ঢাকা     শুক্রবার   ০৩ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২০ ১৪৩১

চ্যালেঞ্জই পুঁজি মাগুরার গৃহবধূ তাহমিনার

মেহেদী হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:১৩, ৩১ মার্চ ২০২৪   আপডেট: ২০:১৫, ৩১ মার্চ ২০২৪
চ্যালেঞ্জই পুঁজি মাগুরার গৃহবধূ তাহমিনার

তাহমিনা আশরাফি। স্বামী ও তিন ছেলেসহ যৌথ পরিবারে বসবাস তার। সংসার সামলানোর পাশাপাশি মাগুরা থেকে ব্যবসা করে তিনি এখন সফল উদ্যোক্তা। ২০২০ সালে করোনার সময়ে এ গৃহবধূ উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু তার শুরুর গল্পটা অন্য সবার থেকে আলাদা।

২০০২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর বিয়ে হয়ে তাহমিনার। এরপরই বন্ধ হয়ে পড়ালেখা। দায়িত্ব শুরু হয় সংসার সামলানোর। এর কিছুদিন পর কোল জুড়ে আসে ছেলে সন্তান। সংসার-সন্তান নিয়েই তার ভালোই চলছিল। কিন্তু এক সময় মনে হয়, লেখাপড়া আবার শুরু করা দরকার। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১০ সালের দিকে ডিগ্রিতে ভর্তি হন। তার চুড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফল আসার পর একটা বিষয়ে অনুপস্থিত দেখা যায়। সবমিলিয়ে বেশ হতাশ হয়ে পড়েন। পরে আর পরীক্ষা না দেওয়ায় অসম্পূর্ণই থেকে যায় ডিগ্রি। তবে লেখাপড়ার আগ্রহ কখনো কমেনি।

২০১৫ সালের দিকে বড়ছেলে তাকে ফেসবুক আইডি খুলে দেন। পরে বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন, খোঁজ পেয়ে যান উই গ্রুপের। তাহমিনা বলেন, আমার ছেলে ফেসবুকে আইডি খুলে দেয়। আমার ননদ উদ্যোক্তা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। উই গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেখানে দেওয়া বিভিন্ন পোস্ট পড়তাম। পরে রাজিব আহমেদ স্যারের ডিজিটাল স্কিল গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হই। এখান থেকেই মূলত উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখি।

তাহমিনার রান্নার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ ও ভালোবাসা আগে থেকেই। নতুন নতুন নানা রেসিপি রান্না করে পরিবারকে খাওয়াতেন। তিনি বলেন, নিজে কিছু করার ইচ্ছা অনেক আগে থেকেই ছিল। যেহেতু রান্না করতে খুব ভালোবাসি, তাই খাবার নিয়ে কাজ করার চিন্তা মাথায় আসে। সেই ভাবনা থেকে ‘এফএম কিচেন’ নামে একটি ফেসবুক পেজ খুলি। এই পেজটা আমার ছেলে খুলে দেয় এবং নিজে লোগো তৈরি করে।

কিন্তু মফস্বল থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে সফলতা প্রায় অসম্ভব। এজন্য তিনি রান্নার উপকরণ থেকে শুরু করে ঘরে তৈরি শুকনা খাবার নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তার পণ্যের মধ্যে রয়েছে- বিভিন্ন ধরনের পিঠা, হাতে তৈরি সেমাই, কুড়মুড়ে জাতীয় গজা/মুরালি, খাজা, চানাচুর, নিমকি, কোকোনাট বার, পিনাট বার, বিভিন্ন ধরনের নাড়ু, মোয়া, মোরব্বা, কুমড়ো বড়ি, ঘি,মধু,মাংসের শাহী গরম মসলা, জিরা গুঁড়া, হলুদ গুঁড়া, ঢেঁকিতে কোটা আতপ চালের গুঁড়া, সজনে পাতার গুঁড়া, নিম পাতার গুঁড়া, নারকেল তেল, বিভিন্ন ধরনের আচারসহ নানা খাবার ও পণ্য।

তবে তার সিগনেচার পণ্য খই-মুড়কি। এমনকি তার মাংসের আচারও রয়েছে, যা অনন্য। আর এসব পণ্য তিনি নিজ হাতে তৈরি করেন। তবে কাজে সহযোগিতার জন্য এলাকার দুই-একজন মহিলা রাখা আছে।

যৌথ পরিবার হওয়ায় ব্যবসা শুরু করাটাই ছিল তাহমিনার বড় চ্যালেঞ্জ। তবে তাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন তারই শাশুড়ি। তাহমিনা বলেন, আমার ননদ নানা পরামর্শ দিয়ে খুব সহযোগিতা করেছে। আমার বড়ছেলে ও শাশুড়ি সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে। ২০২২ সালে আমার শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর আমি এক রকম একা হয়ে গেছি। এখন অবশ্য সবকিছুতে ছেলে পাশে থাকে। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অর্ডারগুলো আসে। কুরিয়ারের মাধ্যমে সেগুলো রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়ে দেই।

তিনি বলেন, আমি রান্না করা করতে খুব ভালোবাসি। কিন্তু সেগুলো নিয়ে কাজ করতে পারি না। রান্না করা খাবারসহ দ্রুত পচনশীল পণ্য নিয়ে কাজ করা সম্ভব না। এজন্য আমি শুকনা পণ্য বা সহজে পচে না এমন সব পণ্য নিয়ে কাজ করি।

যৌথ পরিবারের একজন গৃহবধূর জন্য কোনো কাজ করাটা সত্যিই বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জটাই গ্রহণ করেছেন তাহমিনা। স্বামী-সন্তান-সংসার সামলানোর পাশাপাশি পণ্য প্রস্তুত করে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত অনেক কষ্ট হলেও প্রাপ্তিটা অনেক।

এ নারী উদ্যোক্তা বলেন, আমার তিনটা ছেলে। তাদের দেখাশোনা করাসহ সংসার সামলিয়ে উদ্যোক্তা হওয়াটা কষ্টের। তবে নিজের আয় করা টাকা খরচ করা বা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মধ্যে আলাদা একটা আনন্দ রয়েছে। যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।

এ উদ্যেক্তা আরও বলেন, আমার সংসার জীবন ২২ বছর পেরিয়ে গেছে। বয়সও ভালোই হয়েছে। আমিই মনে হয় বয়সের দিক দিয়ে অনেক দেরিতে শুরু করেছি। আমি মনে করি, সবকিছু বয়সের ফ্রেমে বন্দি করা করা ঠিক না। কোনোকিছু শুরু করার জন্য বয়স লাগে না। শুধু ইচ্ছে থাকাটা জরুরি। আমি এখনো নিয়মিত লেখাপড়া করি। নিজের উন্নতির জন্য উদ্যোক্তা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি।

আয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি নিজের দুর্বলতার কথা অকপটে স্বীকার করেন তাহমিনা। তিনি বলেন, আমি গ্রামের মেয়ে। লেখাপড়ার অনেক গ্যাপ ছিল। আমি অনেকের মতো পণ্যের প্রচার ভালোভাবে করতে পারি না, কিন্তু নিয়মিত শিখছি। তিনটা সন্তানের লেখাপড়াসহ সবকিছু দেখাশোনা করে পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় না। সম্প্রতি ডায়াবেটিসও ধরা পড়েছে। এর মধ্য দিয়েই কাজ করে যাচ্ছি। গড়ে প্রতি মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয়।

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়