ওই বছর ১১০০ এর মতো রান করেছিলাম বিসিএল ও এনসিএল মিলিয়ে। তারপর যখন বাদ পড়ছি তখন পরের বছর দেখা গেছে ১০০০ রান করছি। এই দুইটা সিজন আমার খুব ভালো গেছে।
এইচপি, ‘এ’ দল পেরিয়ে জাতীয় দলে খেলেছেন। কিন্তু ৩টার বেশি ম্যাচ খেলতে পারেননি। তৎকালীন প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ আপনাকে নিয়ে কী খুব সহজেই হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন?
মার্শাল আইয়ুব: নিশ্চিতভাবেই সে (বিশ্বাস) রাখতে পারেননি। উনি তো চলে গেয়েছিল তারপরে। এরপর যারা এসেছিল নান্নু ভাই, বাশার ভাই, ওরাও তো পারফরম্যান্স দেখেছেন। কিন্তু কখনো ডাকেননি।
ফারুক ভাই বাদ দিয়েছিলেন কী কারণে আজও কী জানেন?
মার্শাল আইয়ুব: নাহ। তবে উনি আমাকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছেন জাতীয় দলে নিয়ে। আমাকে বলছেন যে, ‘‘ওপেন করবি কিনা।’’ আমি মিডল অর্ডারে খেলি, আপনারা তো সবাই জানেন। কিন্তু জাতীয় দলে আমাকে নিয়ে হুট করেই তিনে খেলায়। নাম্বার থ্রি, জায়গাটা টেস্ট ক্রিকেটে কি রকম এটা সবাই জানে। ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটে কারা তিন নাম্বারে খেলে। এই কারণে আমার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল।
আর ওই সময়ে তামিমের পাশে ভালো ওপেনার ছিল না। আমাকে দুই-এক ওভারেই নামতে হয়েছিল। দেখা গেছে, ১৫০ ওভার ফিল্ডিং করেও বসতে পারিনি। আমার তো অভ্যাস ছোট বেলা থেকে মিডল অর্ডারে খেলার। আমি সময় নিয়ে চার-পাঁচ নম্বরে ব্যাটিং করি। এইগুলা কেউ কিছু দেখে নাই। কেউ পরবর্তীতে কিছু বিবেচনাও করেননি। অথচ নিজের পজিশনে যদি খেলতে পারতাম, ঐখানে রান করতাম, দুই-তিনটা সেঞ্চুরি হয়তো বা আসতো।
এরপর তো ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক রান করেছেন। কিন্তু কখনো আপনার দিকে আর ফিরেও তাকাল না কেন?
মার্শাল আইয়ুব: পরে যারা নির্বাচক হয়েছেন তারা তো ধরেন…আমি সর্বোচ্চ রান করেছি এনসিএল, বিসিএলে এবং এক মৌসুমে ১০০০ মতো রানও করেছি। কিন্তু তারা কখনো ফিরেও দেখে নাই আমাদের। আমাদের যে একটা-দুইটা জেনারেশন আছে, তারা কিন্তু ঐ জেনারেশনকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। নাঈম ভাই, শুভ, আমি, রুবেল। এইগুলা খুব খারাপ লাগত তখন।
এখনকার সবাই কিন্তু অনেক সুযোগ পায়। যেমন, আমাকে একজন নির্বাচকই বলছিল যে, যেই রান করে আমি ঢুকছি, আমাকে হয়তো বা পাঁচ-সাতটা টেস্ট অনায়াসেই খেলাতে পারত। ওই সিজনে দুইটা ২০০ করেছিলাম আমি। কিন্তু সুযোগ দেয় নাই।
উনারা হয়তো বা আগে দেখে বিচার করে ফেলেছে, আমাকে দিয়ে হবে না। এখন তো যারা জাতীয় দলে আসছে তারা তো অন্তত ১০ ম্যাচের নিশ্চয়তা পেয়ে ঢুকছে। চাপমুক্ত করা পারফর্ম করতে পারছে।
পৃথিবীর সব দেশে অভিজ্ঞদের মূল্যায়ন হয়। আমাদের কি উল্টো?
মার্শাল আইয়ুব: আমাদের দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি এমনই। আপনার ২৫-২৭, ৩০ এর পর কোন খেলোয়াড়কে নিতেই চায় না, খুব কষ্ট হয় তাদের নিতে। আপনি অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়গুলোকে দেখেন, আমি সাদমানকে দেখা হলেই বলি, ‘‘দেখ ওদের খেলোয়াড়ের পাশে বয়স লিখা থাকে। ওইটাকে তারা সম্মান করে।’’ যাদের বেশিরভাগ বয়স ৩০ এর উপরে। কারো বয়স ৪০ এর কাছাকাছি। এক দুইজন থাকে হয়তো বা ২৫-২৬।
ব্যাটসম্যানদের ম্যাচুরিটি আসে ২৫-২৮ এর পরে। অনেকদিন খেলার পরে, যারা টেস্ট ক্রিকেট খেলতে চায়। আমাদের বোর্ড তো আর অস্ট্রেলিয়ান বোর্ডের মতো না। আমাদের তো ২৫-২৬ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এর পরে একটু একটু করে আড়াল করে দেয়। যদি পারফরম্যান্স ওরকম না হয় জাতীয় দলের। ২৫ বছর ধরে একই সংস্কৃতি দেখছি আমি।
নামের পাশে ২৮টা সেঞ্চুরি। এটাকে কোথায় নিয়ে যেতে চান? আর আপনার চোখে আপনার সেরা ইনিংসটি কোনটা?
মার্শাল আইয়ুব: আমার সেরা ইনিংস বিসিএলে ২৮৯ রানের। ট্রিপল করতে পারিনি। আরেকটা হচ্ছে, আমি মিরপুরে একবার ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি করেছিলাম। ঐটাকে আমি হাইলি রেট করি। দলকে ফলোঅন থেকে বাঁচানোর পর দ্বিতীয় ইনিংসে হার এড়ায় দিই। এখন ২৮ সেঞ্চুরি আছে। আর যদি তিনটা সেঞ্চুরি পাই তাহলে ভালো লাগবে।
আশা অনেক আগে ছেড়ে দিয়েছেন হয়তো…তারপরও কি মনে হয় সত্যিই যদি একবার সুযোগ আসত জাতীয় দলে খেলার...ফেরার বিষয়টিকে কিভাবে নেবেন? কিংবা ওই তাড়না কি এখনো আছে না আপনার?
মার্শাল আইয়ুব: না না। এখন আর চিন্তাই করি না। ঐ চিন্তা আর আসেই না। আমাদের ফিটনেস ঠিক আছে, ভালো। কিন্তু ওদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গেলে…সাথে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটের একটা প্রেসার আছে। তাই ওগুলা এখন আর চিন্তাও করি না। এইজন্যই ভালো খেলি।
এখন আসলে কার ব্যাটিং দেখতে ভালো লাগে। কাকে বেশ প্রতিশ্রুতিশীল মনে হয়?
মার্শাল আইয়ুব: অমিত হাসানের খেলা। বেশ সুন্দর, গোছানো ক্রিকেট খেলে। দেখতে ভালো লাগে।
ঢাকা/ইয়াসিন