ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

যে রাস্তায় লেগে আছে শহীদের রক্ত

রিপন চন্দ্র রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৮, ২৩ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৫:৫৬, ২৩ জানুয়ারি ২০২১
যে রাস্তায় লেগে আছে শহীদের রক্ত

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেটের সরু রাস্তা দিয়ে কয়েক কদম সামনে এগুলেই চোখে পড়বে একটি তিন রাস্তার মোড়। সেখান থেকে ডান পাশের রাস্তাটি চলে গেছে বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস) ভবনের দিকে। সোজা রাস্তাটি গেছে শাহ মখদুম, নবাব আব্দুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর আলী হলের দিকে। 

বাম পাশের রাস্তাটি গেছে মতিহার হলের দিকে। ওই তিন রাস্তার মোড়েই হাতের বাঁ পাশে রয়েছে ইট সিমেন্টের তৈরি একটি নামফলক। নামফলকটার অর্ধেকটা লাল আর উপরের অংশটা সাদা রঙের। সেই সাদার মধ্যে কালো রঙে লেখা ‘শহীদ শাহ্জাহান সিরাজ সড়ক’। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো এমন শিক্ষার্থী খুজেঁ পাওয়া খুবই দুষ্কর, যাদের সঙ্গে এই ছোট্ট রাস্তাটির পরিচয় নেই। ক্যাম্পাস চলাকালীন সর্বদাই শিক্ষার্থীদের পদচারণায় প্রাণবন্ত থাকে রাস্তাটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে বেশি শিক্ষার্থী সম্ভবত এই রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করেন। হয়তো অনেকের চোখেই পড়ে না নামফলকটি। না পড়ারই কথা। কেননা অধিকাংশ সময় নামফলকটির সামনে অস্থায়ী বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ দোকান বসতে দেখা যায়। ফলে কারো মনে ‘জাগে’ না শহীদ শাহ্জাহান সিরাজ সম্পর্কে জানার আগ্রহ। অথচ এই রাস্তা এবং শহীদ শাহজাহান সিরাজ সম্পর্কে রয়েছে কতই না ত্যাগের ইতিহাস। রয়েছে স্বৈরাচারী সরকারের নানা অত্যাচারের ইতিহাসও।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৮৪ সালের ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর, তৎকালীন শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে দেশ তখন উত্তাল। ব্যতিক্রম নয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও। সারাদেশে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট ডাকে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। স্বৈরশাসকের পতন ঘটাতে আন্দোলনে নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন জাসদ সাধারণ সম্পাদক শাহ্জাহান সিরাজ। 

২২ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতারা একাধিক ভাগে ভাগ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন ও কাজলা গেটসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেন। তবে ক্যাম্পাসের সব সংগঠনের নেতারা অবস্থান নেন বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে। তাদের সেই কর্মসূচিতে বাধা দেয় বিডিআর (বর্তমানে নাম পরিবর্তন করে বিজিবি রাখা হয়েছে)। কর্মসূচিতে যেন কোনো ধরনের অপ্রীতিকর কিছু না ঘটে, সে জন্য বিডিআরদের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যান শাহ্জাহান সিরাজ। গায়ে ছিল লাল রঙের শার্ট। কিন্তু বিডিআররা তার সঙ্গে কথা না বলেই বলতে থাকে লাল শার্টওয়ালাকে ‘ফায়ার’ ‘ফায়ার’। সঙ্গে সঙ্গে বুলেট এসে লাল শার্টের পাতলা আবরণ ভেদ করে প্রবেশ করে শাহ্জাহানের বুকে। মুহূর্তেই রক্তিম হয়ে যায় স্টেশন চত্বর। মাটিতে লুটিয়ে পরেন শাহ্জাহান সিরাজ। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদদের খাতায় যুক্ত হয় আরো একটি নাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হারায় এক অকুতোভয় নির্ভিক ছাত্রনেতাকে।

শহীদ ছাত্রনেতা শাহ্জাহান সিরাজ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও তৎকালীন রাবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মলয় ভৌমিক বলেন, শাহ্জাহান সিরাজ ছিলেন নির্ভিক এক ছাত্রনেতা। দাবি আদায়ে তিনি ছিলেন অনড়। নেতৃত্ব দেওয়ায় তার জুড়ি মেলা ছিল ভার। স্বৈরশাসকের পতন ঘটাতে সারাদেশ যখন উত্তাল, দেশ যখন জিম্মি, মানুষ যখন ঘর থেকে বের হতে পারত না, তখনি তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিকামী শিক্ষার্থীদের। 

স্বৈরশাসকের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে যতজন জীবন দিয়েছিলেন শাহ্জাহান সিরাজ তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ আমরা তার মতো বীর ছাত্রনেতাকে ভুলে গেছি। জানি না তার ইতিহাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তো বটে, এমন অনেক শিক্ষকও আছেন যারা চেনেন না শহীদ শাহ্জাহান সিরাজকে। শহীদ হওয়ার প্রথমের দিকে দু একবার তার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হলেও এখন আর হয় না। তার জীবনী নিয়ে হয় না কোনো সভা-সেমিনার। আর সবচেয়ে আক্ষেপের বিষয় তার সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত এমন কোনো প্রকাশনা বের করা হয়নি, যেখান থেকে আজকের ছাত্রনেতারা শিক্ষা নেবে।

তিনি আরো বলেন, আজকের ছাত্র রাজনীতি আর আগের মতো নেই। যার অন্যতম প্রধান কারণ আদর্শের অভাব। শাহ্জাহান সিরাজের মতো ছাত্রনেতাদের আদর্শ থেকে আজকের ছাত্র নেতার অনেকখানি অধপতন হয়েছে। তাতে আগামীতে দেশে আদর্শ নেতৃত্ব শূন্য হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। 

শাহ্জাহান সিরাজকে ভুলে না গিয়ে তার আদর্শের চর্চা করা উচিত। তার নামে রাস্তাঘাট, একাডেমিক ভবন না বানিয়ে তার স্মরণে সভা-সেমিনার করতে হবে, যাতে তার সম্পর্কে সবার মাঝে একটা সুস্পষ্ট ধারণা থাকে। তবেই হয়তো আগামীতে তার মতো দেশপ্রেমিক ছাত্রনেতা তৈরি হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

রাবি/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়