আশির দশকের বিনোদন
ছবি: সংগৃহীত
আশির দশকে বেশির ভাগ গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। ফলে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের মাধ্যমে যেসব বিনোদন পাওয়া যায় সেগুলোও গ্রামে ছিল না বললেই চলে। সে সময় বিনোদনের অনেক বড় মাধ্যম ছিল রেডিও। যাকে বলা যায় অভিজাত বিনোদন মাধ্যম। কারও বাড়িতে একটি রেডিও থাকা মানে, তখন অনেক বড় ব্যাপার। ফিলিসপ, মারফি, সিটিজেন এই ব্রান্ডগুলোর রেডিও তখন জনপ্রিয় ছিল। রেডিও সবার বাড়িতে থাকতো না। বিশেষ অবস্থাসম্পন্ন বাড়িতে রেডিও থাকতো। ওই বাড়ির আশপাশের সবাই একত্রিত হয়ে রেডিওর অনুষ্ঠান উপভোগ করতো।
রেডিওতে নানারকম অনুষ্ঠান হতো। বিশেষ আকর্ষণ ছিল বিজ্ঞাপন তরঙ্গ বা বিভিন্ন স্পন্সড অনুষ্ঠান। সেগুলো ছায়াছবির তিনটি গান দিয়ে সাজানো হতো। যেমন হাঁস মার্কা নারিকেল তেল ‘গানের দোলা’। সে সময় রেডিওতে ছায়ছবির ওপরে ট্রেইলারজাতীয়- দশ পনেরো মিনিটের একটি অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হতো।
রেডিওর আরেকটি শ্রোতাপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল অনুরোধের আসর হতো ‘গানের ডালি’। ওই অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের পছন্দের গান শোনানো হতো। শ্রোতারা প্রিয় গান শুনতে চেয়ে চিঠি লিখতো গানের ডালিতে।
এ ছাড়াও রেডিওতে প্রচারিত হতো ‘সৈনিকদের ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান দুর্বার’ এটি উপস্থাপনা করতের হাবিবুর রহমান জালাল। এই অনুষ্ঠানটির জন্য সবাই অপেক্ষা করতো।
যাত্রাপালার একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
রেডিওতে প্রচারিত হতো ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘উত্তরণ’। সে সময় বিপুল জনপ্রিয় ছিল এই অুনষ্ঠান। বিভিন্ন ধরণের সমসাময়িক বিষয় উত্তরণ অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করা হতো। এটি জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ ছিলো উপস্থাপক সফি কামালের অসাধারণ উপস্থাপনা।
এ ছাড়া গ্রামে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে খেলাধুলা একটি বড় অংশ ছিল। তখন, হাডুডু, ফুটবল এবং ভলিবল -এই খেলাগুলো ছিল। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই এই তিনটি খেলার একটি করে দল থাকতো।
তখনও গ্রাম পর্যায়ে ক্রিকেট খেলা সেভাবে পৌঁছায় নাই। ফুটবল, ভলিবল, ও হাডুডু ছিল গ্রাম পর্যায়ে সবচেয়ে বড় খেলা। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা ডাংগুলি, মারবেল, খাপ খেলা, সাত চারা খেলতো। মেয়েরা ছি বুড়ি, কিতকিত, দড়িয়াবান্ধা খেলতো।
বর্ষা ঋতুতে সব বয়সের মানুষের কাছে উপভোগ্য ছিল নৌকা বাইচ। ছিপ নৌকা ব্যবহৃত হতো নৌকা বাইচের জন্য। হেমন্তে ফসল কাটার পরে ঘোড়দৌড় এবং গরুদৌড় অনুষ্ঠিত হতো।
শীতকালে গ্রামের বিভিন্ন সংগঠন বা ক্লাবগুলোর আয়োজনে নাটকের আসর বসতো। এসব নাটক অনেক সময় স্থানীয় ছেলেরাই করতো। মঞ্চের পাশে বসে একজন প্রমটার স্ক্রিপ্ট পড়ত, শুনে শুনে অভিনেতারা মঞ্চে অভিনয় করত। তখনতো মেয়ে মানুষ অভিনয়ে তেমন পাওয়া যেত না, নাটকের প্রয়োজনে ছেলেরাই মেয়ে সাজতো। কখনও কখনও এক রাত আবার কখনও কখনও এক থেকে তিন রাত পরযন্ত নাটক হতো।
সে সময় শীতকালে পালাগানের আসর বসতো। স্থানীয় অনেকেই গাইতে পারতো। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে শিল্পীদের ভাড়া করে আনা হতো। ময়মনসিংহ গীতিকা, মলুয়া এই রকম পালাগুলো পরিবেশিত হতো। এই আসর বসতো ক্লাবের উদ্যোগে। স্থানীয়দের অর্থায়নে এসব অনুষ্ঠান হতো। পালাগানের আসরে পালাকাররা একটু উঁচু জায়গায় বসে বা দাঁড়িয়ে পালা পরিবেশন করতো। মঞ্চের চারপাশে সামনে দর্শকরা নিজ দায়িত্বে বসার ব্যবস্থা করে নিত। কেউ খড় বিছিয়ে বা পাটি বিছিয়ে অথবা পিঁড়ি পেতে বসার ব্যবস্থা করতো। পালাগানের আসর বেশির ভাগ সময় এটা উন্মুক্ত জায়গায় হতো। তবে কখনও কখনও স্কুলঘরের ভেতরেও হতো।
কবিগান ছিলো বিনোদনের আরেকটা মাধ্যম। তাৎক্ষণিক স্বরচিত কবিতা বিতর্কের মতো পরিবেশন হতো। যেমন নারী-পুরুষ, লোহা-সোনা এগুলো কোনটা বেশি ভালো- এই নিয়ে চলতো কবিতায় কবিতায় লড়াই।
কোনো কোনো গ্রামে যাত্রা হতো। সম্পন্ন গৃহস্থ বা ক্লাব যাত্রাপালার আয়োজন করতো। কিন্তু যাত্রা দেখতে হতো দর্শনীর বিনিময়ে। চারপাশ টিন দিয়ে ঘিরে একটি মাত্র দরজা রাখা হতো দর্শকের ঢোকার জন্য। যাত্রাপালার মঞ্চের চারপাশে দর্শকরা খড় বিছিয়ে বসতো।
গ্রামের বিয়েকে কেন্দ্র করে মানুষ আনন্দের উপলক্ষ খুঁজে পেত। বিশেষ করে মেয়ের বিয়েতে সবাই সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করতো। তারা স্বতঃস্ফুরতভাবে গেইট বানানো থেকে শুরু করে অতিথি বরণ, সমাদর এবং বিদায় দেওয়া-সবকিছুতেই গ্রামের মানুষ সাহায্য করতো।
নারীরা বিয়ের গীত গাইতো। প্রায় সব গ্রামেই তখন ছিল, বিয়ে বাড়িতে গিয়ে পান খেতো এবং গীত গাইতো। আবার অনেক সময় বিয়ে বাড়িতে অনেক সং সেজে উপস্থিত হতো। বিভিন্ন ধরণের কর্মকাণ্ড করে মানুষকে আনন্দ দিত।
আশির দশকের দিকে মানুষের সে কি অভাব। অর্থকষ্ট- প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করা মানুষগুলো যে বিনোদনের উপায় খুঁজে পেতো সেটাই বিষ্ময়কর। বলা যায় মানুষের বিনোদন ছিলো জীবনযাত্রা নির্বাহের সমান্তরালে।
ঢাকা/লিপি