জেনারেল অরোরা : আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু
রিশিত খান || রাইজিংবিডি.কম
জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা
রিশিত খান : বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনী বলে পরিচিত ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের প্রাক্তন অধিনয়াক, অকুতোভয় বীর সেনানী পাঞ্জাব-নন্দন জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা পরলোকে চলে গেছেন ২০০৫ সালের ৩ মে। নয়াদিল্লির একটি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ এসব বিষয় উত্থাপিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে নামটি অনিবার্যভাবে শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হয়, তিনি হচ্ছেন অকুতোভয় সমরনায়ক জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।
মুক্তিযুদ্ধের একটি ছবি, যে ছবিটি বাংলাদেশের সব মানুষের হৃদয়ে গাথা রয়েছে, সেটি হচ্ছে ঢাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পড়ন্ত বেলায় মিত্রবাহিনীর প্রতিনিধি জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছেন পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি।
বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। জেনারেল অরোরা ছিলেন ওই ঐতিহাসিক বিজয়ের অন্যতম রূপকার। বর্ণাঢ্য সামরিক জীবনের অধিকারী জেনারেল অরোরা বাংলাদেশের একনিষ্ঠ অনুরাগী এক সুহৃদ। সংগত কারণেই যৌথ বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার হিসেবে বাংলাদেশের অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালির মনে জেনারেল অরোরার স্থান ছিল পরমাত্মীয়ের।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায়ে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী-কবলিত বাংলাদেশের মানুষ মুক্তির জন্য ছটফট করছিল, জাতির সেই চরম দুঃসময়ে সেদিনের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুধু বিশ্বজনমত গঠন, ১ কোটি শরণার্থীর আশ্রয়দান আর প্রবাসী বাংলাদেশের সরকারকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব ও পশ্চিম দুই ফ্রন্টেই ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারত প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম তথা মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত বিজয়ও অনিবার্য হয়ে ওঠে। দিশেহারা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর পরাজয় তখন কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল। ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্ণে ঢাকার ঐতিহাসিক সেই রেসকোর্সে, যেখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, সেখানে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল ৯৪ হাজার পাকিস্তানি দখলদার সৈনিকের কমান্ডার জেনারেল নিয়াজি। ফলে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ জয়ের জন্য গৌরবময় ইতিহাসের এক ঘনিষ্ঠ ও অনিবার্য সহচর জেনারেল অরোরার মৃত্যুসংবাদ স্বাধীনতাপ্রেমী বাঙালি মাত্রকেই শোকাহত করেছে। তার মৃত্যু বাংলাদেশ ও এ দেশের জনগণের জন্য এক শোকাবহ ঘটনা। তাই তো তার মৃত্যুর এত বছর পরও আমরা শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর এই বীর যোদ্ধার অবদানের কথা স্মরণ করি।
প্রয়াত অরোরা ছিলেন সত্য প্রকাশে আপসহীন। তার জীবনযাপন ছিল অনাড়ম্বরপূর্ণ। ঢাকায় অতি অল্প সময়ে পাকিস্তান বাহিনীর পতন ঘটানোর ক্ষেত্রে তার নেতৃত্বাধীন মিত্রসেনাদের জোরকদম ভূমিকা থাকলেও অরোরা তার যুদ্ধস্মৃতিতে সর্বদাই মুক্তিবাহিনীর চরম ত্যাগ, পরম সাহস ও শৌর্যবীর্যময় ভূমিকার কথা অকুণ্ঠে বয়ান করে গেছেন। তার ভাষায় মুক্তিবাহিনী নিয়াজিকে বোবা-অন্ধ বানিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারে দিল্লিতে নানা মত থাকলেও অরোরা যুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে বাহিনী প্রত্যাহারে জোরালো মতামত রেখেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে তার আলোচিত উক্তি হলো- তিন মাস পর্যন্ত আমরা ‘মিত্রবাহিনী’ থাকতে পারি। কিন্তু এর বেশি হলেই আমরা ‘দখলদার’ বাহিনীতে পরিণত হব। ১৯৭২-এর ১৪ মার্চ মিত্রবাহিনী বিদায়ী প্যারেডে অংশ নেয় এবং দ্রুত বাংলাদেশ ভূখণ্ড ত্যাগ করে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর কোথাও যেন বিশৃঙ্খলা মাথাচাড়া না দেয় সেজন্য তার ছিল কঠোর নির্দেশ ও সতর্ক দৃষ্টি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার অমায়িক ব্যবহার ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক এ ব্যাপারে পালন করেছিল অনুকূল ভূমিকা। এভাবে তার স্মৃতি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে আছে।
জগজিৎ সিং অরোরা সম্পর্কে ভারতের প্রাক্তন সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন একদমই আমার মতো, তিনি একজন প্রথম শ্রেণির যোদ্ধা এবং একটি প্রথম শ্রেণির কাজ করেছেন।’ একটি অঞ্চলের কমান্ডার সম্পর্কে যখন সেনাপ্রধান এ ধরনের প্রশংসা করেন, তখন জগজিৎ সিং অরোরা কোন মাপের যোদ্ধা ছিলেন তা সহজেই অনুমেয়।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই জেনারেলের মৃত্যুসংবাদ ঘোষণায় পিটিআইসহ শীর্ষস্থানীয় ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে তাকে ‘দ্য হিরো অব দ্য লিবারেশন অব বাংলাদেশ’ উল্লেখ করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে অরোরা একবারই এসেছিলেন ১৯৯৮ সালের ২০ মার্চ। সে-বার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশর মানচিত্র আঁকা একটি কোটপিন সেদিন তার বুকে পরা ছিল। বিমানবন্দরে অরোরা বলেছিলেন, ‘এটা আমার একাত্তরের স্মৃতি। একাত্তরের একটি টাই এখনো সযত্নে আমার কাছে রাখা আছে।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাতাশ বছর পর ঢাকা এসে আবেগাপ্লুত ভারতীয় প্রাক্তন জেনারেল বলেছিলেন, ‘আমি বাংলাদেশের সেই জনগণকে ভুলতে পারি না, যারা একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করেছিল। কোনো কিছুই তাদেরকে লক্ষ্য থেকে পিছু হটাতে পারেনি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের নিজস্ব স্মৃতি সম্পর্কে বলেন, ‘আমি তো সেখানে শুধু একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছি। সেই সৌভাগ্যের স্মৃতিই জীবনের সেরা অর্জন হয়ে আছে। সেই ছবিটিই আমার ঘরে টাঙানো আছে পরম যত্নে।’
জেনারেল অরোরা যেমন ছিলেন বাংলদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, তেমনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন শান্তি ও সমঝোতার অগ্রদূত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক ধারাবাহিক মধুরতা বিরাজ করেছে এ কথা হয়তো বলা যাবে না। সম্পর্কের এই ওঠানামার জন্য কারা কতটা দায়ী তা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক করা যায়; কিন্তু সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে যেটা ইতিহাস তা হচ্ছে, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল। সেই যুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের বুকের রক্ত এক স্রোতোধারায় মিশে গিয়েছিল। পরবর্তী বাস্তবতার ঘাত-প্রতিঘাত সত্ত্বেও আমরা মনে করি, একাত্তরে সেই একাত্মতা ও সহমর্মিতা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেধ্য অংশ। সেই ইতিহাস রচনার কৃতিত্ব যাদের প্রাপ্য, জেনারেল অরোরা তাদের অন্যতম।
বাংলদেশে সফরকালে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল নিরপরাধ, নিরস্ত্র, জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়াই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিজয় অর্জন সম্ভব ছিল। এতে হয়তো সময় এক-দুই বছর বেশি লাগত। কারণ বাংলাদেশের যুদ্ধটি ছিল একটি জাতির স্বাধীনতাযুদ্ধ। কোনো যুদ্ধ যদি স্বাধীনতার জন্য হয়, তাহলে সে যুদ্ধকে কোনোভাবেই ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না।’
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু জেনারেল অরোরার জন্ম ১৯১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, এখনকার পাকিস্তানের ঝিলম জেলার কালাগুজরান গ্রামে। ১৯৩৯ সালে তিনি ২য় পঞ্জাব রেজিমেন্টে কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৪৭-৪৮ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে এবং ১৯৪৮ সালের কাশ্মীর অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালের মে মাসে তিনি ভুটানেও একটি সফল অভিযান পরিচালনা করেন। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি অবসরে চলে যান। ১৯৭৮ সাল থেকে অরোরা দিল্লিতে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। ১৯৮৬ সালের তিনি আকালি দলের সদস্য হিসেবে ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সফলতা লাভের জন্য ভারত সরকার তাকে সে দেশের শ্রেষ্ঠ নাগরিক পদক ‘পদ্মভূষণ’ এবং সামরিক পদক ‘পরম বীরচক্র’ প্রদান করে। জীবনের শেষ দিকে তিনি শিশুদের জন্য কল্যাণধর্মী কাজে নিবেদিত ছিলেন।
জগজিৎ সিং অরোরা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি অন্যতম নাম। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি একজন অকৃত্রিম পরম বন্ধুকে হারিয়েছে। আর ভারত হারিয়েছে একজন সাহসী সমরনায়ককে।
আমরা পরম শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানাই তার স্মৃতির প্রতি।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী
রাইজিংবিডি/ ঢাকা/২০ আগস্ট ২০১৪/সনি/কমল কর্মকার
রাইজিংবিডি.কম