ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ফাঁস হচ্ছে তথ‌্য, ফেঁসে যাচ্ছি আমরা

নুর মোহাম্মদ শাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৪, ২৮ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৩:৫৫, ২৮ জানুয়ারি ২০২১
ফাঁস হচ্ছে তথ‌্য, ফেঁসে যাচ্ছি আমরা

একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। ছোটবেলায় মুরুব্বিদের কাছ থেকে শোনা। আপনারাও হয়তো শুনে থাকবেন। এক নতুন বিবাহিত বউ বাড়ির উঠানে হাঁটার সময় হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যায়। এমন সময় এক ভিক্ষুক বুড়ি বাড়িতে ভিক্ষার জন্য উপস্থিত হয়। তৎকালীন সময়ে এই কুসংস্কারটি ছিল যে, নতুন বউ পা পিছলে পড়ে যাওয়া বা অন্য কোনো উপায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া তা ওই বাড়ির জন্য অমঙ্গল বয়ে আনে। তাই বিষয়টি যাতে কেউ জানতে না পারে, তাই ওই নতুন বউ ভিক্ষুক বুড়িকে ভিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি আরো কিছু টাকা বকশিশ দিয়ে বললো, ‘বুড়িমা আমি যে পা পিছলে পড়ে গেছি এ কথা আর কাউকে বলো না। এই নাও বকশিশ।’ 

‘তুমি আর আমি বাদে কাক পক্ষীও এই কথা জানবে না’ এ কথা আশ্যস্ত করে বিদায় নিলো বুড়ি। তারপর বুড়ি অন্য বাড়িতে গেলো ভিক্ষার জন্য। ভিক্ষা নেওয়ার পাশাপাশি এই কথা বলে ‘ওই বাড়ির বউ আমাকে কিছু টাকা বকশিশ দিয়েছে আর বলেছে সে যে উঠানে পা পিছলে পড়ে গেছে, এই কথা যেন আর কাউকে না বলি। আমি ভাই কাউকে বলবো না।’ বুড়ি তারপর অন্য বাড়িতে গিয়েও এই রকম করলো। এভাবে চলতে চলতে গ্রামের সবাই একসময় জেনে গেলো অমুক বাড়ির বউ বাড়ির উঠানে পা পিছলে পড়ে গেছে।

বর্তমান এই অবাধ তথ্য-প্রযুক্তির যুগে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এবং প্রাত্যহিক ব্যবহৃত বিভিন্ন অ্যাপগুলো (যেমন- ফুড ডেলিভারি সার্ভিস, অনলাইন কেনা-কাটা ইত্যাদি) হলো গল্পের ওই বুড়ির মতো। তারা আমাদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে তথ্য নেয়, আবার আমরাও বুঝে না বুঝে আমাদের বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে শেয়ার করি। যা আমাদের তথ্যকে নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। এমন ঝুঁকি থেকে ঘটে বিভিন্ন সাইবার হয়রানির ঘটনা। যেমন- নিরাপত্তাহীনতা, ব্ল্যাকমেইল এবং আত্মহত্যার মতো ঘটনা, যা অহরহ ঘটছে আমাদের চারপাশে। 

এসমস্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে এবং ব্যক্তিগত তথ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে প্রতিবছর ২৮ জানুয়ারি “আন্তর্জাতিক তথ্য সুরক্ষা দিবস” (ডাটা প্রাউভেসি ডে) পালিত হয়। ডাটা প্রাইভেসি বা তথ্য সুরক্ষা বলতে বোঝায়, কারো ব্যক্তিগত তথ্যে অন্যের প্রবেশাধিকার নির্ধারণ করার ক্ষমতা। 

প্রতি বছরের মতো এ বছরও যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ও ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি অ্যালায়েন্সের (এনসিএসএ) যৌথ নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী এই ক্যাম্পেইন চলবে এবং এই ক্যাম্পেইনের অংশীদার হয়ে বাংলাদেশে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করবে সাইবার সচেতনতা নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিসিএ ফাউন্ডেশন)। এই বছর বাংলায় দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, “আপনার ব্যক্তিগত তথ্যের নিয়ন্ত্রণ করুন, গ্রাহকের তথ্য সুরক্ষায় যত্নবান হোন”। একদিনের সচেতনতার তুলনায় সপ্তাহব্যাপী কার্যক্রম অনেকাংশে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখতে সক্ষম। তাই তিনটি মূল থিমের উপর সপ্তাহব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনা করবে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন;

মূল থিম ১: তথ্য সংরক্ষণ করুন আপনার আস্থাশীল জায়গায়।
মূল থিম ২: তথ্যই ব্যবসা।
মূল থিম ৩: প্রাইভেসি সেটিংস এবং আপনি।

এই দিবসটির সূচনার ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৮১ সালে ইউরোপের বৃহৎ সংগঠন ‘কাউন্সিল অব ইউরোপ’-এ কনভেনশন ১০৮ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বিশ্বে প্রথম ডাটা প্রাইভেসি-ডে বা তথ্য সুরক্ষা দিবস উদযাপন শুরু হয়। ‘কনভেনশন ১০৮’ গোপনীয়তা ও তথ্য সুরক্ষা নিয়ে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা প্রতিপালনে আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। 

ব্যক্তিগত বা যে কোনো তথ্যের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেতন হওয়া উচিত। যখন কেউ আমাদের অসচেতনতার কারণে আমাদের তথ্য হ্যাক করে হাতিয়ে নেয় বা অন্য কোনো উপায়ে তথ্য সংগ্রহ করে তাদের ফায়দা লুফে নেয়, তখন আমাদের আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। তাছাড়া আমাদের তথ্যের মূল্য যে কত, তা আমরা নিজেরাও অনুধাবন করতে পারি না। ইউরোপীয় কমিশনের মতে, ২০২০ সালে তৈরিকৃত ব্যক্তিগত তথ্যের মূল্য প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার। 

এছাড়া ২০১৫ সালে কমকাস্ট নামক আমেরিকান প্রতিষ্ঠান তথ্য চুক্তি ভাঙার জন্য প্রতি ভিকটিমকে ১০০ ডলার করে দিয়েছে। আমাদের তথ্য অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে গুপ্তধনের মতো। কারণ, কেউ কারো মনের কথা জানার মেশিন এখনো আবিষ্কার হয়নি। ফলে বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যক্তির বিভিন্ন তথ্য বা কার্যক্রম শেয়ারই ওই ব্যক্তিকে বশে আনতে অনেকে গোপনে ব্যবহার করছে। 

বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩(খ) নম্বর অনুচ্ছেদে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা ও গোপনীয়তা মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। কিন্ত ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার আলাদা কোনো শক্তিশালী আইন নেই। তাই বাংলাদেশে শক্তিশালী তথ্য সুরক্ষা সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন এবং তার প্রয়োগ জরুরি। যেমন, সিঙ্গাপুরে এ সংক্রান্ত শক্তিশালী আইনের কারণে গুগল সিঙ্গাপুরের বাইরে কোনো তথ্য নিতে পারে না, এজন্য গুগল সিঙ্গাপুরে আলাদা সার্ভার বসিয়েছে। বর্তমানে সরকারি হিসাব মতে দেশে ইন্টানেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি। সময় থাকতে ব্যবহারকারীদের তথ্যের সঠিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে পরবর্তী সময়ে অপূরণীয় ক্ষতি হবে। লালন সাঁইজির মতে, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’। 

অতএব, আমাদের ইন্টারনেটে তথ্যের অবাধ ব্যবহারের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। আর ব্যক্তিগত গোপনীয়তার এবং সুনামের মূল্য টাকা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। সরকারের চেয়ে নিজেদের সচেতনতাই বেশি প্রভাব ফেলে সাইবার সুরক্ষার ক্ষেত্রে। তাই আমাদের এখন নতুন কোনো অ্যাপস ইনস্টল করতে গেলে বা নতুন করে কোনো সাইটে লগ ইন করতে গেলে যে ‘টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন’ দেখায়, তা পড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। 

কোথায় যাচ্ছি, কী খাচ্ছি, কী পছন্দ এসব তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার না করাই উত্তম আর শেয়ার করলে এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।  সর্বোপরি এটা বলা যায়, দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য বুঝতে হবে। অন্যথায় আপনার তথ্য আপনার কাল হয়ে দাঁড়াবে। 

লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। 

কুষ্টিয়া/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়