ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

নববর্ষে ষোল আনা বাঙালিয়ানা

অনন্য প্রতীক রাউত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২১, ১৪ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১৪:২৮, ১৪ এপ্রিল ২০২১
নববর্ষে ষোল আনা বাঙালিয়ানা

বাংলা বছরের প্রথম দিন নববর্ষ, তাই বাঙালির কাছে দিনটির বিশেষ গুরুত্ব বরাবরই। নতুন আমেজে পুরাতনকে ভুলে নতুন উদ্যোমে এগিয়ে চলাই এদিনের আদর্শ। বাঙালিয়ানাকে সঙ্গী করেই মূলত এদিনের কর্মকাণ্ড রচিত হয় নতুন মাত্রায়। প্রতিটি মানুষই চায় নিজস্ব সংস্কৃতির পোশাকে নিজেকে রাঙিয়ে মুখে পান্তা-ইলিশ-পোঁড়া মরিচের তৃপ্তিময় ঢেকুর তুলতে। 

বাঙালিয়ানা এমন এক স্বত্তা, যা অন্য জাতির তুলনায় আপনাকে স্বতন্ত্র করার জন্য পুরোপুরি যথেষ্ট। আমাদের দীর্ঘ সোনালী ইতিহাস-ঐতিহ্য বারবার সেদিকে ইঙ্গিত দেয়। ‘গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ’ কথাগুলো কোনোভাবেই রূপক নয়৷ এক সময় যথার্থ ছিল। সেসবকে সঙ্গী করে কৃষি বিপ্লব, সময়ের তালে তালে চলতে চলতে এক সময় শিল্প বিপ্লবও অসম্ভব ছিল না। কৃষিজ পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল কী ছিল না এ বাংলার? সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি যতই বাংলায় হানা দিয়েছে, ততই দেখেছে ব্যবসায়িক সাফল্য। আমাদের অসতর্কতা, বিভিন্ন শাসকবর্গের অদূরদর্শীতা এবং ভীরুতার জন্য বারবারই সুযোগ পেয়েছে পর্তুগিজ থেকে ব্রিটিশরা। সুযোগগুলো লুফে নিতেও বিন্দুমাত্র ভুল করেনি তারা কেউ। 

সংস্কৃতি, ঐতিহ্য কিংবা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা তাই ছিল বরাবরই চ্যালেঞ্জিং। নিজ অস্তিত্ব বা সংস্কৃতির দিকে ঝোঁক তো দূরে থাক, আমরা আরও তাদের দেখানো পথে ‘তোতাপাখি’র ন্যায় চলতে শুরু করেছি। ফলে সহজেই আজকের অবস্থা দৃশ্যায়ন হয়েছে। আমরা যদি বর্তমানের অন্যতম পরাশক্তি চীনের কথা ভাবি, দেখুন তাদের এবং আমাদের ইতিহাসে বা সম্পদের সমৃদ্ধির দিক থেকে খুব একটা পার্থক্য নেই। উপনিবেশের কবলে থাকলেও তারা নিজ সংস্কৃতি এবং কর্মক্ষমতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। এক প্রকারের জেদ তাদের নিয়ে গেছে অসীম এক উচ্চতায়। অথচ, আমাদের অবস্থা দেখুন। দিন দিন পরিণত হচ্ছি তথাকথিত আধুনিকতার দাস হিসেবে। আধুনিকতার প্রয়োজনে অবশ্যই সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে, তবে সেটার অর্থ নিজ অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে নয়।

ইতিহাসের চোখে দেখার পর এবার একটু বর্তমান বাস্তবতায় দেখি আসুন। এখনকার সময়ে পহেলা বৈশাখ এবং পরবর্তী সময়ের বাঙালিয়ানার সমস্যা আসলে কোথায়? মূলত আমরা দিনকেন্দ্রিক বেশীরভাগ কর্মকাণ্ডে অভ্যস্ত। সংশ্লিষ্ট দিনে অতি মাত্রায় থাকে আবেগ। দিনের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে আচরণ হয় ভিন্ন, বিশেষ দিনটিকে বিশেষভাবে দেখার পর যাই চিরচেনা রূপে ফিরে। ঘোরাঘুরি, মঙ্গলশোভা যাত্রা, বৈশাখী মেলা উপভোগ বেশ প্রথাগতভাবেই হয়ে আসছে আমাদের প্রতিটি নববর্ষে। সবার দিনলিপিতে খুব একটা ভিন্নতা সাধারণত দেখা যায় না। কিন্তু, ঠিক ১৫ এপ্রিল থেকেই দৃশ্যপট যায় বদলে। স্যুটেড-বুটেড হয়ে অফিসে যাওয়া, কফির কাপে চুমুক, চাইনিজের স্বাদে নিজেকে আধুনিক ভাবা রক্তে মিশে যাই অজান্তেই। 

সাংস্কৃতিক বাস্তবতাতেও আসে ব্যাপক পরিবর্তন। আজকাল বাংলা সিনেমা বা কিছু বিশেষ নাটক বাদ দিলে তেমন একটা ভালো নির্মাণ দেখা যায় না৷ তরুণ প্রজন্ম তাই বিনোদনের খোরাক মেটাতে অনায়েশে ঝোঁকেন ভিনদেশি সংস্কৃতিতে। ফলাফলটাও ভোগ করে জাতি সরাসরি। নানা দুরাবস্থা হয় তরুণদের সঙ্গী, কেননা সমাজব্যবস্থার ভিন্নবস্থা হুট করেই তো ভিন্নধর্মী সমাজে প্রয়োগ করা যায় না৷ এতে সৃষ্টি হয় পূর্ববতী প্রজন্মের সঙ্গে নানা মানসিক দূরত্ব। এমনকি নির্মাতারাও তরুণ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে ভিন্ন সংস্কৃতির ধারাকে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের তথাকথিত নির্মাণে। 

জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে স্বভাবতই তারা নানা অশ্লীল, ভিন্নমাত্রার দৃশ্য যুক্ত করে দেন তথাকথিত ওয়েব সিরিজ বা নাটকে। এমনকি, চরিত্রগুলোর পোশাকেও থাকে ভিন্নধারার সাংস্কৃতিক প্রভাব৷ এক প্রজন্মের কাছে যা হয় রোমাঞ্চকর অন্যদিকে পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছে তা হয়ে ওঠে অসহনীয়। এমতাবস্থায় প্রজন্মের দূরত্ব বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব দুরাবস্থা অনেক বড় বড় অপরাধের জন্ম দিচ্ছে৷ পত্র-পত্রিকা ও নানা সমীক্ষায় চোখ রাখলে দেখা যাবে, শিশু-কিশোরদের অপরাধ দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এটা অবশ্যই ভরাবহ বিষয়। লাগাম টেনে এখনই না ধরলে এ দায় কে নেবে?

সর্বোপরি, সংস্কৃতিকে বাঁচাতে এখনই সময় ওঠে দাঁড়াবার। নয়তো দিনকেন্দ্রিক এ নববর্ষও একদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ থাকবে শুধু ইতিহাসের পাতায়। সুতরাং, ষোল আনা বাঙালিয়ানার বিকল্প কোথায়? তবে এর মানে কখনোই আধুনিকতাকে বিসর্জন দেওয়া নয়। প্রয়োজন দু’দিককার বাস্তবিক বা সময়োপযোগী এক মিশেল। নতুন বছরের শুভেচ্ছা, সমৃদ্ধি আসুক বাঙালির প্রতিটি পদক্ষেপে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

জবি/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়