ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

দিলরাজের নীল কলম

তানভীরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৪, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০  
দিলরাজের নীল কলম

শরৎকাল চলছে অথচ গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ। খাঁ খাঁ করছে চারদিক। এ সময়ে কোনো কিছুই ভালো লাগে না। আমরা যা পেতে চাই, তাই ভালো বলি। প্রতিটি বিষয়েরই একটি নিজস্ব ভালো দিক থাকে। ভালো কেন লাগে তার নির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় কি আদৌ?

এসব ভাবতেই কফি ভর্তি মগে চুমুক। দিলরাজ, দিলরাজ বলে ডাক আসলো কানে। তারপর আর কোনো সাড়া শব্দ নেই। বাবা ডেকেছিলেন হয়তো। নানু রেখেছেন নামটি ‘দিলরাজ’...। দিলরাজ অর্থ- one who rules on the hearts। নামের অর্থের সঙ্গে চরিত্রের মিল খুব একটা নেই। মাথায় ঘন কালো বাবরি চুল। হালকা দাঁড়িও গজিয়েছে। উচ্চতা পেয়েছি বাবার কাছে।

প্রচণ্ড মাথা ধরেছে আজ। ডা. আদিত্যের ট্রিটমেন্টে আছি। তিনি এসময়কার সবচাইতে অভিজ্ঞ চিকিৎসক। তবুও মাথা ব্যথা কমার কোনো লক্ষণ দেখছি না। কফির মগটি এখনো হাতে, তবে সেটা শূন্য। রাবেয়া খালা কফির সঙ্গে কিছু টোস্ট দিয়ে গেছেন। কোন ব্রান্ডের তা বলতে পারবো না। তবে খেতে দারুণ লাগছে। আমার জন্মের আগ থেকেই তিনি আমাদের বাসায় কাজ করছেন। তাকে কাজের লোক মনে হয়নি কখনো। বয়স পঞ্চাশের বেশি হবে। চুল আধপাকা। কপালে তার অদ্ভুত এক তিল। এক মায়াবী স্বভাবের মানুষ তিনি।

সৃষ্টিকর্তা কিছু মানুষকে অনেক মায়া মমতা দিয়ে পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে। আমার প্রতি মমতাময়ী ভালোবাসা তার। যেন তারই গর্ভে জন্ম হয়েছিল আমার! এ ছুটির দিনগুলোতে বেশ দেরি করেই ঘুম থেকে উঠি। সূর্যোদয় কতদিন আগে দেখেছি, তা জানা নেই। সকাল হয়েছে, কাচের জানালা দিয়ে সূর্যের আলোয় রুমের অন্ধকার কেটে গেছে। তবুও শুয়ে আছি। হালকা ঘুমের মাঝে কিছু একটা শুনতে পেলাম। কেউ ডাকছে। তারপর আরও কয়েক দফায় ডাক চললো।

মায়াবী কণ্ঠ...‘দিলরাজ বাবা, উঠে পরেন, সকাল হয়ি গেছেগা। আপায় রাগ করবো। নাস্তা রেডি হইছে, মুখ ধুইয়া খাইতে আসেন’। বুঝতে পারলাম রাবেয়া খালাই ডাকছেন।

ঘুমের মধ্যেই বললাম, খালা আমার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে রাখো। ‘আইচ্ছা বাবা, বানায় রাখতাছি।’ আজ হঠাৎ করে তার মুখে বাবা ডাকটা শুনে খুবই ভালো লাগছে। মমতাময়ী কণ্ঠে যেন নির্ভেজাল ভালোবাসা। অথচ ছোটবেলা থেকেই তিনি এভাবেই আমায় সম্বোধন করে আসছেন। আজ হঠাৎ কেন এমন হলো? এ প্রশ্নের উত্তর আমার কছে নেই।

ভার্সিটিতে ভর্তির পর বছরে দুয়েকবার আসা হয় বাসায়। অনেক স্মৃতিই এখন ঝাপসা হতে শুরু করেছে। পরিবারের ছোট ছেলে। তাই ঘরমুখো থাকতে হয়েছিল ছোট থেকেই। আম্মু ও রাবেয়া খালার অতি আদরে বড় হয়েছি। বলতে গেলে রাবেয়া খালার কোলেই আমার শিশুকালটা কেটেছে।

আজ হঠাৎ করেই এসব ভাবনার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। পুরনো স্মৃতিতে আলোড়ন ঘটলো। ‘মমতার প্রতিদান’ বলে একটা কলাম পড়েছিলাম বহুদিন আগে। এ মমতার প্রতিদান কোনো কিছু দিয়ে পরিশোধ করা অসম্ভব। এই মানুষটির কোলে-পিঠে আস্তে আস্তে বড় হওয়া, হামাগুড়ি দেওয়া, তার সঙ্গে হাঁটা-দৌড়ানো। শিখেছি কথা বলাও। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। আজ মনে হচ্ছে সময়ের গতি অনেক বেশি। দেখতে দেখতে কতগুলো বছর কেটে গেলো।

মায়া-মমতা বা ভালোবাসা এসব কোনো যুক্তিতে নিয়ে আসা যায় না। এটা মানুষে মানুষে হয়। আবার প্রাণীদের ক্ষেত্রেও হয়। মমতা, ভালোবাসা এসব ভাবনা ঘুরছে মাথায়। হঠাৎ একজনের কথা মনে পড়ে গেলো। এখন প্রায়ই মনে পড়ে তার কথা। ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারি না।

শেষবার তাকে দেখেছিলাম ক্লাস টেনে পড়াকালে। চুল কাটিয়ে বাসায় যওয়ার পথে তার সঙ্গে দেখা। ছয়টি বছর কেটে গেলো। আজও স্পষ্ট মনে আছে জুহাইরিয়া ওর বাবার সঙ্গে এক মোবাইলের শো-রুমে ঢুকলো। কিন্তু কথা বলার সাহস ছিল না সেদিন। কচু পাতা রঙের থ্রিপিস পরে আছে ও। তাতে সুন্দর অ্যামব্রয়ডারি করা, দারুণ মানিয়েছিল তাকে। সপ্তম শ্রেণির পর আর সেভাবে কথা হয়নি তার সঙ্গে।

এর মাঝে অনেকটা বছর কেটে গেছে। সময়ে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এখনও তাকে নিয়ে ঠিক আগের মতোই এ ভাবনার খেলা চলছে। হয়তো আগের থেকে অনেকটা বেশিই। কথা বলার সব মাধ্যমই আছে। তবে কথা বলা হয়ে ওঠে না।

‘এই দিলরাজ, কই যাচ্ছিস?’ এভাবেই ডাকতো সে রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে। হঠাৎ কোনো একদিন হয়তো দেখে ভিড়ের মধ্যে ডেকে বলবে- ‘এই দিলরাজ কই যাচ্ছিস?’ হয়তো...।

হালকা বাতাস বইছে। হুট করে কালো মেঘে ছেয়ে গেলো আকাশ। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। এ জগতের ভালোবাসা ও মমতা বিষয়গুলো ভারি অদ্ভুত। কোনো লজিক নেই। এমনি এমনিই হয়ে যায়। অনেকগুলো শরতের স্নিগ্ধ বিকেল জীবন থেকে চলে গেছে। মাঘের কনকনে ঠাণ্ডাও আজ আর অসহ্য মনে হয় না।

রাবেয়া খালা মারা যাওয়ার কয়েক বছর হলো। তার ছেলে এসেছিল দেখা করতে। সে বললো-আম্মায় মারা যাওয়নের আগে কইছিল, ‘আমার দিলরাজ আইছে কি? আমার দিলরাজরে ডাক দাও কেউ।’ শুনে অবাক হয়েছিলাম। কতটা ভালোবাসা থাকলে এটা সম্ভব! 

মনে হলো নিজের মা’কে হারিয়েছি। বিষয় দুটিতে চরিত্রগত পার্থক্য থাকলেও অনুভূতির মাপকাঠিতে তা সমান। সিক্ত এই ভালোবাসা নিয়েই জীবন কেটে যাচ্ছে। অনুভূতির বিষয়গুলো বেশ জটিল। কোনো সমীকরণের মধ্যে রাখা যায় না এটিকে।

ও আজও হেঁটে যাচ্ছে। পরনে সাদা অ্যাপ্রোন। গলায় stethoscope ঝোলানো। পাশে আরেকজন। ও হাসছে। হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে ওরা। এসব দেখে খুবই ভালো লাগছে কেন যেন! হয়তো এখনো ভালোবাসি তাই...!

লেখক: শিক্ষার্থী, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

ইবি/মাহফুজ/মাহি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ