ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

উপকূলবাসীর দুঃসময়ের বন্ধু ব্লাড হাফিজ

শেখ নাসির উদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৮, ১৬ নভেম্বর ২০২০  
উপকূলবাসীর দুঃসময়ের বন্ধু ব্লাড হাফিজ

দিনের সব কাজ শেষে রাতে ভাতের থালা নিয়ে বসেছেন হাফিজ। ভাত মুখে তুলবেন এমন সময় বেজে ওঠল মোবাইল। অপর প্রান্ত থেকে অপরিচিত কন্ঠে মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তি আকুতির স্বরে জানালেন, ‘বাবা আমার মেয়েটাকে বাঁচান, সন্তান প্রসব করতে গিয়ে শরীর থেকে প্রচুর রক্ত বের হচ্ছে।’

রাত তখন ১০টা, আর কিছু না শুনেই হাফিজের পরিচিত রক্তদাতাদের ফোন দিয়ে চলে গেলেন সেই রোগীর বাড়ি। আর সঙ্গে সঙ্গে দুই ব্যাগ রক্ত প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করা মাকে দেওয়া হলো। কিন্তু কিছুতেই রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না। গ্রামের হাতুড়ি ডাক্তার দিয়ে সন্তান প্রসবের চেষ্টা করতে গিয়ে ঝামেলা বাঁধিয়ে বসেছে।

রাত তখন ৩টা, উপায় না দেখে মোটরসাইকেল চালিয়ে ৩০ কিলোমিটার দূর থেকে দুইজনকে নিয়ে এসে আরও দুই ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করা হলো। এভাবেই মোট ১৫ ব্যাগ রক্তের বিনিময়ে শ্যামনগর উপজেলার কালিগঞ্জের সেই মায়ের প্রাণ বাঁচান হাফিজ। প্রতিদিন সময়ে-অসময়ে অনেক মোবাইল আসে, আর কিছু না ভেবেই প্রাণ বাঁচাতে রোগীর দুঃসময়ে ছুটে যান সাতক্ষীরার একটি ডিগ্রি কলেজের স্নাতক ব্যবস্থাপনা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. হাফিজুর রহমান। 

শ্যামনগর উপজেলার মাজাট গ্রামের কৃষক মো. জিন্নাত আলীর ছেলে হাফিজ। পাঁচ সদস্যের পরিবারে দুই বোন আর হাফিজের পড়াশোনা চলত খুব টানাপোড়েনে। তারমধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিডর আর আইলায় সংসারের অবস্থা আরও খারাপ হয়। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে লেখাপড়াও চালিয়ে গেছেন। আর এজন্য তার বাবা-মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। তবে শিক্ষকের সহযোগিতাও অস্বীকার করার মতো নয়।

স্কুল ও কলেজে থাকাকালীন যুক্ত হয়ে ছিলেন স্কাউটে আর সেখানকার বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে অংশ নিয়ে শেখেন কীভাবে দুর্যোগ মোকাবিলা করে মানুষকে বাঁচানো ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়। ছাত্রজীবন থেকেই সামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত আর স্কাউট টিমের হয়ে উপকূলে কাজের সুবাদে উপকূল জীববৈচিত্র ও উন্নয়ন কর্ম সংস্থাতে (সিডিও) কাজের সুযোগ পান। এরপর থেকেই উপকূলের বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড় ও দূর্যোগের সময় সামনে থেকে কাজ করছেন তিনি। 

স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিভিন্ন কাজের সুবাদে উপকূলের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন।  এক সময় তার কাছে রক্তের জন্য মাঝে মাঝেই ফোন আসতে থাকে। তখন সিডিওর রক্ত সহায়তা কেন্দ্র করার পরিকল্পনা করলেন। তার সেই পরিকল্পনায় সায় দিলেন সিডিওর সব স্বেচ্ছাসেবক।  ‘মানবতা ও মানুষের কল্যাণে, এগিয়ে আসুন রক্তদানে’ এই স্লোগান সামনে রেখে ২০১৮ সালে সিডিও রক্ত সহায়তা কেন্দ্র গড়ে তোলেন। আর এই কেন্দ্রের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় হাফিজকে। আর সেই থেকে সময়ে ও অসময়ে মানুষের প্রয়োজনে রক্ত ব্যবস্থা করে হাজারো মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাই ভালোবেসে মানুষ এখন তাকে ‘ব্লাড হাফিজ’ বলে ডাকেন। 

হাফিজুর রহমান বলেন, ‘ক্লাস নাইনে আমি স্কাউটের একটা ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করি। ওই ক্যাম্প আমার মধ্যে মানুষের জন্য স্বেচ্ছায় কাজ করার আগ্রহ জাগায়। তারপর থেকে আমি স্কাউটের হয়ে দুর্যোগ পূর্বাভাস বার্তা, মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে বুঝিয়ে নিয়ে আসা, ত্রাণ বিতরণসহ নানা কাজ করতাম। ফলে অনেকের কাছে পরিচিত হয়ে যাই। তখন অসুস্থ রোগীর জন্য আমার কাছে রক্ত চেয়ে অনেক ফোন আসত। তাই ভাবলাম ব্লাড নিয়ে আলাদা ইউনিট খুলি। এজন্য সিডিওর বড় ভাইদের ধন্যবাদ, যারা আমাকে সাহায্য করেছেন। তারা পাশে না থাকলে আমার একার পক্ষে এ কাজ সম্ভব ছিল না।’

হাফিজ আরও বলেন, ‘উপকূলের মানুষের মাঝে নিজ বংশে বিয়ের প্রবণতা বেশি বিধায়, এখানে অনেক থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা বেশি। শুরুতে আমরা হিসাব না রাখলেও এখন রক্তদাতা ও গ্রহীতার তথ্য সংগ্রহ করি। গত এক বছরের বেশি সময়ে আমরা ১২’শ মানুষের জন্য রক্তের ব্যবস্থা করেছি। শ্যামনগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের ১৫টি ক্যাম্প করেছি। এতে অনেক মানুষ সাড়া দিয়েছে। দিন শেষে মানুষের মুখের হাসি আমার বড় প্রাপ্তি।’ 

উপকূল জীববৈচিত্র ও উন্নয়ন কর্ম সংস্থার (সিডিও) পরিচালক গাজী আল ইমরান বলেন, ‘হাফিজ সবসময় সংগঠনের দিকনির্দেশনা মেনে চলে। কখনো কাজের প্রতি অনীহা দেখিনি। সিডিও রক্ত সহায়তা কেন্দ্রে তার অবদান অনেক।’

সিডিওর ফেসবুক গ্রুপ-https://www.facebook.com/groups/467946254086605/?ref=share

লেখক: শিক্ষার্থী, ছাফদার আলী কলেজ, মির্জাপুর। 

টাঙ্গাইল/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়