ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বিপন্ন পরিবেশ: নিরুপায় পরিযায়ী পাখি

সিফাত জামান মেঘলা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২২, ১৯ জানুয়ারি ২০২১  
বিপন্ন পরিবেশ: নিরুপায় পরিযায়ী পাখি

পাখি শব্দটি আমাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পাখি ভালোবাসে না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। গ্রামের মানুষের ঘুম ভাঙ্গে পাখির কলকাকলিতে। ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা গ্রামগুলো ছবির মতোই সুন্দর। এছাড়া শহরের মানুষ যখনই ছুটি পায়, ছুটে যায় প্রকৃতির টানে। প্রশান্তির খোঁজে। 

পরিযায়ী পাখি বলতে আমরা বুঝি, নিদিষ্ট প্রজাতির কিছু পাখি প্রতিবছর বা কয়েক বছর পর পর একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে বা সময়ে দুটি অঞ্চলের মধ্যে আসা-যাওয়া করাকে। এর ইংরেজি পরিভাষা ‘Migration’.

শীতকালে আমাদের দেশে কয়েক প্রকারের পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। আমরা ভালোবেসে যাদের ডাকি ‘অতিথি পাখি’। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে তারা অপেক্ষাকৃত অনুকূল অঞ্চলে আসে এবং সেখানে বাসা বাঁধে ও বংশবৃদ্ধি করে। শীত শেষ যখন, তাদের দেশে বরফ গলতে শুরু করে এবং সেখানে নতুন উদ্ভিদ জন্মাতে শুরু করে, তখন নিজের দেশে ফিরে যায় পাখি।

অদ্ভুত বিষয় হলো এত দিন পর ফিরে গিয়ে তারা নিজের বাড়িটি পর্যন্ত চিনতে পারে। তারা মূলত আসে শীতপ্রধান হিমালয়ের পাদদেশ বা সুদূর রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে। বিশেষ করে তুন্দ্রা অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ থেকে ওরা আসে।


পাখিরা মূলত দুইটি কারণে পরিযায়ী হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং বংশবৃদ্ধি। বসন্তকালে উত্তর গোলার্ধে পাখি অতিথি হয় অতিরিক্ত পোকামাকড় এবং নতুন জন্মানো উদ্ভিদ খাওয়ার জন্য। খাদ্যের সহজলভ্যতার জন্য এরা এখানে থেকে যায় এবং বংশবৃদ্ধি করে। শীত পড়া শুরু করলে যখন সব কিছু বরফ হয়ে যায়, তখন আবার দক্ষিণে ফিরে যায়।

এছাড়াও পাখি পরিযায়ী হওয়ার জন্য আবহাওয়া অনেক অংশে দায়ী। প্রচন্ড শীতে তাদের যেমন খাদ্যের অভাব হয়, তেমনি মারাও যায় অনেক পাখি। তাই তারা অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে পরিযায়ী হয়। আলোর তীব্রতা অনেক সময় পাখি পরিযায়ী হতে বাধ্য করে।

আমাদের দেশে প্রায় ৬২৮ প্রজাতির পাখি, তার মধ্যে ২৪৪ প্রজাতি পাখি বিভিন্ন সময়ে পরিযায়ী হয়। পাখিদের ১০ হাজার প্রজাতির মধ্যে ১৮৫৫ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী হয়। যা প্রায় মোট প্রজাতির ১৮ শতাংশ।

পরিযায়ী পাখি তিন ধরনের। যথা-
স্বল্পদৈর্ঘ্য পরিযান: এদের মূলত স্থায়ী বলা যায়। তবে খাদ্যাভাব দেখা দিলে এরা স্বাভাবিক বিচরণ ক্ষেত্রের আশেপাশে পরিযায়ী হয়। তবে তাদের এই পরিযান নিয়মিত নয়।

মধ্যদৈর্ঘ্য পরিযান: এরা প্রায়ই পরিযান ঘটায় এবং এদের পরিযানের এলাকা স্বল্পদৈর্ঘ্যের পাখিদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি হয়।

দীর্ঘদৈর্ঘ্য পরিযান: এ প্রজাতির পরিযান বিশাল এলাকাজুড়ে হয়ে থাকে। এ পরিযান ঘটাতে কয়েক সপ্তাহ সময় নেয়। তখন এরা হাজার হাজার মাইল উড়ে যায়। তবে পরিযায়ী পাখিদের এ পরিযান খুবই রহস্যজনক। কেননা পাখিরা কীভাবে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়, তা এখনো অজানা। তবে যখন এই পরিযান ঘটায়, তখন বয়স্ক ও অভিজ্ঞ পাখিদের সামনে দেওয়া হয় এবং ছোটরা পেছনে থাকে।

এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে এরা সূর্য, তারা, চাঁদ, পাহাড়শ্রেণি, উপকূলীয় রেখা, নদী ইত্যাদিকে পথ নির্দেশক হিসেবে ব্যবহার করে। তবে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, পৃথিবীর চৌম্বুকক্ষেত্র পাখিদের এ কাজে অনেকাংশে সাহায্য করে। তাছাড়া এটা পরিযায়ী পাখিদের সহজাত প্রবৃত্তি। যেসব পাখি একা পরিযান ঘটায়, তাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জীবনের প্রথমবার পরিযান ঘটিয়ে নিদিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। কম-বেশি ৪০০ প্রজাতির পাখি আমাদের দেশে আসা যাওয়া করে।

কিন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পাখিদের পরিযানের বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য পৃথিবীর শীতল অংশ আরো শীতল হচ্ছে এবং উষ্ণ অংশ আরও উষ্ণতর হচ্ছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের পুরোপুরি প্রভাব পড়ছে পাখির পরিভ্রমণে। এর ফলে শীতকাল দ্রুত চলে আসছে। আর শীতকালের স্বায়িত্ব কম হওয়ায় এবং তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় পরিভ্রমণে বাঁধা সৃষ্টি হয়। এর ফলে দেখা যাচ্ছে নিদিষ্ট সময়ের আগেই এরা পরিযান ঘটায়। এতে করে যে উষ্ণ অঞ্চলের সন্ধানে এরা পাড়ি জমাচ্ছে, সেখানে অনেক বেশি গরম থাকায় তাদের স্বাভাবিক জীবন ব্যহত হচ্ছে। ফলে তাদের বংশবৃদ্ধি ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং প্রকৃতির যে বাস্তুসংস্থান তৈরি হতো, তা ব্যহত হচ্ছে।

তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক প্রতিকূলতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে আগের মতো পাখি পরিযানে অংশ নিচ্ছে না। ফলে আগে যে পরিমাণ পাখি পরিযায়ী হতো তার সংখ্যা এখন অর্ধেক। সম্প্রতি এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

আমাদের দেশে ১৯৯৪ সালে অতিথি পাখির এসেছিল ৮ লাখ। ২০১৪ সালে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখেরও কম। ২০ বছরের ব্যবধানে ৬ লাখেরও বেশি পাখির সংখ্যা কমে গেছে।
কারণ তাদের থাকা, খাওয়া ও বাসস্থানের জায়গা আমরা দখল করে নিচ্ছি। মানুষ বাড়ছে, উন্নয়ন বাড়ছে। উন্ননের ফলে জমি, জলাশয় ভরাট করে কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু এই জমিগুলো ছিল পাখিদের দখলে, এখন তা হারিয়ে যাচ্ছে।

তাছাড়া পাখিরা নির্জন স্থানে থাকতে পছন্দ করে। কিন্ত মানুষ এখন তাদের থাকার জায়গা দর্শনীয় স্থান বানিয়ে ভিড় বাড়াচ্ছে। ফলে তারা ভীত- সন্ত্রস্ত হয়ে আর সেখানে আসছে না। তাছাড়া পাখি শিকারের ফলে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তবে হঠাৎ করে কোথাও পাখির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। তবে এটা আঞ্চলিকভাবে বৃদ্ধি। সামগ্রীকভাবে হিসেব করলে পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সারাবিশ্বেই একই অবস্থা। তবে কোনো পাখি একবারে বিলুপ্ত হচ্ছে না। তবে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি কমে যাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে পাখির স্বাভাবিক প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। হাজার হাজার প্রজাতির পাখি ডিম পাড়ে তুন্দ্রা অঞ্চলের সমতল ভূমিতে, নিচু জমিতে। যে জায়গাগুলোতে পাখি ডিম পাড়বে, সেই জায়গা ডুবে যাচ্ছে পানির নিচে। ফলে তারা ডিম পাড়তে পারছে না। ফলে বংশবৃদ্ধি হচ্ছে না। আশঙ্কা করা হচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে এক সময় পরিযায়ী পাখির প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

ববি/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়