ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

পোশাকে হ্যান্ড পেইন্টিংয়ের কথাচিত্র

সালাউদ্দিন আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২২, ২৫ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৪:২৩, ২৫ জানুয়ারি ২০২১
পোশাকে হ্যান্ড পেইন্টিংয়ের কথাচিত্র

নিজস্ব অভিজ্ঞতা, ভালো লাগা, মনের রূপ, রঙ, শব্দ ও অনুভূতিগুলোকে অন্যের মনে দাগ কাটে। চোখে ভালো লাগা বা মন্দ লাগা সঞ্চারণের মাধ্যমে পরিচয়বোধের সঞ্চার ঘটায়, তাকে শিল্প বলে। সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে এ দক্ষতাকে শিল্প বলা হলেও শিল্পর বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। যেমন-ললিতকলা, চারুকলা ও কারুশিল্প ইত্যাদি।

নান্দনিক বা সৌন্দর্যের উদ্দেশে রচিত শিল্প, ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে নয়, তাকে ললিতকলা বলে। এর মধ্যে রয়েছে রঙচিত্র, রেখাচিত্র, ভাস্কর্য, ছাপচিত্র ইত্যাদি। রঙচিত্র হলো রঙ দিয়ে হাতের আঙুলের মাধ্যমে প্রাচীন আমলে আঁকা হতো। তখন রঙ ছিল ফলের রস, ছাল, গাছের আঠা ও পানি। রঙ বা চিত্র আঁকা হতো পাথরে, পাতায় ও পশুর চামড়াতে।

কাপড় তৈরির অনেক আগে মানুষের শরীরে পেইন্ট করার প্রচলন ছিল। তখন গুটিকয়েক রঙ দিয়ে শরীরের নানা ধরনের চিত্র আঁকা হতো। পরবর্তী সময়ে কাপড়ের আবিষ্কার হলে কাপড়ে রঙ করার প্রচলন সৃষ্টি হয়। মধ্যপ্রাচ্যে কাপড়ের রঙ করার প্রচলন তিন হাজার বছরের পুরনো।

এশিয়ার মধ্যে ভারতবর্ষে দেবদেবীর চিত্রকর্ম থেকে প্রভাবিত হয়ে কাপড়ে চিত্রকর্ম আঁকার প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের পর সেগুলো ইউরোপ ও আফ্রিকায় রপ্তানি শুরু হয়।

প্রায় দুই হাজার বছর আগে হ্যান রাজত্বকালে চীনে হ্যান্ড পেইন্টিংয়ের প্রচলন শুরু হয়। তার আগে থেকেই চিনে ব্লক প্রিন্টের প্রচলন ছিল। রেশম বা মসলিন কাপড়ে হ্যান্ড পেইন্টের খুবই সমাদর ছিল সেসময়। তবে চীনাদের পোশাকে শুধু কালো রঙের ক্যালিগ্রাফি পেইন্ট করা হতো। চীনাদের থেকে জাপানিরা হ্যান্ড পেইন্টের কৌশল আয়ত্ব করে। জাপানিদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক কিমোনোতে হ্যান্ড পেইন্টের প্রচলন রয়েছে।

আমেরিকাতে আশির দশকে সেলিব্রেটি শিল্পীদের পোশাকে হ্যান্ড পেইন্ট করে বিখ্যাত হন শিল্পী ব্যারন। পরে তিনি হ্যান্ড পেইন্ট পোশাকের একটি কারখানা তৈরি করেন। যুক্তরাজ্যে পোশাকে হ্যান্ড পেইন্টকে জনপ্রিয় করে তোলেন তরুণ শিল্পী হলি ফওলার্স। সেসময় তার পোশাক মানুষের মাঝে এক ধরনের ইল্যুশন তৈরি করে। ফ্রান্সেও হ্যান্ডপ্রিন্টের জোয়ার লাগে তখন। ফ্রান্সে লেদার হ্যান্ড পেইন্ট বেশ জনপ্রিয়।

মিশরের সভ্যতায় রেখাচিত্র বিভিন্ন আকৃতিতে এক সাথে প্রলেপ করে রঙ করা হতো। রোমান বা গ্রিক শিল্প দিয়ে  প্রভাবিত হয়ে তৈরি করে পোম্পেই হাকুলিয়ান। ধীরে ধীরে চিত্রকর্ম কাঠ, কংক্রিট, দেয়াল থেকে কাপড়ে আসে। কাপড় আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ শরীরে আঁকত। তাকে উল্কিচিত্র বর্তমানে বলা হয় ট্যাটু। তা বিভিন্ন মোহর পুড়িয়ে ছাপ দেওয়া বা ছুরি ধারালো বস্তু দিয়ে শরীরে দেবদেবীর চিত্র আঁকা হতো। কাপড় আবিষ্কারের পর প্রথম দিকে তা যেভাবে বোনা হতো, তাই জড়ানো হলেও পরবর্তী সময়ে তা রঙিন করা হতো রঙে চুবিয়ে। তবে আর্ট আসে বহু পরে, মধ্যপ্রাচ্যে কাপড়ে রঙ করার প্রচলন তিনহাজার বছর পূর্ব থেকে শুরু।

প্রায় ২ হাজার বছর পূর্বে এশিয়ার চীনে হ্যান রাজত্বকালে হাতে আঁকা পোশাকের শুরু হয়। তার আগে থেকে যদিও ব্লক প্রিন্ট করা হতো, তবে তখন শুধু কালো রঙের ক্যালিওগ্রাফি করা হতো।

চীন থেকে জাপানিরা হ্যান্ড পেইন্টিং শিখে তারা তাদের কিমোনোতে হাতে আঁকত। তবে ধারণা করা হয়, ভারতবর্ষের দেবদেবীর চিত্রকর্ম থেকে হাতে আঁকা পোশাকের চিত্রকর্ম শুরু হয়। পরে গ্রিকবীর আলেকজেন্ডারের আক্রমণের পর তা ইউরোপ আমেরিকায় যায়। আমেরিকায় আশির দশকে শিল্পীদের পোশাকে হ্যান্ড পেইন্ট করে আলোচিত হন শিল্পী ব্যারন। যুক্তরাজ্যে হাতে আঁকা পোশাকে জনপ্রিয় করে তোলেন হলিফওলাস। তার পর ফ্রান্সের জোয়ার আসে। তবে বাংলাদেশে হাতে আঁকা পোশাকের ক্ষেত্রে অবদান রাখেন প্রয়াত শাহরুখ শাহীদ।

হাতে আঁকা পোশাক, আঁকা আর ক্যানভাসে আঁকা খানিকটা ভিন্ন। তবে চিত্রকর্মের ক্ষেত্রে কাগজের জন্য জল রঙ, ব্যানার বা পোস্টারের জন্য পোস্টার কালার, ক্যানভাসের জন্য এক্রেলিক কালার আছে। তেমনি পোশাকে আঁকার জন্য আালদা রঙ আছে। এই রঙগুলো বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়া দিয়ে তৈরি। বাজারে হ্যান্ড পেইন্টের নানারকম রেডিমেড রঙ পাওয়া যায়। যেমন ফেব্রিকলি এক্রেলিক কালার। তবে যারা প্রফেশনালি হাতে আঁকা পোশাক নিয়ে কাজ করে তারা রঙ বানিয়ে নেয় নানা রকম উপাদান দিয়ে। পোশাকে আঁকার জন্য ফ্রেম পাওয়া যায় বাজারে। তাছাড়া ফ্রেমগুলো অর্ডার দিয়ে তৈরি করে নেওয়া হয় প্রয়োজন মতো।

হাতে আঁকা পোশাকে প্রাকৃতিক বিভিন্ন দৃশ্য, ফুল, পাখি, নানা রকম বিষয়বস্তু নিয়ে আঁকা হয়। তবে এখন হুইপ আর্ট, রেখাচিত্র, ক্যালিওগ্রাফি, ডুডলিংআলপোনা, মানডালা, লোকচিত্র, রিকশাপেইন্ট, বিমূর্ত চিত্র, পটচিত্র ইত্যাদি মোটিফে তুলে ধরা হয়।

হাতে আঁকা পোশাক তৈরিতে সময়সাপেক্ষ যদিও, তবে তা নির্ভর করে ফ্রেব্রিক্স ও ডিজাইনের উপর। বর্তমানে হ্যান্ডলুমে হাতে আঁকা পোশাক খুব জনপ্রিয়। জামদানি মসলিন, সিল্ক, মটকা, তাত, টিসু, সুতি, খেশ, খাদি কাপড়ে হাতে আঁকা হয়। তা দিয়ে নানা রকম বৈচিত্র্যময় পোশাক তৈরি করা হয়। যেমন- কূর্তি কামিজ, থ্রিপিস, শাড়ি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বেবিড্রেস। তাছাড়া ঘরের বিছানার চাদর থেকে শুরু করে টেবিল ম্যাট, চেয়ার কভার কুশন কভার, পর্দায়ও আঁকা হয়।

হাতে আঁকা বলে এগুলো সুক্ষ্ম কাজ হয়ে থাকে। এর ব্যবহার ও যত্ন একটু ভিন্ন। এগুলো একটু দামের দিক থেকে এক্সপেনসিভও বটে। তবে বাজারে পাওয়া মোটা ব্রাশের কেনরকম মোটিভ তোলা পেইন্টগুলো কমদামে পাওয়া যায়। তবে সুক্ষ্মভাবে একটা গোলাপকে প্রাণবন্ত কাপড়ে ফুটিয়ে তোলা চিত্রগুলো খানিকটা ভিন্নও বটে।

হাতে আঁকা পোশাক তৈরির পর কতগুলো ধাপ আছে, তা আঁকার পর রঙ শুকানো হয় কয়েক ধাপে। হাতে আঁকা পোশাক ব্যবহারের পর কাপড় ভেদে এগুলোর যত্নটা আলাদা। পোশাকটি ব্যবহারের পর ফ্যানের বাতাসে মেলে রাখা। আঁটসাঁট করে না রাখা। আলমারিতে রাখার ক্ষেত্রে নিউজ পেপার দিয়ে ভাজ করে রাখা। মাঝে মাঝে উল্টো করে রোদে দেওয়া।

ধোয়ার ক্ষেত্রে শ্যাম্পু জলে ২-৩ মিনিট ভিজিয়ে হালকা হাতে ধুয়ে ফেলা। ধোয়ার পর একদম করা রোদে নয়, তাতে রঙ জ্বলে যাবে। মোটামুটি ভালোই রোদ আসে, সেখানে উল্টো করে মেলে শুকানোর পর উল্টো পিঠে আয়রন করা। বেশি ভালো হয় ড্রাই ওয়াশ করালে।

লেখক: স্বত্বাধিকারী, বিডিম্যানগ্রোভ ডটকম।

ঢাকা/সিনথিয়া/মাহি  

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়