ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

লায়ন-টাইগার থেকে লাইগার

ফারেশ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৬, ১৮ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৭:১৭, ১৮ অক্টোবর ২০২০
লায়ন-টাইগার থেকে লাইগার

আমরা কমবেশি সবাই টাইগার (বাঘ) ও লায়ন (সিংহ) সম্পর্কে জানলেও লাইগার নিয়ে আমাদের জানাশোনা একেবারে কম।

লাইগার মূলত পুরুষ সিংহ ও স্ত্রী বাঘের সংকরায়নের ফলে জন্ম নেওয়া নতুন এক হাইব্রিড প্রাণী।  এটি দেখতে বৃহৎ আকৃতির সিংহের মতো হলেও এর গায়ে বাঘের মতো ডোরাকাটা দাগগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। মজার বিষয় হলো, সিংহ সাঁতার কাটতে না জানলেও কিন্তু লাইগার বাঘের মতো সাঁতার কাটতে সক্ষম।

লাইগারের প্রকারভেদ: শারীরিক আকার আকৃতির ওপর ভিত্তি করে লাইগারকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা যায়। এরা কেশরযুক্ত লাইগার, কেশরবিহীন লাইগার, টাইগার লুক-অ্যা লাইক লাইগার ও সাদা লাইগার। শারীরিক এসব ভিন্নতা শুধু পুরুষ লাইগারের মধ্যেই দেখা যায়।  এর মধ্যে প্রথম দুটি সাধারণ হলেও সাদা লাইগার কিন্তু সচরাচর দেখা যায় না। সবগুলো লাইগারের মধ্যে কেশরযুক্ত লাইগারের ঘাড়ে সিংহের মতো কেশর থাকে। এদের কেশরগুলো সিংহের তুলনায় ছোট।  দেখতে স্বর্ণকেশীও হয়ে থাকে। 

এদিকে লাইগারের ঘাড়ে কোনা কেশর থাকে না। হারকিউলাস, জিওস, ভলকান ও সিনবাদ হলো কয়েকটি কেশরবিহীন লাইগারের উদাহরণ। এর মধ্যে হারকিউলাস সবচেয়ে বড় লাইগার, যার ওজন প্রায় ৯২১ পাউন্ড। 

টাইগার লুক-অ্যা লাইক লাইগার দেখতে প্রধানত বাঘের মতো।  এদের শরীরে মূলত সিংহের তুলনায় বাঘের জিন বেশি থাকে বলে এমনটা দেখায়।  কিলার রকি লাইগার হলো টাইগার লুক-অ্যা লাইক লাইগারের মধ্যে অন্যতম। এদিকে সাদা লাইগারের উৎপত্তি হলো সাদা পুরুষ সিংহ ও সাদা স্ত্রী বাঘ হতে। অবাক করা তথ্য হলো, পৃথিবীতে মাত্র ৪টি সাদা লাইগার রয়েছে।  এই চার রকমের বাইরে আরও দুই ধরনের লাইগার পাওয়া যায়, এরা লিলিগার ও টিলিগার।

আকার-আকৃতি 

বিশুদ্ধ প্রজাতি হিসেবে সাইবেরিয়ান বাঘকে বিড়াল প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ প্রজাতি হিসেবে ধরা হলেও কিন্তু লাইগার হলো বিড়াল প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রাণী। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ লাইগার প্রায় ৩.৩ মিটার বা ১০.৮ ফুট পর্যন্ত দীর্ঘ হয়ে থাকে। বয়স ভেদে এদের ওজন ৪০০ কেজি বা ৯০০ পাউন্ড হয়ে থাকে। তবে কারও কারও দেওয়া তথ্যমতে, এরা ১০০০ কেজি বা এক মেট্রিক টন পর্যন্তও হয়ে থাকে। বিজ্ঞানীদের মতে পুরুষ সিংহের শরীরে বিশেষ ধরনের এক গ্রোথ প্রোমোটিং জিন থাকে, যা বাঘের শরীরে অনুপস্থিত থাকে। ফলে, লাইগার একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাড়তেই থাকে।

স্বভাব ও বাসস্থান

বাঘ ও সিংহ ভয়ঙ্কর শিকারি হওয়া সত্ত্বেও এরা নিরীহ হয়ে থাকে।  লাইগার মানুষের সান্নিধ্য পেতে পছন্দ করে। এই স্বভাব তারা পুরুষ সিংহের কাছে থেকে পায় বলে ধারণা করা হয়। লাইগার মূলত মানুষের সঙ্গে খেলতে পছন্দ করে।  এরা খুব সামাজিক হয়। যে কেউ চাইলে একটি লাইগারকে পোষ মানাতে পারে। লাইগার মূলত বাঘ ও সিংহের মতো গর্জন করে থাকে। 

এরা খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারে ও পানিতে খেলতেও পছন্দ করে। যেহেতু লাইগার প্রাকৃতিকভাবে হয় না, তাই এদের বনে পাওয়া যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লাইগারকে চিড়িয়াখানা, অভয়ারণ্য ও মানুষের কাছে দেখা যায়। এদের এই শান্ত স্বভাবের কারণে অনেকে পোষ মানিয়ে নিজের কাছে রেখে দেয়।

খাদ্যাভাস 

অন্যসব বিড়ালজাতীয় প্রাণীর মতো লাইগার ও মাংসাশী প্রাণী।  এরা মূলত অন্য প্রাণীদের মাংস খায় এবং এর মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় শক্তি পেয়ে থাকে। একটি পূর্ণবয়স্ক বিশালদেহী লাইগার দৈনিক গড়ে ৩০ পাউন্ডের মতো কাঁচা মাংস খেতে পারে। তবে ড. এন্টল-এর দেওয়া এক তথ্যমতে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরা ১০০ পাউন্ড পর্যন্ত খেতে সক্ষম। এদের খাদ্য তালিকায় মূলত গরুর মাংস থাকলেও এরা হরিণের মাংস বা হরিণ বিশেষের মাংস ক্ষেতে পছন্দ করে। তবে কোনো কোনো লাইগার মুরগীর মাংস ও খেয়ে থাকে। প্রতিটি প্রাণীর জন্য পানির প্রয়োজন হলেও একটি লাইগার গড়ে প্রতিদিন ৪ লিটারের মতো পানি পান করে থাকে। এরা যদি বন্য পরিবেশে থাকতো, তাহলে এদের খাদ্য তালিকায় স্থান পেতো শূকর, বন্যশূকর, বন্যমহিষের মাংস, হরিণ, শেয়াল আরও কত কী!

খাবার কৌশল

এরা মূলত এদের শক্তিশালী দেহ ও থাবার মাধ্যমে শিকার করে।  এদের একটি কামড়ের শক্তি প্রায় ৯০০ পাউন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের রয়েছে বিশালাকৃতির শক্ত চোয়াল ও তীক্ষ্ণ দাঁত, যা দিয়ে মাংস ছিঁড়ে খায়।

প্রজনন

প্রাণী বিজ্ঞানীদের  মতে, লাইগার হাইব্রিড প্রাণী হওয়ায় এটি বংশ বিস্তার করতে পারে না। কিন্তু ধারণাটি পুরোপুরি মিথ্যা। লাইগারের উর্বরতা কম কিন্তু ব্রিড করতে সক্ষম (উল্লেখ্য, পুরুষ লাইগার একেবারে অনুর্বর)। মূলত স্ত্রী লাইগার পুরুষ সিংহ বা পুরুষ বাঘের সঙ্গে ব্রিড করতে সক্ষম। এটি পুরুষ বাঘের সঙ্গে ব্রিড করলে টিলিগার উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে পুরুষ সিংহের সঙ্গে ব্রিড করলে উৎপন্ন হয় লিলিগার।

লাইগারের সংখ্যা

২০২০ সালের বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাণী অভয়ারণ্য, সাফারি পার্ক, চিড়িয়াখানা ইত্যাদিতে প্রায় ১০০ টিরও বেশি লাইগার রয়েছে। এর মধ্যে শুধু আমেরিকা, চীন ও রাশিয়ায় রয়েছে ৮০ শতাংশের বেশি লাইগার। সবচেয়ে বেশি লাইগার আমেরিকার প্রায় ১৩টি রাজ্যের ২৪-২৮টি চিড়িয়াখানাতে রয়েছে, যার সংখ্যা ৫০টিরও বেশি। তার মধ্যে শুধু ফ্লোরিডাতে রয়েছে সবচেয়ে বেশি, ১২টি লাইগার। 

এদিকে, চীনের ৮টি চিড়িয়াখানাতে রয়েছে ২৪টি লাইগার, আর রাশিয়ার ৭টি চিড়িয়াখানাতে রয়েছে প্রায় ১২টি লাইগার। এই ৩টি দেশ ছাড়াও আরও ১০টি দেশে লাইগার রয়েছে বলে জানা যায়। দেশগুলো হলো: থাইল্যান্ড (১০টি), আর্জেন্টিনা (৪টি), মেক্সিকো (৩টি), ইতালি (২টি), সংযুক্ত আরব আমিরাত (২টি), ফিলিপাইন্স (২টি), দক্ষিণ আফ্রিকা (১টি), ইন্দোনেশিয়া (১টি), তাইওয়ান (১টি), দক্ষিণ কোরিয়া (১টি)।

অন্যদিকে, ভারত, ইংল্যান্ড, জার্মানি, জাপান, লিবিয়া ও নেদারল্যান্ডে আগে লাইগার থাকলেও বর্তমানে তা লাইগার শূন্য বলে জানা গেছে।

লাইগার বাণিজ্য 

বর্তমানে মানুষের লাইগার সম্পর্কে জ্ঞানের পরিসীমা বৃদ্ধি পাওয়ার মাধ্যমে গড়ে উঠেছে লাইগার বাণিজ্য।  এদিকে এটিকে বাচ্চা অবস্থায় পোষ মানানো অনেক সহজ ও লাইগার খুব সামাজিক হওয়ায় একইসঙ্গে এটি বিরল হাইব্রিড প্রাণী হওয়ায় এর চাহিদা বেশি। ফলে দিন দিন বাণিজ্য বেড়েই চলেছে। আমেরিকায় লাইগার ও অন্যান্য বিড়াল প্রজাতি বেশি থাকায় এখানে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয়ে থাকে, যা পুরোপুরি অবৈধ। বর্তমানে লাইগারকে ঘিরে শুরু হয়েছে কালোবাজারি।

প্রায় প্রতি বছরই দেখা যায়, গোপনে গোপনে গাড়িতে করে লাইগার বিক্রি করার জন্য নিয়ে যেতে। গোপনে গোপনে এভাবে লাইগার পরিবহনের সময় কিছু লাইগার মারাও যায়। টাকার জন্য কিছু অসাধু ব্যবসায়ী লাইগার নামক এই বিরল হাইব্রিড প্রাণীকে তাদের অভয়ারণ্য হতে মানুষের কাছে বিক্রি করছে।

সংরক্ষণ

যেহেতু লাইগার প্রাকৃতিকভাবে হয় না ও বন্য পরিবেশে থাকে না, তাই এদের সংরক্ষণ করার কোনো নির্দিষ্ট উপায় নেই। তবে লাইগার রক্ষার্থে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো লাইগার বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে এবং অসাধু চক্রের হাত থেকে লাইগারকে রক্ষা করে এদের অভয়ারণ্যে ছেড়ে দিতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

চট্টগ্রাম/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়