ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ভুল চিকিৎসা: আইনি প্রতিকার কী?

সাঈদ আহসান খালিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৩, ১৭ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভুল চিকিৎসা: আইনি প্রতিকার কী?

ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ বাংলাদেশে নতুন নয়। এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে প্রায়শই চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রোগীর স্বজনদের বাদানুবাদ, ভাঙচুর এবং উভয়পক্ষে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার খবর পাওয়া যায়।

চিকিৎসায় অবহেলা কী?

চিকিৎসায় অবহেলা বলতে শুধু চিকিৎসকের অবহেলা নয় বরং চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা যেমন- নার্স, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদন ও সরবরাহকারীদের অবহেলাও বুঝানো হয়। চিকিৎসায় অবহেলার দায়ে কাউকে অভিযুক্ত করতে চাইলে প্রথমত প্রমাণ করতে হবে যে, রোগী এবং চিকিৎসাসেবা প্রদানকারীর মধ্যে এমন একটি চুক্তি হয়েছিল যার মাধ্যমে রোগীর প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেওয়া ও যত্ন নেওয়ার একটি আইনি দায়িত্ব চিকিৎসক বা চিকিৎসাসেবা প্রদানকারীর ছিল। দ্বিতীয়ত যদি সেই দায়িত্ব পালনে চিকিৎসক বা চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী অবহেলা করে বা ব্যর্থ হয়। তৃতীয়ত দায়িত্ব পালনে অবহেলা বা ব্যর্থতার কারণে উক্ত রোগী যদি ক্ষতির শিকার হয় বা মৃত্যুবরণ করে।

আইনে কী প্রতিকার রয়েছে?

ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং আইনগত প্রতিকারের জন্য এখনো বাংলাদেশে একক কোনো আইন কার্যকর নেই। বাংলাদেশে ২০১৬ সালে ‘রোগী এবং স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইন’ নামে একটি আইন প্রস্তাব করে সরকার। কিন্তু এই আইনটি এখনো কার্যকর হয়নি। তবে বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত আইনে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে আইনি প্রতিকারের সুযোগ রয়েছে:

সাংবিধানিক প্রতিকার: সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক চাহিদার মধ্যে ‘স্বাস্থ্য’ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৮ অনুচ্ছেদে জনগণের পুষ্টিমান এবং ‘গণ-স্বাস্থ্য’ সুরক্ষার কথা সন্নিবেশিত হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩২-এ বর্ণিত ‘জীবন রক্ষার অধিকার’ একটি সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত এবং আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য। চিকিৎসায় অবহেলা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যর্থতা এই জীবন রক্ষার মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করে। তাই চিকিৎসায় অবহেলা হলে সর্বোচ্চ আদালতে রিট বা জনস্বার্থে মামলা করার সুযোগ আছে।

ফৌজদারি প্রতিকার: ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধি বাংলাদেশের প্রধান ফৌজদারি আইন। দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারানুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি বেপরোয়া বা অবহেলামূলক কাজের মাধ্যমে কারো মৃত্যু ঘটায় তাহলে সেটি ৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। দণ্ডবিধির ৩১২ থেকে ৩১৪ ধারায় ডাক্তারি প্রয়োজন ব্যতীত গর্ভপাত ঘটানো একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। দণ্ডবিধির ২৭৪, ২৭৫ ও ২৭৬ ধারায় যথাক্রমে ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জামে ভেজাল মেশানো, ভেজাল ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম বিক্রি এবং এক ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম অন্য নামে বিক্রি করা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য। এসব অপরাধ দমন ও আইনি প্রতিকার প্রদানের উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালের ভ্রাম্যমান আদালত আইনের মাধ্যমে নিয়মিত ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হয় এবং শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে একই দণ্ডবিধির ৯২ ধারানুসারে সরল বিশ্বাসে কোনো ব্যক্তির উপকার করার উদ্দেশ্যে চিকিৎসক চিকিৎসাসেবা প্রদান করলে এবং এর ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না।

দেওয়ানি প্রতিকার: ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির ১৯ ধারা অনুসারে কারো অবহেলাজনিত কাজের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি স্থানীয় দেওয়ানি আদালতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দেওয়ানি মামলা দায়ের করতে পারেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ অনুসারে কোনো রোগী ফি-এর বিনিময়ে ডাক্তার, হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সেবা গ্রহণ করলে তিনি ‘ভোক্তা’ হিসেবে গণ্য হবেন এবং চিকিৎসা  সংক্রান্ত অবহেলার শিকার হলে ভোক্তা অধিকার আইনে ক্ষতিপূরণ চেয়ে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার যদি রোগ নির্ণয়ে ভুল বা অবহেলা করে যার ফলে রোগী ক্ষতিগ্রস্থ হয় কিংবা যদি সেবা প্রদানে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করে তাহলে ভোক্তা অধিকার আইনে মামলা করা যাবে। এই আইন অনুসারে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযোগকারী আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রাপ্য হবেন।

প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিকার: চিকিৎসক এবং চিকিৎসাসেবার মান নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রণীত মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ অনুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি। কোনো চিকিৎসকের বা স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের অবহেলার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় অবস্থিত বিএমডিসি-তে অভিযোগ করা যায়। মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ এর ধারা-২৩ অনুসারে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল করার ক্ষমতা বিএমডিসি’র রয়েছে। উপরোক্ত আইনগুলো ছাড়াও আরো কিছু আইনে চিকিৎসা ও ওষুধ সংক্রান্ত অপরাধের প্রতিকারের বিধান আছে যেমন- ড্র্যাগস অ্যাক্ট, ফার্মাসি অর্ডিন্যান্স, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক প্র্যাক্টিশনার্স অর্ডিন্যান্স, মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯, নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন আইন ইত্যাদি।

চিকিৎসায় অবহেলাকে আইনি কাঠামোর আওতায় আনার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ, একক এবং স্বতন্ত্র আইনের প্রয়োজনীয়তা সবাই অনুভব করছেন। চিকিৎসাশাস্ত্র একটি টেকনিক্যাল বিষয় এবং চিকিৎসাপ্রদানে আসলেই কোনো ভুল বা অবহেলা হয়েছে কিনা সেটি নির্ধারণ করাও একটি জটিল প্রক্রিয়া, যেখানে বিশেষায়িত জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা রোগীর স্বজনদের অন্যায় আক্রমণ ও সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনে রোগী এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তি উভয়ের স্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চিকিৎসায় অবহেলা প্রতিরোধ এবং রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের আইনি সুরক্ষা দ্রুত নিশ্চিতকল্পে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনের দ্রুত বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।



ঢাকা/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়