ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ছোটগল্প || কাজল ভোমরা

আফসানা বেগম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৯, ২৮ জুন ২০২৩   আপডেট: ১৮:০৯, ২৮ জুন ২০২৩
ছোটগল্প || কাজল ভোমরা

শনিবার দুপুরে খাওয়ার পরে আয়েশ করে শুয়ে অরিত্রকে গল্প শোনানোর অভ্যাসটা যে আমাকে কোন সুদূর অতীতে টেনে নিয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। এমনকি আমি অরিত্রের হাত ধরে সেই অতীতটা উঁকি দিয়ে দেখেও আসতে পারব- এমনটা কে জানত!

আমি চিরকাল নিজেকে বলি চাষার ছেলে। আমার বাবা কিংবা চৌদ্দ পুরুষ ছিল কৃষিজীবী। বাড়ির চারপাশে দিগন্ত জোড়া ক্ষেত, কখনো কঁচি ধানের মনকাড়া সবুজ, কখনো সরিষার হলুদে সয়লাব। এই দেখে দেখেই আমি বড়ো হয়েছি। আজ হাজার মাইল দূরে লন্ডনের কাছে কেন্টের শহরতলীতে এসে পড়ে আছি, প্রাণীর জিন বৈচিত্র নিয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছি, আমার নামডাক চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু আমি কি মনের ভিতরে সেই কঁচি ধানের দোল খাওয়া আর সরিষা ফুলের ঘ্রাণ টের পাই না?

পাই নিশ্চয়ই। তাই তো অরিত্রকে গল্প শোনাতে গেলে সেই অতীত তেড়ে ফুঁড়ে আমার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে। অরিত্র কি সেই দিনগুলোর হারিয়ে যাওয়া সময়ের মর্ম বুঝবে? শ্রোতার বোঝাবুঝির সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে কখনো যেন আমি কেবল বলার জন্যই বলে যাই। বলার সময়ে অবলীলায় এমন শব্দ ব্যবহার করি যা অরিত্রের পক্ষে বোঝা অসম্ভব। কিন্তু সেসব তোয়াক্কা করি না। মজার ব্যাপার হলো, অভিনয় কি না জানি না, তেরো বছরের অরিত্র বেশ আগ্রহ দেখায়। ভাঙা ভাঙা বাংলা উচ্চারণে শোনা গল্পের পুনরাবৃত্তি দাবি করে। বলে, বাবা, ওই গল্পটা বলো না, আই মিন ওই যে, কামারের গল্প, হাপর আর কাজল ভোমরা গানটা? রিমেমবার দ্যাট নাইস সং?

ওর আগ্রহ দেখলে আমার হাসি পায়। ও কি কোনোদিন ওই গ্রামে গেছে বা যাবে? কামার বা হাপর কী, তার বিন্দুবিসর্গ ধারণা কি আছে ওর? কাজল ভোমরা গান না-হয় আমি নিজের শ্রবণের অযোগ্য হেড়ে গলায় বারকয়েক শুনিয়েই ফেলেছি, তাই বলে ওই বিষয়গুলো এভাবে মনে ধরা, মনে রাখা- তাই অরিত্রর এই আচরণে আমি কখনো অবাক হই বলা যায়। সাপ্তাহিক ছুটির দুপুরের নিস্তব্ধ সময়টাতে আমরা একটু গড়িয়ে নিই। কখনো চোখ টেনে নায়না বলে, অ্যাই, ও কী বোঝে এই কাজল ভোমরা গানের? যত্তসব কঠিন গল্প! অরিত্রের মায়ের কথা শুনে আমি মুচকি হাসি। হয়ত অরিত্রের কৈশোর পেরিয়ে যাওয়া সময়টা মাথায় রেখে মনে মনে ভাবি- ছেলে বড়ো হোক, তাকে আমি বোঝাবো কার কে কাজল ভোমরা।
কই, বাবা? প্লিজ স্টার্ট। বলো না কাজল ভোমরার কথাটা?
আমি পাশ ফিরে তার গলা জড়িয়ে ধরি। ওদিকে তার মা ঘুমাচ্ছে, তাই অরিত্রের কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচু গলায় গল্প বলি কিংবা ফেলে আসা কোনো জীবনের অলিগলি ধরে হাঁটতে থাকি।

সেই আশির দশকের শুরুর দিকের কথা বলছি, অরিত্র। আমি তখন প্রায় তোমার মতো। তোমার মতোই একা একা স্কুলে যেতাম-আসতাম। তবে এখানকার মতো ঝকঝকে বাসে চকচকে রাস্তা ধরে নয়; প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ধুলায় ডুবে যাওয়া মাটির রাস্তা ধরে, হেঁটে। সকাল সকাল দুই মাইল হেঁটে শুকুরের হাট হাই স্কুলে যখন পৌঁছাতাম তখন আমাকে দেখতে সাদা এঁটেল মাটির ধুলায় মোড়ানো মূর্তির মতো লাগত। আর যখন আবারো সেই ধুলা মাড়িয়ে বাড়ি ফিরতাম ততক্ষণে সূর্য পড়ে যায় যায়। আকাশের লালচে রঙে রাস্তার ধুলার স্তরে রঙ লাগত। মনে হতো বইয়ে দেখা মঙ্গল গ্রহের ছবিটার মাটির উপর দিয়ে হাঁটছি আমি। গোঁড়ালি থেকে হাঁটু অব্দি লাল হয়ে যাচ্ছে। কখনো ঠিক পাশ দিয়ে আখ বোঝাই লাল রঙের লম্বা কতকগুলো ট্রলি ধীর গতিতে চলে গিয়ে পুরো এলাকাটাকে গোলক ধাঁধায় ফেলে দিত। উড়তে থাকা বালুর মোটা কণায় রাস্তা উধাও, রাস্তার পাশের ক্ষেত উধাও, পুরো পৃথিবী উধাও। তবে সমস্ত কিছু ধুলোর স্তরের নিচে চলে যাবার আগে যদি ট্রলি থেকে ঝুলে থাকা আখের একটাকে খপ করে ধরে ফেলা যায়, তবে যে ধরবে শক্ত করে, ট্রলি চলে যাবার পরে সে দেখবে একাকী আখ হাতে ধুলোর ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের উলটো পিঠে চোখের পাপড়ি থেকে ধুলো সরিয়ে নিলে বালু কিচকিচ মুখে আখ চিবিয়ে চিবিয়ে বাড়ি পর্যন্ত চলে আসা তখন ভালোই মজার।
হা হা হা. . . অরিত্র শরীর কাঁপিয়ে হাসে এইখানে। আমি কি ছেলেকে চুরি শেখাচ্ছি? কে জানে!

আমার বাড়ি শাল্টি গোপালপুর। বাড়ির সামনে বড় উঠোন, উলটোদিকে চৌপথীর বাজার। চৌপথী মানে হলো গিয়ে চার রাস্তার মোড়। তবে রাস্তা ধরে এগোলে আমার স্কুলের দিকে আরো কি চার রাস্তার মোড় ছিল না? ছিল গোটাচারেক। কিন্তু আমি লক্ষ করেছিলাম ওটা ছাড়া আর কোনোটার নাম চৌপথী ছিল না। চৌপথী নাম ছিল শুধু আমাদের বাড়ির সামনের মোড়টার। আখের শেষ মাথা খেতে খেতে যখন চৌপথীর মোড়ের কাছে চলে আসতাম তখন গ্রামের দুষ্টু ছেলে ফচির সামনে পড়লেই হলো। আখের শেষের দিকটা শক্ত যেমন, রসও তেমন বেশি। তবে ওই অংশে কামড় বসাতে আমার কষ্ট হতো। এই সুযোগে ফচি সামনে এলে অনায়াসে কেড়ে নিত হাত থেকে। আমি কাচুমাচু হয়ে যেতাম। আখে সে কচকচে কামড় বসাত। কখনো অসহায় চোখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে ফচির হাতে ধরা আখের লাঠি দিয়ে আমার পিঠে বাড়ি দিয়ে বলত, ক্যা রে, বাড়িত যাবু না? যা!

আমি চমকে উঠে চৌপথী পেরিয়ে আমাদের বাড়ির বাইরের উঠোনটা, যেটাকে আমরা বলতাম ‘খুলি’, সেদিকে দ্রুত হাঁটা ধরতাম। ফচির হাসি শুনতে পেতাম পিছন থেকে। আমার ভয় পাওয়া দেখে তার হাসি পেত। সেই হাসি শুনলে ভয় আমাকে আরো চেপে ধরত। 
অরিত্র এটা শুনলে ভ্রু কুঁচকে দুর্গন্ধ পাওয়ার মতো করে নাক কোঁচকাত। আমি হাসতাম, বলতাম, তখন তো বুঝতাম না রে, ওটা ছিল চোরের উপরে বাটপারি! আমার হাসিমুখ দেখে সে রাগ করত, মাই গড হি ওয়াজ ইয়োর বুলি। ইউ ওয়ার বুলিড, বাবা!
হুম হুম, তা বটে, তা বটে।

যা হোক, সপ্তাহে দুদিন চৌপথীর মোড়ে বাজার বসত। বিকেল থেকে রাত। গ্রামে অবশ্য রাত নামত খুব তাড়াতাড়ি। বাজারের দিনে কোরোসিনের ল্যাম্প জ্বালিয়ে দোকানিরা পসরা সাজাত। সামান্য বাতাসে সব শিখা একদিকে কাত হয়ে যেত। স্কুলের পরে ওই দুদিন আমি ভিড় দেখতে বেরোতাম। এক দেড়শ’ লোকের সমাগম। কেউ কেনে কেউ বিক্রি করে। চুড়ি-ফিতা থেকে শুরু করে ধান-চাল, গরুর মাংস। বিশাল এক বাজার মনে হতো আমার কাছে। দিনের বেলায় বাজার আলো করে যে আকরাম মামুর মুদির দোকান, মোজাম্মেল খালুর দর্জিঘর আর ডাক্তার কাঞ্জিলালের চেরিটেবল ডিসপেন্সারি হাঁকডাক ছাড়ত, রাতের বাজারে সাজিয়ে বসা গোটা তিরিশেক দোকানের ভিড়ে তাদের খুঁজেই পাওয়া যেত না। আমি বাজারের দুই সারি দোকানের মাঝখানের সরু পথ ধরে এমাথা ওমাথা হাঁটতাম। কেউ দাড়িপাল্লার দুদিকে জিনিস আর বাটখারা তুলে উপরের লাঠিটার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কেউ খানিকটা ঝুঁকে ল্যাম্পের আলোয় খুচরো পয়সা গুনে দিচ্ছে। বাতাসে নিবে যাওয়া আগুনের শিখাকে আবারো জ্বেলে দিতে হাঁক ছাড়ছে কেউ, ও রুবেল, কোণ্ঠে গেলু? ল্যাম্পোটা একনা জ্বালে দিয়া যাইস তো বাহে?

এ সমস্ত হইহল্লা পেরোলে বাজারের শেষ মাথায় কামারের দোকান। সবদিকে খোলা, শুধু মাথার উপরে টিনের ছাদসর্বস্ব ঘর এক। চাঁদের উপরিভাগের মতো খোবড়ানো মাটির মেঝেতে দুজন মাত্র মানুষ বসা-  এক প্রায় বুড়ো আর এক কিশোর। তখনকার আমারই মতো বয়স কিশোরের। তার হাতের সামনে হাপর। ত্রিভুজের মতো জিনিস এক, ফোলানো আর কয়েকটা ভাঁজ তাতে নকসা যেন। চামড়ার হাপরটা বাতাস খেয়ে ফোলে আর মাটির নিচের পাইপ দিয়ে বুড়ো লোকটার দিকে পাঠায়। সেখানে গরম গরম লোহার টুকরোকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে সে নানান আকৃতি দেয়। ধৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে রহস্যের কুল কিনারা খোঁজার মতো ব্যাপার- এই হয়তো মনে হলো কুড়াল হবে, কিন্তু হয়ে গেল কোদাল!
বাহ কী মজা! 

হ্যাঁ, খুব মজার। অর্ধেক পিটানোর পরে যদি তুমি জানতে চাও কী বানাচ্ছে? সে তোমাকে মোটেও উত্তর দেবে না। লোহার দলার উপরে হাতুড়ি পড়ার ফাঁকে হয়ত একবার অনেকটা মুচকি হাসির মতো ঠোঁট বিস্তৃত করার ভঙ্গি করে তোমার দিকে একবার দেখে নেবে। সামান্য হাসিতে পিটানো লোহার মতোই তার মুখের শক্ত কালো চামড়ার উপরে তখন ভাঁজগুলো স্পষ্ট হবে। কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া ঘামের তিন চারটা বিন্দুর ধারা গালের উপরে থমকে থেকে ভাঁজগুলোকে চিকচিকে করবে। ওই কামার আর তার সঙ্গে কাজ করা কিশোরটা অবশ্য শুধু বাজারের দিন না, বলতে গেলে প্রতিদিনই ওখানে বসত। স্কুল থেকে ফিরে তাই ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তা ধরার জন্য আমাদের পুরোনো ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া টিনের গোলাঘরগুলো ফেলে আমি প্রায়ই কামারের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমার মতো দাঁড়িয়ে থাকত আরো কিছু ছোট-বড় কিশোর। লোহার দলায় হাতুড়ির আঘাত পড়তে থাকলে আমরা অনুমান করতে চেষ্টা করতাম। কেউ বলত, ছুরি ছুরি.. কেউ কোদাল কোদাল, আমি কখনো কুড়াল বা লাঙ্গলের ফলা ভেবে চুপ থাকতাম, আচ্ছা, আরেকটু আগাক না-হয়, তারপর বলবো। তবে সেসব যাই হোক, আমার মূল আকর্ষণ ছিল কামারের কাজ যখন শেষ হয় তার পরের ঘটনায়। 

বাজারের দিনে ভিড়ের মানুষেরা কামারকে এটা ওটা বানিয়ে দেয়ার বায়না আর কিছু টাকা দিয়ে যেত। আর কাজকর্ম শেষ হলে কামার ঢকঢক করে পানি খেয়ে পা ছড়িয়ে জিরিয়ে নিত। হাপরটাও দম ছেড়ে বাঁচত তখন। কিশোর ছেলেটা খুঁটিতে হেলান দিয়ে বড়ো লোকমা তুলে ভাত খেত। বাটা শুকনা মরিচের লালে লাল তার লোকমা। কামার কোমরের লুঙ্গির প্যাঁচ থেকে বিড়ি বের করে আয়েশী টান দিয়ে নিত খানিক। আমি অপেক্ষা করতাম। কারণ, জানতাম সে এরপর ময়লা ঝোলা ব্যাগ থেকে একতারা বের করবে। আর একতারা বেরোলেই আশেপাশের মানুষ এগিয়ে এসে বসবে বা দাঁড়াবে কাছেধারে। একতারায় দু’চারটা টুংটাং আওয়াজ করে একমাত্র তারটা সুরে বেঁধে নেবে সে। শেষে একবার বড়সড় গলাখাকারি দিয়ে গাইতে শুরু করবে, ও কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে, কোনদিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে. . . 

কিশোর ছেলেটা তখন ভরাপেটের তৃপ্তির ঢেকুর সেরে নিয়ে পাশে বসবে, দুটো কাঠের টুকরো দুই হাতে ঠুকে তাল দেবে। দূরে কেউ দ্রুতগামী মানুষের দিকে চিৎকার করে বলবে, আইসো বাহে, ভেন্ডাবাড়ির কামারে গান ধরছে, কাজল ভোমরা, আইসো আইসো. . .

লোক জমে যাবার পরে সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ক্লান্তি নিয়ে উদাস কণ্ঠস্বর যখন যদি বন্ধু যাবার চাও, ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাও রে. . . বলে টান দিত তখন উত্তাল বাজারের কোলাহল বন্ধ হয়ে নিস্তব্ধতার সুযোগে অশেষ হাহাকারের মতো বাজত। কোনো কোনো দোকানে ম্রিয়মান একটা দুটো কুপি তখন পুরোপুরি নিবে যাবার পথে। হয় বাতাস নয়ত কেরোসিন ফুরিয়ে যাওয়া আর তার সঙ্গে প্রয়োজনের সমাপ্তি। কিশোরের হাতে কাঠের ঠুকঠুক শব্দের সঙ্গে তখন ঝিঁঝির একটানা শব্দ যোগ হতো। অদ্ভুত এক আবহে অন্তরের আহ্বানের মতো গান শেষ হলে শ্রোতাদের মধ্যে কেউ অনুরোধ করত, আরেকবার গানটা ধরেন না তোমরা ক্যান, বাহে!

বিনাবাক্যব্যয়ে কামার ঢকঢক করে কাসার গ্লাসের পানি শেষ করত। তারপর আবার শুরু থেকে ধরত, ও কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে. .  শেষ হলে হয়ত আবারো কেউ বলত, আরেকটাবার ধরেন না একনা বাহে, আইত নামোছে, আরেকনা শুনিয়া যাইম এলা. . . কামার আবারো ধরত, ও কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে. . .

তিন-চারবার দরদে উপচে পড়া গলায় গানটা শোনা শেষ হলে অনুরোধের আসর স্তিমিত হতো। কামারের ইচ্ছা থাকলে তখন আব্বাস উদ্দীনের অন্য কোনো গান গাইতে শুরু করত। কিন্তু কেন যেন তারপর আর কিছুতেই আসর জমত না। মানে, এটা আমার মনের কথা না, অন্যদের মধ্যেও তাড়াহুড়ো দেখিয়ে চলে যেত কেউ কেউ। কেউ কাজল ভোমরার সুরটা সুরজ্ঞানহীন চেষ্টায় গুনগুনিয়ে আলাভোলা হয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে রওনা দিত। তখন আমারো মনে হতো স্কুলের পড়া শেষ করার জন্য বাড়ি ফেরা দরকার। রাত বাড়লে নিবু নিবু কুপির আলোয় কামারের গেরুয়া পাঞ্জাবী কালচে দেখাত, লুঙ্গির নীলচে চেকের লাইনগুলোও ঠিকঠাক ধরা যেত না। শুধু একতারার তারের কম্পন ঝলকে ঝলকে দৃশ্যমান হয়েই পর মুহূর্তে অন্ধকারে মিলিয়ে যেত। কিশোর ছেলেটির পরনের কালো হাফ প্যান্ট আরো কালো দেখাত, গায়ের সাদা স্যান্ড্রো গেঞ্জির উপরে ‘রাসেল হোশিয়ারি’ লেখাটা আর পড়া যেত না। ঘরঘুটি অন্ধকারে আন্দাজে পা ফেলে ফেলে আমি যখন আমাদের পরিত্যাক্ত গোলাঘরগুলোর পাশ ঘেঁষে হেঁটে আসতাম তখন কামারের সুরের টান ধীরে ধীরে বাতাসে ভাসতে ভাসতে শ্রবণের দূরত্ব পার হয়ে যেত।

এটুকু পর্যন্ত বলে আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। সেই থেকে আমি তো আসলে শ্রবণের দূরত্বেই বসে আছি। কিন্তু কানে শুনতে পাই কাজল ভোমরার সুর। হ্যালুসিনেশন?
আমাকে অন্যমনস্ক দেখে অরিত্র জানতে চায়, তোমার কি ওখানে আরেকবার যেতে ইচ্ছে করে না, বাবা?
কোথায়? 
ওই যে, চৌপথী?
কী করব গিয়ে, বাবা-মা সেই কবে মরে গেছেন। বাড়িটা তো দাদার, আমার ছোটোবেলাতেই এই ভাঙে তো সেই ভাঙে অবস্থা ছিল। এখন হয়তবা চাচাদের কেউ সেখানে থাকলেও খাকতে পারে।
কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় তুমি ওখানে যেতে চাও।

কথাটা বলে নিয়েই অরিত্র বিছানা থেকে নেমে পড়ে। তারপর ছুটে যায় ব্যাক ইয়ার্ডের দিকে। হয়ত ট্রাম্পলিনে কিছুক্ষণ লাফানোর কথা মনে পড়েছে তার। কিংবা আসন্ন বৃষ্টির আভাসে পিঁপড়ার সারির মাটি থেকে সিঁড়িতে উঠে আসা মনোযোগ দিয়ে দেখবে। আমি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, তার ধারণার মতো আমি কি সত্যিই সেখানে একবার যেতে চাই? কে যেন বলেছিল, স্মৃতিময় জায়গায় না যাওয়াই ভালো, প্রিয় স্মৃতির পরত অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সইতে পারে না। ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে ভাবি, জীবনটা এক স্মৃতির যাদুঘর বইকি!      
কথা সত্যি। এত গল্প কর কিন্তু কখনো যাও না। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ঢাকায় গেলে, রংপুর তো যেতে দেখলাম না। গেলেই হয় একবার?

ঘুমজড়ানো গলায় নায়নার কথায় আমার ঘোর ভাঙে। সময় স্বল্পতার অজুহাতে আমি ঢাকা থেকেই ঘুরে আসি, এটা ঠিক। দেশের বাড়িতে কেউ নেই, আত্মীয়দের মধ্যে যারা আছে, তাদের সঙ্গে ঢাকাতেই দেখা হয়ে যায়। বাকিদের সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজনীয়তা আমার সামনে জরুরি হয়ে ওঠে না। এইসমস্ত ভাবতে ভাবতে আমার হঠাৎ মনে হয়, আমার কি সত্যিই পূর্বপুরুষের জায়গাটা দেখার আগ্রহ হয়নি নাকি আগ্রহটা আমি দমিয়ে রেখেছি? আমি কোন ধুলো থেকে উঠে এসেছি, তার মুখোমুখি না হয়ে তাকে কি আমি এড়িয়ে যেতে চাই? তাহলে সেই সময়টা কল্পলোকের মতো আমার মনের ভিতরে বসে থাকে কেন?

দেশে যেতে দুটো জিনিস লাগে, বেশ অনেক টাকা আর লম্বা ছুটি। আত্মকেন্দ্রিকতার চূড়ান্তে চলে গেছি। শুধু নিজের উন্নতি, সংসারের সাচ্ছন্দ, সন্তানের নিরাপত্তা বা ভবিষ্যৎ, এর বাইরের পৃথিবী কবে যেন আমার কাছে ঝাপসা, অর্থহীন হয়ে গেছে। অরিত্রকে গল্প শোনাতে শোনাতে এই নিয়ে যত ভাবি ততই আমার ভিতরে অনগ্রসর সেই গ্রাম আর জনগোষ্ঠীর জন্য মায়া জন্মাতে থাকে। কিন্তু ভিতর থেকে সায় পাই না, ওই গ্রামে বেমানান এখনকার আমি, গবেষণার কাজে দিনরাত ডুবে থাকি, আরো বেশি টাকা উপার্জন আর নামডাকের জন্য ইউরোপে নিত্য নতুন ফেলোশিপের খোঁজে থাকি; ওই গ্রামে গিয়ে করবটা কী?

মায়ের প্ররোচনা পিছনে কাজ করেছে কি না জানি না, অরিত্র পরদিন সকালে বলে সে শাল্টি গোপালপুর দেখতে যাবে। সেবার ডিসেম্বরে তিন বছরের ব্যবধানে দেশে যাবার কথা ছিল যদিও, নিশ্চিত হতে পারিনি, সত্যিই রংপুর গিয়ে এতটা সময় নষ্ট করব কি না। কিন্তু শেষে কুয়াশাময় এক সকালে সৈয়দপুর থেকে ভাড়ার গাড়ি নিয়ে দুপুর নাগাদ অরিত্রসহ চৌপথীতে উপস্থিত হই। আসলে জিপিএস নিয়ে গেছে আর সাইনবোর্ড দেখে নিশ্চিত হয়েছি নাহলে আমার সাধ্য ছিল না বোঝার যে ওটাই চৌপথী।
চওড়া পিচ ঢালা রাস্তার মোড়ে গাড়ি থেকে নামি। ধুলায় ডোবা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তার জায়গাটাই বটে। অরিত্রও আমার পরপর গাড়ি থেকে নামে। চোখ কচলে বলে, এটা? মানে, এটাই চৌপথী? 

আমি বোবার মতো উপর-নিচ মাথা নাড়ি। আমি জানি অরিত্র আমার গল্পের বর্ণনার সঙ্গে মিল না পেয়ে হতাশ হয়েছে। আমার তাকে বলা উচিত ছিল প্রায় পয়ত্রিশ বছরে জায়গাটা অন্যরকম হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সে ভাবনাকে উড়িয়ে আমি রাস্তা ধরে এগোলাম। ছোট ছোট জটলা করা আম-জাম-বরই-পাইকড়-বট গাছগুলো উধাও। গাছের শিকড়ের ফেলে যাওয়া কোনো চিহ্নও নেই। সেখানে দাঁড়িয়ে গেছে সারি সারি দেয়ালের ছোট-বড় দোকান ঘর, একের থেকে এক অনেক আলাদা, এক সবুজের জায়গায় এখন সেদিকে তাকালে বিচিত্র রঙ। ওদিকে একটা ছোট পুকুর ছিল যেখানে আমার ফুপাত বোন পা পিছলে পড়ে যাওয়ার আর তারপর মৃত ভেসে ওঠার দুঃসহ স্মৃতি আছে। সেদিকে তাকিয়ে দেখি পানি আগের মতোই ঘোলা আর তীর থেকের কূয়ার মতো গভীরতা। প্রকৃতি তার পুকুরের চেহারা বদলায়নি। 

মনে হলো এসেই যখন পড়েছি, আগে বাড়ির ভিতরে ঢোকা কর্তব্য। কাছের বা সামান্য দূরত্বের আত্মীয়েরা কেউ আমাকে চিনতে পারল না। আমিও তাদের তেমন চিনলাম না। তবে শুনেটুনে কেউ যখন, কী কও, তোমরা রফিকের ছাওয়াল? আইসো এদিক, একনা ভালো করি দেইকপা নাগবে বাহে. . .। আমি এগোই, তিনি আমাকে সরু চোখে দেখেন, আমার সন্তানকে দেখেন, আমি দেখি তার গালে বয়সি বটের ঝুরির কারুকাজ। 

মাটির দেয়ালের উপরের প্লাস্টারের সাদা রঙ প্রায় পুরোটাই ঝরে পড়েছে। তাদের রোদে পোড়া অযত্নের গাল আর কপালের সঙ্গে ওই দেয়ালই হয়ত মানানসই। মেটে দেয়ালে বৈঠকখানা ঘরের দরজার চারদিকের কালো কারুকাজের কোনো অস্তিত্ব নেই। বাড়িটা আমার চেনা বলেই তার বিগত যৌবনের কথা স্মরণ করতে পারি। বিশাল শালগাছগুলো লম্বালম্বি কিংবা আড়াআড়ি টিনের ছাদের ভার বহন করছে আগের মতোই। তবে সে শাল গাছের গায়ে আগের মতো চকচকে আলকাতরার সাজ নেই। বাড়ির প্রতিটি কোণে অভাব-অনটনের ছাপ স্পষ্ট। তার মধ্যেও আকস্মিক অপ্রত্যাশিত অতিথির উপস্থিতি বুঝে মানুষগুলো উঠোনে জড়ো হয়, পান খাওয়া কালচে লাল দাঁতে বিস্তৃত হাসি টেনে মনে করিয়ে দেয় আমার ছেলেবেলার কথা। আমার বাবা কেমন সরল বোকাসোকা মানুষ ছিল, জমি বিক্রি করে কত বড়ো ভুল করেছিল, মা কত নিখুঁত ঘরনী ছিল, কিংবা চৌপথীর মামুর দোকানের মুড়িমড়কি ছাড়া আমার একদিনও চলত না। কেউ কেউ আমন্ত্রণ জানায়, কয়দিন থাকমেন বাড়িত? এক বেলা হামার ঘরত খাইমেন বাহে। সঙ্গে আশঙ্কাও প্রকাশ করে, তোমরা অ্যালা বিদেশী মানুষ আলছেন, কী খাওয়াইম তোমাক?

তাদের আন্তরিকতার জালে অনেকক্ষণ আটকে থাকি। এক চাচি কাউনের পায়েসের বাটি বাড়িয়ে ধরে। ঘোমটার প্রান্ত কামড়ে ধরে বলে, ছোট্ট সময়ে খুব পছন্দ করি খাইতা, এই ন্যাও।
সূর্য গড়ালে বাজারের দিকে রওনা দিই। অরিত্র কামারের দোকানটা দেখবে। বাড়ির বাইরের উঠোনের প্রায় মাঝামাঝি একটা মসজিদ আর সঙ্গে ছোট মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। ছোট চাচা বানিয়েছে জানতে পারি। আমাকে পেয়ে চাচা বলেন, মসজিদের জন্য ট্যাকা দিয়া যাইও কিন্তু। তোমরা বাহে ডলারত কামান, অসুবিধা তো নাই। আমি হাসি। মাথা ভরা চুলের পূর্ণবয়স্ক যে চাচাকে দেখেছিলাম, তার টাক এখন সাদা টুপিতে ঢাকা, দাড়িতে মেহেদীর রঙ।

আমাদের পরিত্যাক্ত গোলাঘরগুলো উধাও। সেখানে আটা-ময়দার ফ্যাক্টরির মেশিন শব্দে বাতাস ভারি করে রেখেছে। সামনে এগোলে চৌপথীর মোড়ে সারি সারি দোকান। নতুনের ভিড়ে মামুর মুদি দোকান, খালুর দর্জিঘর খুঁজে পাই না। কাঞ্জিলালের ডিসপেন্সারির জায়গায় দুধের বাজার আর কসাইখানা। দুই দোকানের মাঝখানে বেঞ্চের আকৃতির বাঁশের টং ছিল, কত অলস দুপুর গ্রামের ছেলেদেও সঙ্গে সেখানে আড্ডায় কেটেছে আমার, সেই টংয়ের অস্তিত্ব নেই। দোকানের তাকে বেনসন, গোল্ডলিফ শোভা পাচ্ছে, যেখানে কিনা স্টার সিগারেট শহর থেকে কেউ বিক্রির জন্য নিয়ে এলে বড়ে ভাইয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ত। দোকান ভরা ক্রিম-লোশন, শ্যাম্পু-সাবান। ফ্যাক্টরির উৎকট শব্দ এড়িয়ে এলে এদিকে একেক দোকানে একেক গান বাজছে। হিন্দি গানের তালে সামনে দাঁড়িয়ে মাথা দোলাচ্ছে কেউ। অরিত্র ধোঁকা খাওয়ার মতো চোখে আমার দিকে তাকায়। আমি সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে সামনে এগোই। 

বাজার এখন প্রতিদিনই বসে। সাময়িক দোকানের জায়গায় টিনের বা পাতলা দেয়ালের স্থায়ী দোকান। এত স্থায়ী দোকানের ভিড়ে আমার চেনা কেওড়া আর বয়সী কামিনি গাছের অস্তিত্ব পাই না। ওইখানটাতে চেনা গন্ধ নেই। মনটা দমে যায়। অচেনা পথ ধরে এগোনোর মতো করে অরিত্রকে নিয়ে এগোই। ধীরে ধীরে শেষ মাথার কাছে যাই, সেদিকে আরেকটা সরু রাস্তা গেছে। বাইপাস সড়ক। দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেতের উপরে ইলেকট্রিকের তার আর পোল এগিয়ে গেছে। দিনের আলো পড়ে এসেছে। কিছু মানুষের জটলা। কানে টুংটাং তার বাঁধার শব্দ আসে। চেনা শব্দ, হ্যালুসিনেশন না তো? লন্ডনে বসে যেমন প্রায় হয় আমার? 
অরিত্র, শুনতে পাচ্ছ? 
‘হ্যাঁ, বাবা!

অরিত্রের মুখে চেনা জিনিস খুঁজে পাওয়ার উত্তেজনা। আমাদের হাঁটার গতি বেড়ে যায়। জটলার ভিতরে দ্রুত ঢুকে পড়ি। একে একে ইলেকট্রিক বাতি জ্বালতে থাকে দোকানগুলোতে। উজ্জ্বল আলোয় দেখি কামারের জায়গাটা একই আছে, আমার স্মৃতিতে যা ছিল। খোবড়ানো মেঝের সামনে পা ছড়িয়ে একতারার তারটা বেঁধে নিয়ে হাত থেকে বিড়ির শ্রেষ প্রান্ত ফেলে দেয় লোকটা। গেরুয়া পাঞ্জাবীতে হাত মুছে নিয়ে তারে টোকা দেয়। হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি গায়ে কিশোর ছেলেটা কাঠের টুকরো দুটো হাতে নিয়ে পাশে এসে বসে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, লোকটা চোখ বন্ধ করে জোরে দম নিয়ে শুরু করে, ও কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে, কোনদিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে. . .      

আমার মাথা ঝিমঝিম করে। এটা কি বাস্তব! চারদিক খোলা কামারের দোকানটার ক্লান্ত হাপরের পাশে কয়লা পোড়ানোর আদি গন্ধ নাকে টানতে টানতে আমি নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখি, স্বপ্ন নয় তো? শ্রোতাদের দিকে তাকাই। দিনভর পরিশ্রমের ক্লান্তিভরা মুখে পান কিংবা তামাকের সাদা পাতা চিবানোর আয়েস। গায়ে আগের মতো পাতলা ফতুয়া নয়, রেডিমেড সোয়েটার বা ফ্লিসের জ্যাকেট। মাথায় উলের টুপি। তবে নিচে বেশিরভাগের সেই লুঙ্গিই। শীতের প্রকোপে দুই পা জড়ো করে লুঙ্গি চেপে দাঁড়িয়ে। পাশে বাতাস কেটে পিচের রাস্তা দিয়ে দ্রুতগামী বাস যায়, তখন শীতে কেঁপে ওঠে কেউ কেউ। তবে চোখ-মুখ কোঁচকানো ছাড়া আর কোনো অভিব্যক্তি নেই।
উত্তেজনায় আমি অরিত্রের হাত চেপে ধরি। গান শেষ করামাত্র অনুরোধ আসার আগে আমি কামারের সামনে এগোই। পিছন থেকে কে যেন বলে, রফিক চাচার ছাওয়াল আর নাতি আলছে। আমি কামারের কাছে ঝুঁকে আসি, ওই মুখটাই কি? গায়ে সেই একই পাঞ্জাবি আর চেক লুঙ্গি। স্মৃতির মুখটা মনে করতে পারি না। সামনের মুখটাই প্রধান হয়ে ওঠে। 

আপনি, মানে, আপনি কী করে তিরিশ বছর ধরে একইরকম, মানে, একই কাজ, একই গান. . . মানে আমি আপনাকে উনিশশ’ একাশি সালে যেমন দেখেছিলাম, অদ্ভুত ব্যাপার, আমার তো মনে হচ্ছে আমি যেন স্বপ্ন দেখছি! মিতভাষী কামার কিংবা গায়ক মৃদু হাসে। মুখের চামড়ার ভাঁজ উজ্জ্বল আলোয় স্পষ্ট। আগের সেই রহস্যময়তা খুঁজে পাই না। এর মধ্যে আমার চোখও নিশ্চয় পৃথিবীর বহু কিছু দেখেছে। 

তোমরা মনে হয় মোর বাপোক দেখছিলেন বাহে। সাতে আছিল্ মোর ছাওয়াল। বাপ মলছে মেলা দিন হওছে। এলা মুই মোর নাতিক ধরি কাম করোঁ, কাম ফুরাইলে গান গাঁও। বাপ যা শিখি গেছে, তাই করি খাঁও।  

আমার অতীত থেকে স্কুল বালকের চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। একবার তার নাতির দিকে। অবসন্নতার চিহ্ন তার মুখময়। শীতের বাতাসে শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটে কিশোর আপাদমস্তক রঙিন জ্যাকেট আর ফ্লিসে মোড়ানো, পায়ে নীল স্নিকার্স পরা আমার দৃষ্টিনন্দন ছেলের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। জানি না কোথা থেকে এক রাশ অপরাধবোধ চেপে বসল মনের মধ্যে। কেন যেন খুব লজ্জা লাগল। আর কোনো প্রশ্ন না করে অরিত্রের হাত ধরে টান দিলাম। ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে কানে এল, গানটা সে আবারো ধরেছে, ও কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে. . .
বাজার থেকে কিছু মানুষ দল বেঁধে আমার সঙ্গে হাঁটে। আমার কাজ, আয়, ব্যয় নিয়ে তাদের অসীম কৌতূহল। 
বিলাতোত থাকেন ক্যাঙ্কা বাহে? তোমাক কি কাম করি খাওয়া নাগে না সরকারে দেয়? শুনছি কারেন্ট নাকি কোনোদিনও যায় না? ওই দ্যাশের আজা আর আনির বাড়ি থেকি কদ্দূর থাকেন তোমরা? খাইতে ক্যাঙ্কা খরচ লাগে বাহে?

বহুজনের বহু প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমি বাড়ির দিকে পৌঁছাই। তবে মনের মধ্যে কামার আর তার নাতির মুখটাই স্থির হয়ে থাকে। আসার আগে আমার ছোট একটা গবেষণা নিয়ে একটা পেপার ট্রিনিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়ে এসেছি। জানি ফিরে যেতে যেতে সেখান থেকে একটা সুখবর পাবো। এইসমস্ত অর্জন আমাকে ভরিয়ে রাখে। আরো আরো নতুন অর্জনের পিছনে ছুটতে সাহায্য করে। কিন্তু জানি না কেন ওই মুহূর্তে মনে হয় সব অর্জন মিথ্যা, অর্থহীন। জীবনের পথে ছোটা, দৌড়ে যাওয়ার কোনো মানে নেই। সব সফলতা অপ্রয়োজনীয়। আমি কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গেছি, যাকে আমি আকাশচুম্বী সফলতা বলে জানি। অথচ আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে বসে থাকা খেটে খাওয়া গায়ক মানুষটি একঘেয়ে, ক্লান্তিকর জীবন যাপন করতে করতে মৃত্যুবরণ করেছে, এখন তার ছেলে আর নাতিও সেই একই পথে এগোচ্ছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই বৃত্তে আটকে আছে। 

নিজের সফলতা তো বটেই, আমার পায়ের নিচে পিচের চকচকে রাস্তা, ইলেকট্রিক বাতির ঝলমলে আলো, সমস্ত পরিবর্তন মুহূর্তে ক্লিশে লাগে। মাটির দেয়ালের জায়গায় ইটের দেয়াল যেন আমার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে। উঠোন দখল করা মাদ্রাসা-মসজিদ আমার সরল কৈশোর হারানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভাবি, ফিরে যাবো। সত্যি হলো, পালিয়ে যাবো।

দল বেঁধে আমাকে অনুসরণ করা লোকজন আমারই বর্ধিত পরিবারের। কারো ছেলের কলেজে যাওয়ার জন্য সাইকেল লাগবে। সাহায্য চাই। দূরের বড় কলেজে ভর্তি হতে পেরেছে, তার মধ্যে আমার ছায়া দেখি আমি। একজনকে সাহায্য করলে বহু মানুষ আসে একে একে। অসুস্থতা, মামলা, জমি কেনার জন্য কিছু সাহায্য, ভাঙা পাঁচিল পুনরায় তুলে বাড়ির নিরাপত্তা বিধান, ঘরের ফুটো টিনের জরুরি পরিবর্তন- মানুষের প্রয়োজনের শেষ নেই। বাবা একবার মামলা থেকে চাচাকে বাঁচানোর জন্য নিজের শেষ সম্বল জমি বিক্রি করে দিয়েছিল নামমাত্র দামে। বলেছিল, সবাই মিলে ভালো না থাকলে আর ভালো থাকা কী? একা একা পাহাড়ের চূড়ায় কেউ ভালো থাকতে পারে?
আমি হয়ত অনেক বড় হয়েছি, কিন্তু বাবার মতো বড় হতে পারিনি। অন্ধকার রাতে ছেলেকে নিয়ে শহরের দিকে রওনা দিই। হঠাৎ লক্ষ করি, গাড়িতে বসে গুনগুন করছি- ও কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে. . .  

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়