ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পঞ্চগড়ের পথে পথে উন্নয়ন 

আবু নাঈম, পঞ্চগড় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৪, ৩ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৮:১৭, ৩ নভেম্বর ২০২১

১৪০৪ দশমিক ৬৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পঞ্চগড় জেলা বিগত একযুগ আগেও সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নড়বড়ে। উচ্চশিক্ষার জন্য কলেজ থাকলেও উচ্চতর ডিগ্রিতে পড়ার ব্যবস্থা ছিল না। কৃষি ছিল এখানকার মানুষের প্রধান পেশা। নিম্ন আয়ের লোকজন নদীতে পাথর বালি উত্তোলন আর দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সাধারণ মানুষের বিরাট অংশ ছিলো অসচ্ছল। 

সময়ের পরিবর্তনে শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবকিছুতেই এসেছে আমূল পরিবর্তন। বদলে গেছে জেলার দৃশ্যপট। পরিচিতি পেয়েছে একটি সচ্ছল জেলা হিসেবে। এক কথায় গত একযুগ ধরে দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে, তা থেকে পিছিয়ে নেই পঞ্চগড়ও। 

সমতলের চা চাষ জেলাকে দেশে নতুন করে পরিচিত করে তুলেছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বেসরকারি উদ্যোগে এখানে চা চাষে ঘটেছে নীরব বিপ্লব। প্রতি বছর ১ কোটি কেজি উন্নতমানের চা উৎপাদিত হচ্ছে এখানে। যা ইতোমধ্যে দেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার দখল করেছে। এছাড়া জেলায় দুটি পাটকল, বৈদ্যুতিক খুঁটির কারখানা, রেলের স্লিপার তৈরির কারখানা, ১৭টি চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাসহ একাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। এতে জেলায় কয়েক হাজার বেকার শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।  নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়ায় কমেছে বেকারত্বের হার।

মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়ার লক্ষ্যে জেলা শহরসহ জেলার পাঁচ উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ৪০০ সিসি ক্যামেরা স্থাপন হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখছে পুলিশ। এছাড়াও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন, নার্সিং ইনস্টিটিউট, কারিগরি প্রশিক্ষণ একাডেমি, মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয় ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয় নির্মাণ, বোদা ফায়ার সার্ভিস অফিস, আটোয়ারী ফায়ার সার্ভিস অফিস, বোদা পৌরসভা ভবন, পাওয়ার গ্রিড স্টেশন, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর রেস্ট হাউস, করতোয়া নদীর তীরে সোনার বাংলা পার্ক, ব্যক্তিমালিকানাধীন বিনোদন পার্ক এবং জেলা পরিষদের অর্থায়নে ডাকবাংলো নির্মাণ, পিকনিক কর্নারের উন্নয়ন ও পর্যটকদের জন্য মহানন্দা নদীর তীরে ওয়াক ওয়ে স্থাপন করা হয়েছে। 

জেলার স্কুল-কলেজে আধুনিক ভবন নির্মাণসহ একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং অনেক প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। পঞ্চগড় সদর হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করতে ভবন নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। 

আরও পড়ুন-একযুগে নতুন রূপে ধানের জেলা দিনাজপুর 

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই জেলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নেওয়া হয়েছে অনেক মেগা প্রকল্প। এর মধ্যে ৮৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ১১৭ দশমিক ৪৬ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর আরও ৪৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৮৪ দশমিক ৭০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া ৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ২১০ মিটার ব্রিজ ও কালভার্টের কাজ শেষ হয়েছে। আরও ১৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ২১৬ মিটার ব্রিজের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া জেলার ৩১৭ কিলোমিটার সড়ক মেরামতে ৯৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

১০৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে বিলুপ্ত ছিটমহলে পাকা সড়ক, কমিউনিটি সেন্টার, খাল পুনঃখননসহ ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণ করা হয়েছে। ১০০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ৯৯ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার সড়ক মেরামত কাজ চলমান রয়েছে এবং একই সঙ্গে সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পঞ্চগড় এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামছুজ্জামান।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্য বলছে, সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্প-২ এর আওতায় এই সরকারের আমলে পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া-বাংলাবান্ধা জাতীয় মহাসড়ক এবং বোদা-দেবীগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক উন্নয়নের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।  সরকার এবং এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে ৫৩ দশমিক ১০ কিলোমিটার পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা জাতীয় মহাসড়কটির নির্মাণ ব্যয় হয় ১৮৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এছাড়াও ২৬ দশমিক ৩০ কিলোমিটার বোদা-দেবীগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কটির নির্মাণ ব্যয় হয় ৮৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।

আধুনিক মানের রেলপথ

পঞ্চগড় বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম স্টেশন থেকে পার্বতীপুর ১৩২ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথটি ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হয়েছে। এর আগে এটি কোনো রকমে চলছিল। প্রতিদিন পার্বতীপুর থেকে পঞ্চগড় একটি লোকাল ট্রেন চললেও রেলপথের করুণ অবস্থায় সেটিও লাইনচ্যুত হয়ে দিনের পর দিন চলাচল বন্ধ থাকত। বর্তমান  সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রেলপথেও এসেছে অভাবনীয় সফলতা। রেলপথ উন্নয়নের পাশাপাশি বর্তমানে পঞ্চগড়-ঢাকা রেলপথে তিনটি ও পঞ্চগড়-রাজশাহী রেলপথে একটি আধুনিক মানের আন্তঃনগর ট্রেন নিয়মিত চলাচল করছে। একই সঙ্গে একটি কমিউটার ট্রেন নিয়মিত চলাচল করছে। পঞ্চগড় বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম স্টেশনকে আধুনিকায়ন করতে উন্নয়নমূলক কাজসহ প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে।

পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা রেলপথ প্রকল্প

পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর পর্যন্ত ৪৭ কিলোমিটার রেলপথ সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথে জগদল, ভজনপুর, তেঁতুলিয়া, তিরনইহাট ও বাংলাবান্ধায় স্টেশন নির্মাণ করা হবে। সেই সঙ্গে চারটি ব্রিজ ও ১৪টি কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। তার আগে ৮৬০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে সম্ভাব্য সম্প্রসারিত এ রেলপথের সমীক্ষা ও নকশার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ রেলপথটি চালু হলে জেলায় ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। এতে অর্থনীতির দৃশ্যপট একেবারে পাল্টে যাবে। একই সঙ্গে ভারতের শিলিগুড়ির সঙ্গে রেলপথ যোগাযোগ আরও সহজতর হবে। পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ হলে চার দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের দুয়ার খুলে যাবে।

এ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, রেল যোগাযোগের সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এবং সারাদেশে রেলপথকে ঢেলে সাজাতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে ট্রেন যোগাযোগ আরও আধুনিক করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। 

তিনি বলেন, পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারিত করা হলে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণসহ বহুমাত্রিক সফলতা অর্জন সম্ভব হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড 

নদ-নদী ও পরিবেশ রক্ষায় জেলার ৫টি নদী ও একটি খাল খনন করার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে এরই মধ্যে ৪টি নদী ও একটি খাল খননের কাজ শেষ হয়েছে। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পানিসম্পদের সুষম বণ্টন, সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনায় নদী তীরবর্তী মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও পানির চাহিদা পূরণ এবং টেকসই উন্নয়ন, ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনরুজ্জীবিত করায় কৃষি ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

বাফার সার গুদাম

বোদা উপজেলার ময়দানদিঘী ইউপির আরাজী গাইঘাটা এলাকায় ১০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন বাফার সারের গুদাম নির্মাণ করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের মাঝে ইউরিয়া সার সরবরাহ ও নিরাপদ মজুত নিশ্চিতকরণে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন এই গুদামটি নির্মাণ করে। প্রায় ৪ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই গুদামটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২৭ কোটি ৪৯ লাখ ৫৩ হাজার টাকা।

আলু বীজ সংরক্ষণাগার

স্থানীয় কৃষকদের উন্নতমানের বীজ আলু সরবরাহের জন্য পঞ্চগড় শহরের ধাক্কামারা এলাকায় পুরনো বিএডিসি গোডাউনের পাশে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ হাজার টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি হিমাগার নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও সদর উপজেলায় সরকারিভাবে ৩৫০ একর জমিতে উন্নত জাতের আলু বীজ খামার স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন।

পঞ্চগড় পৌরসভা

পঞ্চগড় পৌরসভা কার্যালয়ের সামনে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বহুতল বিশিষ্ট পৌর মার্কেটের কাজ এবং ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে পঞ্চগড় পৌরসভার ময়লা আবর্জনা উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিশোধন করার জন্য স্যানেটারি ল্যান্ডফিল্ড প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে পৌরসভা এলাকার ৬টি বস্তি উন্নয়নের কাজও চলমান রয়েছে। পৌর মেয়র জাকিয়া খাতুন বলেন, প্রথম শ্রেণির পৌরসভার জন্য যেসব নাগরিক সুবিধা প্রয়োজন তা পর্যায়ক্রমে করা হবে।

বিলুপ্ত ছিটমহলের উন্নয়ন 

ঐতিহাসিক ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির আওতায় ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে জেলার ৩৬টি ছিটমহলের মানুষ এদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ছিটমহল সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৭৪ সালে ইন্দ্রিরা-মুজিব চুক্তি হলেও কোনো সরকারই বিষয়টি গুরুত্ব না দেওয়ায় সেখানে বসবাসরতরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করেছে। ২০১৪ সালে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালে এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘বিশ্ব মানবতা রক্ষায়’ ছিটমহল বিনিময় বিষয়ে বোঝাতে সক্ষম হন। ফলে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই ঐতিহাসিক এইদিনে তারা পেয়েছে স্বাধীনতার সুখ। দীর্ঘ ৬৮ বছরের বঞ্চনার শিকার বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষের ঘরে ঘরে জ্বলছে এখন বৈদ্যুতিক বাতি। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে একাধিক সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চাষের জমির সেই সরু পথ এখন পাকা সড়কে রূপান্তরিত হয়েছে। সেখানে থাকা মানুষের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গৃহহীনদের জন্য তৈরি করা হয়েছে আধুনিক মানের আধাপাকা ঘর।

দেবীগঞ্জে অর্থনৈতিক অঞ্চল

দেবীগঞ্জ উপজেলার দেবীডুবা ও সোনাহার ইউনিয়নে প্রস্তাবিত ৬০২ দশমিক ৪২ একর জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে খাস খতিয়ানভুক্ত ২১৭ দশমিক ৭৮ একর জমি ৯৯ বছরের জন্য লিজ গ্রহণ করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ। 

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ হাতে নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে দেবীগঞ্জেও গড়ে তোলা হবে অর্থনৈতিক অঞ্চল। এতে ১০ হাজার দক্ষ-অদক্ষ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, খাদ্যপণ্য, গার্মেন্টস, সাইকেল-মোটরসাইকেল উৎপাদনসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করা হবে। এতে জেলার শিল্প বিকাশের পাশাপাশি আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে। সেইসঙ্গে পঞ্চগড় জেলায় উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যও নিশ্চিত হবে।

বদলে গেছে ২৪১৬ পরিবারের জীবন 

কেউ থাকত অন্যের বাড়িতে আবার কেউ অন্যের জায়গায় বা খাসজমিতে। তাদের ছিল না কোনো স্থায়ী ঠিকানা। জেলায় এমন দুই হাজার ৪১৬টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ঘর দেওয়া হয়েছে। এসব ঘর পেয়ে বদলে গেছে সুবিধাভোগীদের জীবনমান। এই সুবিধার আওতায় এসেছে ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী ও বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীরাও। মুজিবশতবর্ষ উপলক্ষে পঞ্চগড়ের পাঁচ উপজেলায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় ২০২০-২১ অর্থবছরে এই ঘরগুলো করা হয়। প্রত্যেকটি ঘরে ব্যয় হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। 

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহারের এই ঘরগুলো পেয়ে হাসি ফুটেছে একসময়ের ছিন্নমূল, আশ্রয়হীন এবং দুর্ভোগ পোহানো মানুষের। মানবেতর জীবনযাপন থেকে মুক্তি পেয়ে এখন তারা নিরাপদ, টেকসই ও মজবুত পাকা ঘরে পরিবার পরিজন নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছেন।

মুজিবশতবর্ষ উপলক্ষে নির্মাণকৃত পঞ্চগড়ে দুই হাজার ৪১৬টি ঘরের মধ্যে বিলুপ্ত সিটমহলবাসীদের মধ্যে পেয়েছে ১৩০টি পরিবার এবং ১২০টি ঘর পেয়েছে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী পরিবার। অবশিষ্ট ঘরগুলো পেয়েছে ভূমিহীন ও গৃহহীন অসহায় পরিবারগুলো।

জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহারের এই ঘরগুলো স্ব-স্ব উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের মাধ্যমে ঘরের চাবি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। ইতোমধ্যে যারা ঘর পেয়েছেন, তারা আনন্দে ও স্বাচ্ছন্দ্যে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন বলে তিনি জানান।

বঙ্গবন্ধু স্কয়ার 

তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধায় নির্মিত হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্কয়ার’। টুইন টাওয়ার কিংবা লন্ডন ব্রিজের আদলে দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনাটি মহাসড়কের দুই পাশে থাকবে ৫ তলার দুটি ভবন। ভবন দুটি যুক্ত হবে একটি সেতুর মাধ্যমে। সম্পূর্ণ স্থাপনাটি হচ্ছে স্টিল স্ট্রাকচারের। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের সুবিধার্থে এই স্থাপনাটি নির্মাণ করা হচ্ছে। নান্দনিক এই স্থাপনা নির্মাণ করছে পঞ্চগড় জেলা পরিষদ। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

সূত্র জানায়, প্রতি বছর ৫০ হাজারের বেশি পর্যটকের আগমন ঘটে এই জেলায়। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে পর্যটক আকৃষ্ট করতে তেমন কোনো অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা নেই। তাই পর্যটক টানতে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর এলাকায় মহাসড়কের দুপাশে স্টিল স্ট্রাকচারের দুটি পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এই পাঁচ তলা ভবনের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট এবং প্রস্থ ৩০ ফুট হচ্ছে। প্রথম ভবনের নিচতলায় থাকবে জাদুঘর। সেখানে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিসহ ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সম্পাদিত সব চুক্তির ছবি এবং বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্য চিত্র রাখা হবে। দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলায় থাকবে আবাসিক সুবিধা। পঞ্চম তলায় থাকবে ওয়াচ টাওয়ার ও কফি কর্নার। দ্বিতীয় ভবনের নিচতলায় থাকবে ট্যুরিস্ট পুলিশ ও সিকিউরিটি ইউনিট। দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলায় থাকবে আবাসিক সুবিধা। পঞ্চম তলায় হবে ওয়াচ টাওয়ার ও খাবার হোটেল। 

দুটি ভবনকে ১০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুট প্রস্থের একটি সেতু সংযোগ স্থাপন করবে। সেতুটি নির্মিত হবে মাটি থেকে ২৫ ফুট ওপরে। সেতুর মাঝ বরাবর ৫ ফুট চওড়া একটি রাস্তা রেখে দুই পাশে থাকবে দেশের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর স্টল। সরকারের অনুমোদন পেলে বাংলাদেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানের স্টলও রাখার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্কয়ার নির্মিত হলে পর্যটন শিল্পে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। পর্যটকদের থাকা খাওয়াসহ বিনোদনের সুযোগ তৈরি হবে।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট বলেন, প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক পঞ্চগড়ে ঘুরতে আসেন। কিন্তু সেখানে থাকা-খাওয়ার তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। পঞ্চগড়ের পর্যটন শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতেই আমরা জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্কয়ার’ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। এটি নির্মিত হলে পঞ্চগড়ের পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ হবে।

চতুর্দশীয় স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা 

জেলার অর্থনীতিতে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর শুরু থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেই চলেছে। যাত্রাপথের শুরুতে বাংলাদেশ প্রতিবেশি ভারতের অভ্যন্তরীণ সড়ক ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য করলেও বর্তমানে বন্দরটিতে যুক্ত হয়েছে ভারত ও ভুটান। ফলে বন্দরটি চতুর্দেশীয় স্থলবন্দরে রূপান্তরিত হয়েছে। 

১৯৯৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর নেপাল-বাংলাদেশের মধ্যে ভারতীয় সড়ক ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার, বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে বন্দরটিতে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। 

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা 

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বন্দরটিতে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা চালু করা হয়। বন্দরটি থেকে ভারতের শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, সিকিম এবং নেপাল ও ভুটান বেশ কাছে হওয়ায় ভ্রমণ, শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য উভয় দেশের লোকজন এ বন্দরটি ব্যবহার করছে। 

জেলার অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয়ভাবেও বেশ সুনাম অর্জন করেছে পঞ্চগড়।  পঞ্চগড়-২ আসন থেকে সর্বশেষ একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর রেলমন্ত্রী হয়েছেন নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি মন্ত্রী হয়ে পঞ্চগড়কে জাতীয় পর্যায়ে নতুন করে উপস্থাপন করেছেন। মন্ত্রীর বাড়ি জেলার বোদা উপজেলার ময়দানদিঘী ইউনিয়নের মহাজন পাড়ায়।

জাতীয় ক্রিকেট দলের পেস বলার শরিফুল ইসলামের বাড়িও পঞ্চগড়ে। তিনি এবার বিশ্বকাপে খেলেছেন। এই অর্জনও এই জেলাকে নতুন করে পরিচিত করে তুলেছে। শরীফুলের বাড়ি দেবীগঞ্জ উপজেলার দন্ডপাল ইউনিয়নের মৌমারি এলাকায়। 

শুধু তাই নয় প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে রাশিয়ার বাউম্যান মস্কো স্টেট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে রকেট কমপ্লেক্সেস অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স নিয়ে পড়ছেন শাহ জালাল জোনাক।  তার বাড়ি তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর এলাকায়।

মাহি/এসবি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়