রওশন জাহান সাথীর মুক্তিসংগ্রাম
শরীরে লুকিয়ে রেখেছিলেন গোপন নথি
লিনু হক || রাইজিংবিডি.কম
মুক্তিযোদ্ধা রওশন জাহান সাথী
জীবন এখন শেষ বেলায়, পেছনে ফিরে তাকালে কত ছবি ভেসে আসে! কত মানুষ আর তাদের কত রকমের সংগ্রাম! আরও কত স্মৃতি বিস্মরণের অতলে হারিয়ে গেছে, তার ঠিক নেই। মুক্তিযুদ্ধের সাথে আমার আবেগ, সত্তা, অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে। আজ আমি ৭০ উত্তীর্ণ, কোষগ্রন্ধি ক্ষয়ে এসেছে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ আমার জীবনে অতীত হয় না।
রওশন জাহান সাথী কাছ থেকে দেখা এক মুক্তিযোদ্ধা। তিনি উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন, সত্তরের নির্বাচিত সংসদ সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন। মাতা বেগম নুরুন্নাহার। রওশন জাহান সাথীর জন্ম ৮ মে ১৯৫১ সালে যশোর জেলায়।
স্কুলজীবন থেকে পারিবারিক সূত্রে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন সাথী। যশোর জেলায় ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনে নেতৃবৃন্দের সহযোগী হিসাবে ভূমিকা রাখেন। হয়ে ওঠেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য’। সাথী মাগুরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, যশোর ঘুরে ঘুরে ছাত্রীদের সংগঠিত করতেন। হেনস্তার শিকার হলেও দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াননি।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে রওশন জাহান সাথীদের যশোরের বাড়িতে পাক আর্মি দুইবার রেড দিয়েছিল। বাড়ি তল্লাশি করেছিল। পাক-বাহিনীর ধারণা ছিল আগরতলা মামলার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল তাদের ঘরে আছে। সত্যিই ছিল, সেই গোপন ফাইল রওশন জাহান সাথী শরীরে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
ওই ঘটনার পর তিনি হয়ে উঠেছিলেন আরও অদম্য। একাত্তরে আবু জাহিদ পাকিস্তান এয়ারফোর্সে কর্মরত ছিলেন।অবকাশ যাপনে এসে সাথীকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন আবু জাহিদ। তার আগেই বন্দুক চালাবার প্রথম শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন বাবা মোশাররফ হোসেনের কাছে। তাদের দোতলা বাড়ির বারান্দা থেকে নিশানা ঠিক করে চোখের পাতার সাথে মিলিয়ে ট্রিগার টেপা ও বন্দুক কাঁধে রাখার বিষয়টি কত গুরুত্বপূর্ণ তা বাবা তাকে শিখিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যশোর জেলায় পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে, বিভিন্ন নেতা, এমপি, এমএনএ এবং ছাত্র নেতাদের বাড়িতে হামলা হয়। সাথী ঘটনা বুঝতে পেরে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তারপরেও পাক বাহিনী রওশন আরা সাথীদের বাড়িতে হামলা চালায়। কয়েকদিন বিভিন্ন স্থানে থেকে মামার বাড়িতে আশ্রয় নেন সাথী। অন্যদিকে তার বাবা অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন স্থানীয় অনেককে নিয়ে ভারত চলে যান। মামা বাড়ি গিয়েও রেহাই পাননি সাথী।
যশোর সেনানিবাস থেকে কর্নেল তোফায়েলের নেতৃত্বে পাঁচ-ছয়টি গাড়ি নিয়ে পাক বাহিনী বাড়িটি ঘিরে ফেলে। রওশন জাহান সাথীকে গ্রেপ্তার করে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়, সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয় তার মা, খালাকেও। পাকসেনারা তাদের অস্ত্রের মুখে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং অশ্লীল ইঙ্গিত দেয়। উত্তাল মার্চের মিছিলের ছবি দেখিয়ে বলে, ‘তোমরা পাকিস্তান ভাঙতে চাচ্ছো, তোমাদের শাস্তি পেতে হবে।’
সাথী তখনও অদম্য। কোনো তথ্যই দেননি। বরং বলেছেন, ‘আমি মিছিল করেছি, আর কোনো তথ্য জানি না।’ কর্নেল তোফায়েল রাতে তাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সেনা পাহারায়, বাড়িতে বন্দী করে রাখে। মামার বাড়িতে সেনা পাহারায় বন্দী থাকার চার-পাঁচদিন পরে এক সকালে সাথী দেখতে পান তাদের বাড়িতে পাহারারত পাকসেনা নেই। তিনি জানতে পারেন জরুরি বৈঠকে সব পাকসেনাকে যশোর সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই সুযোগে বাড়ি থেকে বের হয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তারা।
শুরুতে বেশ কিছুদিন বিভিন্ন গ্রামে পালিয়ে থাকার পর বেনাপোল সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করেন। এমনই একদিন সীমান্তের দিকে যাওয়ার পথে সেনানিবাস থেকে অগ্রসর হওয়া পাকিস্তানি সেনা ভ্যানের দূর থেকে নজর পড়ে তাদের দিকে। ব্যক্তিগত গাড়ি দেখে গুলি শুরু করে। চাচাত ভাই মাসুকুর রহমান তেজো গাড়ি চালাচ্ছিলেন। গুলি এসে লাগে গাড়ির চাকায়, গাড়িটি পাক খেয়ে গ্রান্ডট্রাঙ্ক রোডের বড় গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে যশোর চৌগাছার মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে এসে তাদের উদ্ধার করে বেনাপোল সীমান্ত পার করে দেয়।
ভারত পৌঁছে বনগাঁ কোরিডোর অফিসের মাধ্যমে শরণার্থী শিবিরে কাজ শুরু করেন সাথী। এই কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন মুক্তি আসার আগ পর্যন্ত।
ঢাকা/তারা//