রবীন্দ্র-নজরুল কাব্যে বৈশাখ ও ঝড়
|| রাইজিংবিডি.কম
শাহ মতিন টিপু
বৈশাখ আসে ঝড় নিয়ে। বৈশাখ সাহসী, ক্ষ্যাপা, বৈরী, অশান্ত, অসীম, মারমুখো, নির্দয়। কিন্তু তার সৃজনক্ষমতা শিল্পীর সুনিপুন সৌকর্যকে হার মানায়, তার নতুন করার পালা তার নবায়নী ধারা প্রকৃতির সকল পারক্ষমকে হার মানায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বৈশাখকে আহবান করেন এভাবে-
‘এসো হে বৈশাখ! এসো এসো, তাপস নিঃশ্বাস বায়ে...।’
নজরুল নিজেই ছিলেন বৈশাখের প্রতীক। তিনি নিজেই কালবৈশাখীর মত আবির্ভুত হন বাংলা কবিতায়। বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতায় কবি নিজেই ঘোষনা করেন-
‘আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকালবৈশাখীর...।’
কোন ঋতু যেমন স্থায়ী নয়, তেমনি দুঃখময় সময়ও স্থায়ী নয়। যখন ঝড় আসে, তখন সে সব কিছু ভেঙ্গে চুরে তছনছ করে দিয়ে যায় তার দূর্দান্ত গতি ও প্রচন্ডতা দ্বারা। এজন্যই ঝড় ধবংসের প্রতীক। কিন্তু সেই ধবংসই আবার সৃষ্টির সম্ভাবনাকে ত্বরান্নিত করে।
কবিগুরু তাই ‘ক্লান্ত বরষের সর্বশেষ গান’ এ ঝড়কে আহবান করে বলে উঠেন-
‘গাও গান, প্রাণ ভরা ঝড়ের মতন ধ্রুব বেগে
অশান্ত আকাশে।
উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা
বিপুল নিঃশ্বাসে’
কবিগুরু নতুনকে আমন্ত্রন জানান কালবৈশাখীকে -
‘আনন্দে আতঙ্কে নিশি নন্দনে উল্লাসে গরজিয়া
মত্ত হাহা রবে
ঝার সঞ্জীব বাধ উন্মাদিনী কালবৈশাখীর
নৃত্য হোক তবে।’
‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় নজরুল বলেন-
‘ধবংস দেখে ভয় কেন তোর ? প্রণয় নুতন সৃজন বেদন
আসছে নবীন জীবন হারা অসুন্দররে করতে ছেদন
তাই সে এমন কেনো যেনো
প্রলয় বয়েও আসছে হেসে মধুর হেসে
ভেঙ্গে আবার গড়ছে জানে সে চির সুন্দর।’
দ্বান্দ্বিক দর্শনে সাথে আবার তাকে বলতে দেখি :
‘তোরা সব জয়ধবনি কর
তোরা সব জয়ধবনি কর
ঐ নতুনের কেতন উড়ে কালবৈশাখীর ঝড়।’
কালবৈশাখী বলতে আমরা দুরন্ত ঝড়কেই বুঝি। কোন গতিশীল ধবংসাত্বক বিষয়ের উপমা দিতে তাই কবিরা উল্লেখ করেন কালবৈশাখীর। নজরুল এর ‘ভাষার গান’ এ দেখি-
‘নাচে ঐ কালবৈশাখী
কাটাবি কাল বসে কি ?
দেরে দেখি
ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি।’
আর রবীন্দ্রনাথ তার ‘পৃথিবী’ তে লিখলেন-
‘বৈশাখে দেখেছি বিদ্যুত্ চঞ্চুবিদ্ধ দিগন্তকে
ছিনিয়ে নিতে এল
কালো শ্যেন পাখির মত তোমার ঝড়
সমস্ত আকাশটা ডেকে উঠল যেন
কেশর দোলা সিংহ;
তার লেজের ঝাপটে ডালপালা আলুথালু করে
হতাশ বনস্পতি ধুলায় পড়ল উপুড় হয়ে।’
এখানে ঝড় ও বৈশাখ একাত্ব হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষশেষ’ এবং নজরুলের ‘ঝড়ঃপশ্চিম তরঙ্গ’ রচনাকালের একটা সাদৃশ্য রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষশেষ’ কবিতার নিচে লেখা আছে, ১৩০৫ সালে ৩০চৈত্র ঝড়ের দিনে রচিত।
আর নজরুল ইসলামের ‘ঝড়ঃ পশ্চিম তরঙ্গ’ লেখার শানে নুজুল সম্পর্কে প্রাণতোষ চট্রোপাধ্যায় লিখেছেন- এ বছরেই (১৯২৪) কবি কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা ও গান লেখেন । তার মধ্যে ‘ঝড়ঃপশ্চিম তরঙ্গ’ কবিতাটি অন্যতম। দীর্ঘ আট পৃষ্ঠা কবিতা ব্যাসিলরি দিসেনট্রি ও প্রবল জ্বরের মধ্যে তিন/চার ঘন্টা ধরে একাগ্র মনে লিখে আমাদের শুনিয়ে তবে তিনি বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজলেন।’ (হুগলীতে কাজী নজরুল )