ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

লটকনের দাম ভালো পাওয়ায় খুশি কৃষক

নরসিংদী প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৯, ২০ জুলাই ২০২২   আপডেট: ১০:৫৫, ২০ জুলাই ২০২২
লটকনের দাম ভালো পাওয়ায় খুশি কৃষক

টক আর মিষ্টিতে ভরপুর এখানে উৎপাদিত ফলটি হাজারো চাষিদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে

নরসিংদীতে লটকন চাষ করে হাজারো কৃষকের ভাগ্যবদল হয়েছে। ফলে একসময়ে জংলি ফল হিসেবে পরিচিত এ লটকন এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে নতুন নতুন বাগানের সংখ্যা। 

চাষিদের অভিযোগ, মৌসুমের শুরুতে গাছে ছত্রাক দেখা দেওয়ার কারণে আক্রান্ত হয় লটকন ফল। ফলে এ বছর ফলন কম হয়েছে। তবে সারাদেশে লটকনের ব্যাপক চাহিদা থাকায় এবং বাজার দর ভালো থাকায় এই ফলের পাইকারি বাগান ক্রেতা ও চাষিরা খুশি। 

লটকনে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন‘বি-টু’ ও ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। এছাড়া ফলটি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। যার ফলে মানবদেহে দৈনিক যে পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’র প্রয়োজন হয় মাত্র তিন-চারটি লটকন সে চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট।

ফুল হয় না পাপড়িও ঝড়ে না। সরাসরি গাছের কাণ্ড থেকে বের হয় এ লটকন, যার স্থানীয় নাম বুগি। টক আর মিষ্টিতে ভরপুর এখানে উৎপাদিত ফলটি হাজারো চাষিদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। তাই অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে এখানকার কৃষকরা শুরু করেছে এর আবাদ।

লটকন গাছ সাধারণত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে রোপণের উপযুক্ত সময়। বর্ষার শেষের দিকে মানে ভাদ্র-আশ্বিন মাসেও গাছ লাগানো যায়। লটকনের গাছ ঝোপের মতো হয়ে থাকে। প্রতিবছর মাঘ-ফালগুনে লটকন গাছে মুকুল আসা শুরু হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে পাকতে থাকে। বেলে ও দো-আঁশ মাটিতে ফলন ভালো হয়। লটকন ফলনে তেমন কোনো খরচ নেই। স্ত্রী গাছ লাগিয়ে দিলেই হয়। সময়ে সময়ে একটু পরিচর্যা করতে হয়। গোড়ার চারদিকে জৈব সার দিলে ফলন ভালো হয়। পিঁপড়া বা পোকামাকড়ের হাত থেকে ফল বাঁচাতে ছত্রাকনাশক দিতে হয়।

নরসিংদীর লটকন খেতে সুস্বাদু হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলায় এর কদর রয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে এখানকার সু-স্বাদু এ লটকন ফল। কিন্তু ২০২০ সালে করোনা মহামারি কারণে আন্তজাতিক ফ্লাইট সাময়িক বন্ধ থাকায় লটকন দেশের বাইরে রপ্তানি করা যায়নি। তবে বর্তমানে সঙ্কট কেটে যাওয়ায় আবারো লটকন বিদেশে রপ্তানি শুরু কবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।

নরসিংদীর কৃষি সম্প্রসার অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার লাল মাটিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও খনিজ উপাদান বিদ্যমান। তাই এখানে লটকনের ফলন ভালো হয়। আবার চাষিরাও লটকন আবাদে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। এ কারণে লটকের আবাদ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৬৭৩ হেক্টর জমিতে লটনকনের বাগান করা হয়েছে। যা হেক্টর প্রতি ১৫ টন হারে ২৫ হাজার ৯৫ মেট্রিক টন (একটন সমান ১০১৬ কেজি) লটকনের ফলন পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী কৃষি বিভাগ। আর উৎপাদিত এ লটকন পাইকারি দর ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। যার মূল্য পাওয়া যাবে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা।

স্থানীয় লকটন চাষিরা জানায়, একসময় ঝোপ-জঙ্গল ও বাড়ির আঙ্গিনায় লটকন গাছ রোপণ করতেন। প্রায় ৩০ বছর আগে প্রথম বেলাবো উপজেলার লাখপুর গ্রামে অপ্রচলিত ফল লটকনের আবাদ শুরু হয়। এরপর থেকে বেলাব ও শিবপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের লালমাটির এলাকায় লটকন চাষের প্রসার ঘটতে থাকে। দিন দিন মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে খাদ্য ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ লটকনের চাহিদা বাড়তে থাকে। বাজারে ব্যাপক চাহিদা ও লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই লটকনের চাষে ঝুঁকছেন কৃষক।

বিশেষ করে বেলাবো ও শিবপুর উপজেলায় গত ৩০ বছরে বাণিজ্যিকভাবে লটকনের প্রসার ঘটেছে। দুই উপজেলার প্রায় পরিবারের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এখন লটকন। লটকন চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর পাশাপাশি, বেকার সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পেয়েছেন অনেকে।

লটকন চাষি ও স্থানীয় কৃষি অফিস জানায়, শিবপুর ও বেলাবো উপজেলার মাটি ও আবহাওয়া লটকন চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এছাড়া রায়পুরা ও মনোহরদী উপজেলার কিছু কিছু এলাকার মাটিও লটকন চাষের উপযোগী। গাছের গোড়া থেকে শুরু করে প্রধান কান্ডগুলোতে ছড়ায় ছড়ায় ফলন হয় এই লটকনের।

লটকন গাছ রোপণের তিন বছরের মধ্যে ফলন আসে। ফল দেয় টানা ২০ থেকে ৩০ বছর। লটকন গাছের রোগবালাই তেমন দেখা যায় না। ফল সংগ্রহের ৬০দিন আগে গাছ প্রতি ৫০গ্রাম পটাশ পানির সঙ্গে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় দিলে ফলের মিষ্টতা ও আকার বৃদ্ধি পায়।

লটকনের বাজারজাত নিয়েও দুশ্চিন্তা নেই চাষিদের। কারণ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লটকন কাঁচা থাকা অবস্থায় বাগান কিনে নেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পাকা লটকন বাগান থেকে সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন। প্রকারভেদে পাইকারি মণ প্রতি দাম ওঠে ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা। যা খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।

মৌসুমী ফল লটকন বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রায়পুরার মরজাল ও শিবপুর উপজেলা সদরে বসছে বাজার। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারি ক্রেতারা এসে ট্রাক ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছেন লটকন। অনেকে সরাসরি বাগান থেকে লটকন কিনে সরবরাহ করছেন।

শিবপুর উপজেলার জয়নাগর ইউনিয়নের কামরাব গ্রামের মো.আলমগীর হোসেন বলেন, কম খরচে লাভজনক ফসলের মধ্যে একমাত্র হলো লটকন। লটকন বাগান শুরু করতে প্রথমে খরচ বেশি পড়লেও পরবর্তীতে বিঘা প্রতি ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয় না। সে তুলনায় লাভ বেশি হয়। এছাড়া লটকন ফলের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গাছের কাণ্ডে ফল হয়। কখনও কখনও এত বেশি ফল আসে যে গাছের ডাল পর্যন্ত দেখা যায় না। একটি পূর্ণবয়স্ক লটকন গাছে ৫ থেকে ১০ মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।

একই উপজেলার লটকন চাষী কৌশিক আহম্মেদ জানান, তাদের এলাকায় প্রায় পরিবারের অর্থনীতিক মূল উপাজনের সহায়ক হলো এখন লটকন। তার দুইটি লটক বাগান রয়েছে। একটি হলো ৭ কানিং যাহা স্থানীয় মাপে (৩৭৮ শতাংশ) ও আর একটি হলো ৩ কানিং (১৬২ শতাংশ)। এর মধ্যে একটি বাগান থেকে ২৬টি গাছ তিনি ৫ লাখ টাকায় বন্ধক দিয়ে দিয়েছেন। আর বাকি গাছ থেকে যে লটকন ফলন আসছে এ থেকে প্রতি বছর তার বেশই আয় হচ্ছে।

বেলাব উপজেলার আমলাব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও লটন চাষি মো. নুরুল হাসান জানান, তার ২৯ কানি জমিতে একটি লকটন বাগান রয়েছে। বাগানটিতে ৭০০ লটকন গাছ রয়েছে। এ বছর গত বছরের অর্ধেক ফলন হয়েছে। তাই বাগানটি তিনি পাইকারের কাছে ১২ লাখ টাকা বিক্রি করছেন।  ফলন কম হলেও বাজার দর-দাম ভালো, প্রতি মণ লটকন বাজারে আকার বেধে বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকায়।

লটকনের পাইকারি ব্যবসায়ী আবুল হোসেন বলেন, গত দুই বছর লটকনের বাগান কিনে অনেক টাকা লোকসান দিয়েছি। এবার ধার-দেনা করে ৭ লাখ টাকায় ৩টি বাগান কিনেছি। এবছর আমরা লটকনের ভালো দাম পাচ্ছি। সবকিছু মিলিয়ে এ বছর গত দুই বছরের লোকসান অনেকটা পুষিয়ে নিতে পারবো আশা করছি।

নরসিংদীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক ড. মো. ছাইদুর রহমান বলেন, লটকন চাষ বৃদ্ধিতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চারা উৎপাদন করাসহ কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে । তাছাড়া লটকনে রোগ বালাইয়ের তেমন সংক্রমণ না হওয়ায় উৎপাদন খরচ কম ফলনও ভালো হয়। বাজারে লটকনের ন্যায্য দাম পাওয়ায় লটকনচাষীও লাভবান হচ্ছেন।

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়