ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

থেঁতলানো শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছে ফারজানা

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৪০, ২৬ জানুয়ারি ২০২২   আপডেট: ২২:৫০, ২৬ জানুয়ারি ২০২২
থেঁতলানো শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছে ফারজানা

নির্যাতনের শিকার ফারজানা

ফারজানার জন্ম গরিবের ঘরে। তাই অন্যের বাসায় কাজ করে খেতে হবে এটাই যেন নিয়তি। সইতে হবে নির্যাতন, অবহেলা আর কটাক্ষ। ফারজানা যে বাসায় কাজ করতো সেই গৃহকর্ত্রী এমনভাবে নির্যাতন চালিয়েছে, যে তার সারা শরীর থেঁতলে গেছে। যন্ত্রণায় কাতরালে নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যেত। 

১৫ বছরের ফারজানাকে দেখে মনে হবে রোগে শোকে কাতর বয়স্ক কোনো নারী। ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে হরহামেশা মারধর করা হতো। বাথরুমে আটকে, ঠান্ডা এবং গরম পানি ঢালা হতো শরীরে। মারধরের পর ক্ষতস্থানে মরিচ লাগিয়ে দিতো। শরীরের চামড়া থেঁতলে কালচে হয়ে গেছে। তবু থামেনি গৃহকর্ত্রী সামিয়া ইউসুফ ওরফে সুমির নির্মম নির্যাতন।

১৫ জানুয়ারি নির্যাতন সইতে না পেরে ফারজানা অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় কেটে যায় দুদিন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় গৃহকর্ত্রী ভয় পেয়ে ১৭ জানুয়ারি ফারজানার বাবাকে ফোন দেয়। এরপর ফারজানার বাবা-মা এসে তাকে উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফারজানা।

এদিকে ফারজানাকে গুরুতর জখম করার অভিযোগ এনে তার বাবা বিল্লাল হোসেন ভূইয়া কলাবাগান থানায় ২০ জানুয়ারি মামলা দায়ের করেন। এরপর ওই গৃহকর্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত ২১ জানুয়ারি সামিয়াকে আদালতে হাজির করে তিন দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। কিন্তু ওইদিন সামিয়ার ভাই ফারজানার বাবা বিল্লাল হোসেনকে আদালতে নিয়ে যান। সেখানে তারা একটি হলফনামায় স্বাক্ষর করিয়ে নেন। 

সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘ভুল তথ্যের ভিত্তিতে আমি (বিল্লাল হোসেন) মামলা করেছি। নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আসামি কোনো অপরাধমূলক কাজ করেনি। আমি পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, এটা ছিল দুর্ঘটনা। আসামি জামিন পেলে আমার আপত্তি নেই।’

সেদিন বিল্লাল হোসেন আদালতকেও বলেন, ‘আমার মেয়েকে নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে। সমস্ত শরীরে আঘাতে চিহ্ন রয়েছে। আমার মামলা চলবে। তবে আসামি জামিন পেলে পাক।’

ওইদিন আদালত সামিয়ার রিমান্ড ও জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

২৪ জানুয়ারি ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ ছিদ্দিকীর আদালতে সামিয়ার পক্ষে তার আইনজীবী জামিন আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জামিনের বিরোধীতা করা হয়। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত আদেশে বলেন, ‘আসামি জামিন পেলে বাদির আপত্তি নাই। এক হাজার টাকা বন্ডে জামিন মঞ্জুর করা হলো।’

এ বিষয়ে মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) রাতে ফারজানার পরিবারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তার মা জোসনা বেগম ফোন ধরেন। তখন তিনি হাসপাতালে মেয়ের পাশেই ছিলেন। 

জোসনা বেগম বলেন, ‘আমার মেয়েকে এমনভাবে নির্যাতন করা হয়েছে যা দেখা যায় না। ওর শরীর থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। নির্যাতনে ওর পেটে সমস্যা, লিভার, লাঞ্চ, কিডনিতে সমস্যা হয়ে গেছে। খাবার হজম হচ্ছে না। আমার মেয়ের সাথে যে এমন অন্যায় করছে, নির্যাতন করছে তার সঠিক বিচার চাই। কঠিন সাজা চাই।’

বিল্লাল হোসেনের অনাপত্তিতে সামিয়া জামিন পেয়েছে বিষয়টি জানালে জোসনা বেগম বলেন, ‘সোমবার তারা আমার স্বামীকে আদালতে নিয়ে কি করেছে তা তিনি বলতে পারেন না। তবে এমন নির্যাতনকারীর জামিন বাতিলের আবেদন করছি। সরকার যেন বিষয়টা দেখে। তার যেন জামিন বাতিল করে।’

হলফনামার বিষয়টি বিল্লাল হোসেনকে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘সামিয়ার ভাই আমাকে আদালতে নিয়ে যায়। তারপর বলে একটা কাগজে নাম লিখতে। আমি নাম লিখে দেই। জানতে চাই, কেন নাম লিখতে বললেন। তারা আমাকে আর কিছু বলেনি। কাগজে এমন কথা লেখা ছিল জানলে সই করতাম না।’

আপোস না বিচার কোনটা চান? এমন প্রশ্নে ফারজানার বাবা-মা বলেন, ‘সাত বছর ধরে মেয়েকে নির্মম নির্যাতন করছে। টাকা পয়সা চাই না। সঠিক বিচার চাই।’

এ বিষয়ে কলাবাগান থানার আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা শরীফ সাফায়েত হোসেন বলেন, ‘২১ জানুয়ারি সামিয়া ইউসুফের তিন দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে হাজির করে পুলিশ। কিন্তু ওইদিন এ মামলার বাদি আসামির জামিন হলে আপত্তি নেই মর্মে একটি হলফনামা দেন। ওইদিন আদালত আসামির রিমান্ড নামঞ্জুর করে কারাগার পাঠান। ২৪ জানুয়ারি আসামিপক্ষ জামিন আবেদন করে। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জামিনের বিরোধীতা করি। বিজ্ঞ আদালত সবকিছু বিবেচনা করে আসামির জামিন মঞ্জুর করেন।’

আসামিপক্ষের আইনজীবী সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘এ মামলার বাদি প্রথম দিন আদালতে এসে বলেছেন, ‘জামিন দিলে তার আপত্তি নেই। আর আসামির বিরুদ্ধে যে ধারার অভিযোগ করা হয়েছে এতেও কিছু তারতম্য আছে। এজাহারে বলা হয়েছে আগুন দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়ার কথা। কিন্তু মেডিক‌্যাল রিপোর্ট বলছে, তার সিস্টের সমস্যা আছে। ৩২৩, ৩২৪ ধারা জামিনযোগ্য। আর ৩২৬ ধারা মারাত্মক জখমের। মারাত্মক জখমের তো একটা ম্যাটার থাকতে হবে। সবকিছু বিবেচনা করে আদালত আসামির জামিন মঞ্জুর করেন।’

এদিক মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ফারজানাকে ২০১৫ সালে মাসিক তিন হাজার টাকার বিনিময়ে সামিয়ার বাসায় কাজে দেয় পরিবার। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় ফারজানা পরিবারকে জানায়, সামিয়া তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। মারধর করে এবং খাবার দেয় না। 

গত ১৭ জনুয়ারি সামিয়া ফোনে ফারজানার বাবাকে জানায়, তার মেয়ে খুব অসুস্থ। এরপর ওইদিনই স্ত্রী জোসনা বেগমকে (৩৫) নিয়ে বিল্লাল হোসেন ওই বাসায় গিয়ে ফারজানাকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পান। মেয়েকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান তিনি। 

কিছুটা সুস্থ হলে ফারজানা তাকে জানান, কাজে যোগদান করার পর থেকেই সামিয়া ফারজানাকে বিভিন্ন তুচ্ছ কারণে মারধর করতো। পেটের দায়ে সে সব অত্যাচার নীরবে সহ্য করে আসছিল। গত ১৫ জানুয়ারি ঘর গোছানো ও বাসন-পত্র ভেঙ্গে ফেলার মিথ্যা অভিযোগে এবং কাজে দেরি হওয়ার তুচ্ছ অজুহাতে সামিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে ফারজানাকে লাঠি নিয়ে এলোপাথাড়ি মারপিট শুরু করে। এক পর্যায়ে খুন্তি গরম করে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছ্যাকা দেয়। এতে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে পুড়ে গিয়ে মারাত্মক জখম হয়।

ঢাকা/সনি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়