ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

যেভাবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠলো চীন

মো. আখতরুজ্জামান তানভীর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৯, ২৮ জানুয়ারি ২০২৩   আপডেট: ১৭:০০, ২৮ জানুয়ারি ২০২৩
যেভাবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠলো চীন

অর্থনীতির হিসেবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ চীন। কিন্তু ১৯৮০ সালের আগে চীন এতটা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী দেশ ছিল না। আশির দশকের আগে চীন ছিল অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে একটি। দেশটি অতটা সমৃদ্ধশালী ও ছিল না এবং তাদের অর্থনীতি এতটা উন্নত ও ছিল না। কিন্তু গত ৩০ থেকে ৩৫ বছরে চীন এমন কি করেছিল যাতে তারা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক রাষ্ট্রে পরিণত হলো?

বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৮১ থেকে ২০১২ সময়কালের মধ্যে চীন ৮০০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৮০ কোটি মানুষ যারা দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করত তাদেরকে দারিদ্র সীমা থেকে বের করে এনেছে। ১৯৮১ সালে যে দেশটির দারিদ্রতার হার ৮১ শতাংশ ছিল সে দেশটি কিভাবে ২০১২ সালে ৬.৮ শতাংশ নিয়ে চলে এলো? এমনকি ২০১২ থেকে ২০১৮ এই ছয় বছরে দেশটির দারিদ্রতার হার আরো ছয় শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ ২০১৮ সালে দেশটির দারিদ্রতার হার ২ শতাংশ!

চীন শুধুমাত্র নিজের দেশের দারিদ্রতা দূর করেনি বরং অনেকগুলো সূচকে চীন সারা পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বর্তমানে পৃথিবীর বিদ্যুৎ চাহিদার ২৫ শতাংশ চীন একাই উৎপাদন করছে। হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি অর্থাৎ জলবিদ্যুৎ উৎপাদনেও চীন সবার উপরে। আপনি শুনে অবাক হবেন যে, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ব্রাজিল যারা চীনের তুলনায় ৫০ শতাংশ অর্থাৎ অর্ধেক জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে। কয়লা উৎপাদনেও পৃথিবীর বৃহত্তম দেশটির নাম চীন। সমগ্র বিশ্বের ৫০ শতাংশ কয়লা চীন একাই উৎপাদন করছে। স্মার্টফোন ইন্ডাস্ট্রির ৪৮ শতাংশ চীনাদের দখলে। সমগ্র পৃথিবীতে যে পরিমাণ স্মার্টফোন উৎপাদন হয় তার ৭০ ভাগই চীনাদের দখলে। পৃথিবীর ৫০ শতাংশ স্টিল চীন উৎপাদন করে। পৃথিবীর ৩৫ শতাংশ আপেল চীন উৎপাদন করে। যেখানে আপেল উৎপাদনে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশটির নাম যুক্তরাষ্ট্র যারা শুধুমাত্র ৬ শতাংশ আপেল উৎপাদন করে। পৃথিবীর ৬০ শতাংশ সিমেন্ট চীন উৎপাদন করে। এর কারণ হলো ২০১১ থেকে ২০১৩ এই তিন বছরে চীন যে পরিমাণ সিমেন্ট ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র ওই পরিমাণ সিমেন্ট সারা বিশ্ব থেকেও আমদানি করতে পারেনি। অর্থাৎ এই তিন বছরে চীন যে পরিমাণ ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করেছে সেই পরিমাণ ইনফ্রাস্ট্রাকচার যুক্তরাষ্ট্র ১৯০১ থেকে ২০০১ এই ১০০ বছরেও তৈরি করতে পারেনি। সোনা উৎপাদনে চীনারা সবার উপরে। তাবৎ দুনিয়ার ১৩ শতাংশ সোনা চীন উৎপাদন করে। 

এ সকল তথ্য থেকে ধারণা করা যায় চীনারা পৃথিবীতে যা কিছুই উৎপাদন করুক না কেন তারা সেটা অনেক বড় স্কেলে তৈরি করে, যার কারণে বিশ্বের অন্য কোনো দেশ অর্থনৈতিকভাবে তাদের সঙ্গে পেরে উঠে না৷ পৃথিবীর ৭০ শতাংশ খেলনা তৈরি করে চীন যেখানে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশটির নাম যুক্তরাষ্ট্র, যারা শুধুমাত্র দুই শতাংশ খেলনা তৈরি করে! সামুদ্রিক জাহাজ বানানোর ইন্ডাস্ট্রির চল্লিশ শতাংশ চীনের দখলে। অর্থনীতির যে সূচকেই চীনাদের অংশগ্রহণ রয়েছে সেখানে তারা পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। প্রতিটি পণ্য এতটাই বড় পরিসরে উৎপাদিত হচ্ছে যে বাকি পৃথিবীর কোনো দেশ তাদের সঙ্গে মোকাবেলা করতে পারছে না। ধরা যাক বহির্বিশ্বে জনপ্রিয় কোনো পণ্যের মূল্য ১০০ টাকা। চীনারা সেটিকে এত পরিমাণে উৎপাদন করবে সেটার মূল্য কমতে কমতে অর্ধেকের কাছে চলে যায়! এসব কারণেই কোনো চাইনিজ কোম্পানি ভিন্ন কোনো দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গেলে ওই দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে! কারণ অন্য দেশ পণ্যের এই নিম্নমুখী মূল্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে না। সেজন্য ধীরে ধীরে চীনারা পৃথিবীর সকল মার্কেট দখল করার চেষ্টা করছে। ১৯৯০ সালে যেখানে বৈশ্বিক বাজারে চীনা পণ্যের পরিমাণ ছিল ৩ শতাংশ সেটা আজ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ শতাংশে। অর্থাৎ রপ্তানিতেও পৃথিবীর এক নম্বর দেশটির নাম চীন। 

সুতরাং আগের প্রশ্নটাই যদি আবার করি গত ৩০ বছরে চীন কিভাবে এতটা উন্নতি করল? উত্তরটা কিছুটা সরল ও বলা যায়, তারা সর্বপ্রথম নিজেদের ইনফ্রাস্ট্রাকচার বিল্ডিং এ নজর দেয়। পৃথিবীর সর্বাধুনিক সুবিধা সম্বলিত হাইওয়ে, ফ্লাইওভার, ব্রিজ চীনাদের রয়েছে। আর ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুতের ব্যবস্থা তো রয়েছেই! কারণ তারা বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যেটা ব্যবসায়িক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটিই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চীনকে সব থেকে বেশি সাহায্য করেছে। যদি বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করি তাহলে বাংলাদেশের না আছে ভালো রাস্তাঘাট না আছে ভালো ফ্লাইওভার, ব্রিজ, না আছে বিদ্যুতের স্বয়ংসম্পূর্ণতা! তার উপর বিদ্যুতের দামও বাংলাদেশে অনেক বেশি। যদি কোনো দেশের ইন্ডাস্ট্রির বিদ্যুতের স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য বিকল্প বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, আমদানিকৃত বিদ্যুৎ, জেনারেটর ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল থাকতে হয় এবং পরিবহন ব্যবস্থাও অতটা সমৃদ্ধিশালী নয়, সেখানে বড় পরিসরে বিনিয়োগ করার চিন্তা করাটা আকাশ-কুসুম কল্পনা মাত্র। কারণ ক্রেতা সব সময় বেশি দাম দিয়ে পণ্য কেনার চিন্তা করবে না যতই দেশপ্রেম থাকুক। আর এইসব কারণেই গ্রাহকের কাছে পণ্য তাড়াতাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য চীন পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতির পরিবহনব্যবস্থা তৈরি করেছে। 

কিন্তু চীনারা শুধুমাত্র ইনফ্রাস্ট্রাকচারে উন্নতির কারণে এতটা এগোতে পেরেছে তেমনটা নয়। বরঞ্চ বিনিয়োগকারীদেরকেও তাদের দেশে বিনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে দক্ষ জনশক্তি দিয়ে। এই মুহূর্তে চীনাদের ৭৮৬ মিলিয়ন অর্থাৎ ৭৮ কোটিরও বেশি দক্ষ জনশক্তি রয়েছে। জনশক্তি তো বাংলাদেশেরও রয়েছে এবং সেটা চীনাদের থেকে অনেক সস্তায়ও পাওয়া যায় কিন্তু তারা কি চীনাদের মতো দক্ষ? উত্তরটা স্বাভাবিকভাবেই, না। কারণ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষ জনশক্তি তৈরির উপর ততটা ফোকাস করে না। ১৯৮০ থেকে চীনারা শিক্ষাব্যবস্থায় দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য কারিগরি শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশেও কিছু পরিমাণ দক্ষ জনশক্তি রয়েছে কিন্তু তারা আট ঘণ্টায় যে কাজ যে পরিমাণ কাজ করতে পারে সেটা চীনের দক্ষ জনশক্তির করতে অর্ধেকেরও কম সময় লাগে! সম্ভবত এটাই একমাত্র কারণ যে পৃথিবীর সকল বড় বড় কোম্পানি তাদের পণ্য চীনে উৎপাদন করতে চায়। আমরা স্বপ্ন দেখি একদিন বাংলাদেশও বৈশ্বিক অর্থনীতির রোল মডেলে পরিণত হবে, চীনের সফলতার গল্পকে পুঁজি করে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের শিখরে। 

লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

/ফিরোজ/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়