ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সফট লোন ও একটি জাম গাছের গল্প  

শাহরিয়ার সিফাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৯, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৪:৫৮, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সফট লোন ও একটি জাম গাছের গল্প  

বিশ্বে করোনার শুরু ও বর্তমান পরিস্থিতি আমরা সবাই জানি। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়েছে গত বছরের ৮ মার্চ। সেই হিসেবে এই ভাইরাস বাংলাদেশে আসতে সময় নিয়েছে প্রায় তিন মাস। এই তিন মাসের মধ্যে আমরা কি কেউ কল্পনা করতে পেরেছি, দেশের হর্তাকর্তারাও কি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ যদি এখানে ঘটে, তাহলে খেটে খাওয়া মানুষ ও প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থীর জীবন কোন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে পারে বা হলে এর প্রতিকার কী হবে?

সংক্রমণ ঠেকাতে গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১০ দিন সরকারি-বেসরকারি অফিসসহ সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ওষুধ বা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান ছাড়া সব ধরনের দোকানপাট ও গণপরিবহন বন্ধের ঘোষণা করে সরকার। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকলে ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে এই ছুটি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখার নিমিত্তে এক পর্যায়ে সীমিত পরিসরে সরকারি-বেসরকারি সব অফিস খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু এই মহামারিতে সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে খোলা সম্ভব হয়নি সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে এই ছুটি।

মহামারির এই সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা যাতে পড়ালেখা থেকে দূরে সরে না যায়, পড়ালেখার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে অনলাইন ক্লাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শর্তসাপেক্ষে ইউজিসি মার্চের শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অনলাইন ক্লাস নিতে পরামর্শ দেয়। ধীরে ধীরে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অনলাইনে ক্লাস নিতে শুরু করে। তবে এই অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা কার্যকর, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। 

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অধিকাংশ সচ্ছল পরিবারের। অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করার মতো ডিজিটাল ডিভাইস ও ইন্টারনেট সংযোগ থাকায়, তারা সহজেই এই অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারছে। কিন্তু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী অসচ্ছল, দরিদ্র পরিবারের। তাই অনেকের অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত হওয়ার মতো ডিজিটাল ডিভাইস নেই, নেই মেগাবাইট কিনে ক্লাস করার ক্ষমতা। অনলাইন ক্লাসের জন্য ডিজিটাল ডিভাইস থাকাই শেষ কথা নয়, অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন উচ্চগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট। অনেকের বাসা দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে হওয়ায় তারা এই সুবিধার বাইরে রয়ে গেছে। ফলে তারা অনলাইন ক্লাস করার সুযোগ থেকে হচ্ছে বঞ্চিত।

২৫ জুন ২০২০ তারিখে ইউজিসি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল ডিভাইস ও উচ্চগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধাসহ বিনামূল্যে ডাটা সরবারহের মাধ্যমে যাতে সব শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারে, সেই লক্ষ্যে উপাচার্যদের মতামতের ভিত্তিতে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠানো হয়।

৯ আগস্ট সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিকট স্মার্টফোন ক্রয়ে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের তালিকা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। এরই প্রেক্ষিতে ৪ নভেম্বর এক সভায় ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ের ৪১,৫০১ জন অসচ্ছল শিক্ষার্থীকে স্মার্টফোন ক্রয়ের জন্য ৮০০০ টাকা সুদবিহীন ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তালিকাভুক্ত শিক্ষার্থীদের অনলাইন সেবা আছে, এমন ব্যাংকে ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব খোলার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই ব্যাংকের হিসাব নম্বরসহ অনলাইনে আবেদন করতে বলা হয়।

সবকিছু ঠিক থাকলেও ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী ৩১ জানুয়ারি, ২০২১ এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের ব্যাংক হিসাবে ঋণ প্রদান করার কথা ছিল। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে, নির্দেশনার পর নির্দেশনা আসছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা তাদের সেই কাঙ্ক্ষিত ঋণের টাকা পায়নি। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ খাত, এই শিক্ষাখাতে একটা প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা এবং শিক্ষার্থীদের নেহাৎ হয়রানি করা অন্যায়ের শামিল। 

অন্যায়ের শামিল বলছি এই কারণে যে, ৮০০০ টাকার ঋণ নিতে শিক্ষার্থীকে ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব খুলতে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা খরচ করতে হয়েছে। এখন আবার শোনা যাচ্ছে, এই ঋণের টাকা পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে চেক নিতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঋণের তালিকাভুক্ত যাদের বাসা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০ কি.মি. থেকে ৩০০ কি.মি. দূরে কিংবা অন্যান্য দূরবর্তী অঞ্চলে, বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছাতে এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছাতে যাদের ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা খরচ হবে, তাদের জন্য এই ঋণ নেওয়াটা কতটা যৌক্তিক? আর এই ৮০০০ টাকা দিয়ে কি আদৌ অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করার মতো কোনো ভালো ডিজিটাল ডিভাইস ক্রয় করা সম্ভব? 

বিশ্ববিদ্যালয় খুব তাড়াতাড়ি হয়তো খুলে দেওয়া হবে। তখন এই অনলাইন ক্লাসের বালাই থাকবে না। তাই এই সময়ে এসে এই ঋণের টাকাটা কাজে লাগবে, নাকি ভবিষ্যতে বোঝার কারণ হয়ে দাঁড়াবে, এই ভাবনা এখন তাড়া করছে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের মনে।

পরিশেষে একটা গল্পের কথা বলছি, একরাতে প্রচণ্ড ঝড়ে সেক্রেটারিয়েট ভবনের লনের জাম গাছটা ভেঙে পড়েছে। সকালে মালী এসে দেখতে পান গাছের নিচে একজন লোক চাপা পড়ে আছে। মানুষটির কোমরের ওপর গাছটি পড়েছে। এই খবর নিয়ে মালী চাপরাশির কাছে গেলেন, চাপরাশি গেলেন কেরানির কাছে। মানুষটি তখনো বেঁচে আছে। একজন মালী চাপা পড়া মানুষটাকে উদ্ধার করতে চাইলেও সুপার অসম্মতি জানিয়ে বলে, আমি আন্ডার সেক্রেটারিকে জিজ্ঞাসা করে আসি। 

সুপার আন্ডার সেক্রেটারির কাছে গেলেন। আন্ডার সেক্রেটারি ডেপুটি সেক্রেটারির কাছে গেলেন। ডেপুটি সেক্রেটারি যুগ্ম সচিবের কাছে গেলেন। যুগ্ম সচিব গেলেন চিফ সেক্রেটারির কাছে আর চিফ সেক্রেটারি গেলেন মন্ত্রীর কাছে। মন্ত্রী চিফ সেক্রেটারিকে কিছু নির্দেশ দিলেন আর চিফ সেক্রেটারি যুগ্ম সচিবকে যুগ্ম সচিব উপ-সচিবকে আর উপ-সচিব আন্ডার সেক্রেটারিকে কিছু নির্দেশ দিলেন। এভাবে চলতেই থাকে। এই মন্ত্রণালয় থেকে ওই মন্ত্রণালয়, এই বিভাগ, ওই দপ্তর করতে করতে কয়েকদিন পর প্রধানমন্ত্রী গাছ কাটার হুকুম দেয়। কিন্তু সেক্রেটারি ফাইল নিয়ে এসে দেখে চাপা পড়া মানুষটি মারা গেছে।

জনপ্রিয় উর্দু লেখক কৃষণ চন্দর তার ‘জাম গাছ’ গল্পে এভাবেই একটা সরকারি অফিসের দীর্ঘসূত্রিতা সম্পর্কে তুলে ধরেন। এই জাম গাছ গল্পের গাছের নিচে চাপা পড়া নিরীহ মানুষটির জীবনের মতো যেন দীর্ঘসূত্রিতায় শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে না যায়। আমরা আশা করি, এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা আন্তরিক হবেন এবং এটাই হওয়া উচিত।

লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

দিনাজপুর/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়