ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

একটি বজ্র হুংকার, বাঙালি পেলো স্বাধিকার

অনন্য প্রতীক রাউত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৩, ৭ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১১:১৭, ৭ মার্চ ২০২১
একটি বজ্র হুংকার, বাঙালি পেলো স্বাধিকার

শোষণের জাঁতাকলে হাজার বছর ধরে পিষ্ট হওয়া জাতি বাঙালি। শোষণ, অন্যায় অবিচার কিংবা পরাধীনতার বিরুদ্ধে বাঙালিকে চূড়ান্ত অগ্নিপরীক্ষার পথ পরিক্রমায় যে ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে গিয়েছিল, তা ৭ মার্চের ভাষণ। বর্তমানে ইউনেস্কোর ঘোষণা অনুযায়ী এটি বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। তাই, বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য কিংবা মুক্তির ইতিহাসে অনবদ্য, অদ্বিতীয় এক নিদর্শন ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ।

৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের সেরা ভাষণগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে অভিহিত হয় সর্বদা। যার পেছনে রয়েছে উল্লেখযোগ্য অনেক কারণ। প্রথমত, ভাষণটি ছিল উদ্দীপনাময়, মুহূর্তেই সবাইকে নব চেতনায় এগিয়ে যেতে উৎসাহ জোগায়। নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ যার ফলশ্রুতিতেই হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, এই ভাষণের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ শোষণ থেকে একটি জাতিকে চিরমুক্তি দেওয়া। তৃতীয়ত, এ ভাষণটি ছিল বাঙ্গালির জন্য সর্বদা প্রেরণাদায়ী (৭ কোটি বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না)। চতুর্থত, ভাষণটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে শব্দশৈলী, শব্দচয়ন এবং গতিময়তার পরিচয় দিয়েছেন অলিখিত অবস্থায় তা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। ফলে নিউজ উইক পত্রিকা বঙ্গবন্ধুকে ‘poet of politics’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সর্বোপরি, স্বতস্ফূর্ত, হৃদয় নিহিত, অলিখিত (১৮ মিনিট -১১০৫টি শব্দ) ভাষণ ছিল বঙ্গবন্ধুর দেওয়া মুখনিঃসৃত অমৃত মুক্তির বাণী৷ স্বভাবতই, বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য অন্য সব বিশ্বনেতার ভাষণের চেয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পুরোপুরি আলাদা, অদ্বিতীয় এবং অবশ্যই শ্রেষ্ঠ।

তাৎপর্যগত দিক থেকে ঐতিহাসিক এই ভাষণের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, ভাষণটি ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা। পাক সরকারের রক্তচক্ষু, নানা চাপ, ভয়ভীতি দূর করে মঞ্চে বিশ্বজয়ে তৈরি হতে হয়েছিল শেখ মুজিবকে। পরিস্থিতির চাপে ভীতসন্ত্রস্ত পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সদর দপ্তর থেকে বিভিন্নভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে এই মেসেজ দেওয়া হয় যে, ৭ মার্চ যেন কোনোভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা না করা হয়। 

৭ মার্চ জনসভাকে কেন্দ্র করে কামান বসানো হয়। খোলা আকাশে সার্বক্ষণিক টহল দিতে থাকে হেলিকপ্টার। তবুও দমে যাননি বঙ্গবন্ধু! দিয়েছেন অসীম সাহসের চূড়ান্ত পরিচয়। মৃত্যুভয়কে করেননি পরোয়া। যতদূর জানা যায়, ৭ মার্চ ভাষণ দেওয়ার আগে চিন্তিত বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বলেছিলেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে তোমার মন-দিল-অন্তর থেকে যা আসে-তাই বলে দিও’। বাস্তবেও বঙ্গবন্ধু মনের কথা বলেছিলেন অবলীলায়- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তিনি সেদিন যুদ্ধের ঘোষণা যেমন পরোক্ষভাবে প্রদান করেন, আবার যুদ্ধে কীভাবে জয়ী হতে হবে, সে ব্যাপারেও বক্তব্য রাখেন। 

স্বাধীন রাষ্ট্রের বৈধ সরকারপ্রধানের মতো এক পর্যায়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ পরাধীন থেকেও মানসিকতার জোরে, অসীম সাহসিকতায় বঙ্গবন্ধু তখন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছিল। 

মুক্তিকামী জনতার মুক্তিকামী হওয়ার সময়োপযোগী এক সমাবেশ ছিল রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৭ মার্চের ভাষণ। আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিংদের ছাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তাই জায়গা করে নিয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে। ইউনেস্কো বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, গৌরবের এক উপহার দিয়েছে বাঙালি জাতিকে। ইউনেস্কোর প্রতি কৃতজ্ঞতা তাই প্রতিটি বাঙালির হৃদয় গহ্বরে থাকা উচিত। ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি দেওয়ার পেছনে ছিল যথেষ্ট সদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার আস্তরন।

জাতিসংঘের বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণাপত্র (১০ ডিসেম্বর, ১৯৪৮) এর সঙ্গে ৭ মার্চের ভাষণ যথেষ্ট সঙ্গতিপূর্ণ। বর্ণবৈষম্য, ঔপনিবেশবাদ, লিঙ্গবৈষম্য, শোষণমুক্তি, জাতিগত নিধন বন্ধের মতো বিষয়ে ৭ মার্চের ভাষণ মানবিকতার পরিচায়ক হয়ে উঠে। মহান মুক্তিযুদ্ধ কিংবা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রথম কোনো তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। যার প্রেরণার উৎস বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। অন্যান্য বিশ্বনেতার মতো বঙ্গবন্ধু শুধু বলার জন্য বলেননি বরং একটি দেশকে শকুনের থাবা থেকে রক্ষা করার সর্বোচ্চ দিকনির্দেশনা প্রদান করেন তিনি। ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তা নিয়েই প্রস্তুত হও, শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’। উপস্থিত জনতাকে নতুন উদ্যোমে জাগিয়ে তোলেন অধিকারের পক্ষে, শোষণের বিরুদ্ধে।

একটি বিষয় জানা দরকার, অধিকাংশ মানুষ কিংবা তখনকার বিশ্বনেতারা ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কিন্তু, বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদর্শী, অত্যন্ত বিচক্ষণ, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো একজন দক্ষ রাজনীতিক। বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণ সম্পর্কে মুজিব ছিলেন যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। কোনোভাবেই তিনি চাননি যে পাক সরকার তাঁকে বিশ্বের কাছে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসাবে উল্লেখ করুক। এতে করে অন্যান্য পরাশক্তির কাছে ন্যূনতম সাহায্য পাওয়া যাবে না, বঙ্গবন্ধু তা ভালোই জানতেন। যার অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু কৌশলের আশ্রয় নেন মাত্র। পরবর্তী সময়ে, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে আরেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু। যার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা অর্জনের জন্যই লড়াই করেছেন। 

পাক সরকার তাঁকে যে ১২টি কারণে গ্রেপ্তার করে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়া। তবুও বর্তমান সময়ের একদল অবিবেচক, স্বার্থানেষী মহল দেশে কিংবা দেশের বাইরে বসে প্রতিনিয়ত অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি বরং চেয়েছেন নেগোসিয়েশন।

প্রকৃতপক্ষে, ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের অগ্রিম প্রস্তুতির বিশেষ সংকলন। যা আমাদের এগিয়ে চলার প্রেরণা। সব অপশক্তি রুখে দেওয়া এবং দেশপ্রেমে মত্ত থাকাই এ ভাষণের মূল শিক্ষা৷ তরুণ প্রজন্মের উচিত এ ভাষণের মূল বিষয়বস্তুকে ধারণ করে এগিয়ে চলার স্বপ্ন দেখা। শতবর্ষে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই ৭ মার্চের কারিগর মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

জবি/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়