ঘুমানোর অর্থ মৃত্যু আর জেগে ওঠা হলো জীবনের স্বপ্ন দেখা: হোর্হে লুই বোর্হেস
শরীফ আতিক-উজ-জামান || রাইজিংবিডি.কম
হোর্হে লুই বোর্হেস
[হোর্হে লুই বোর্হেস-এর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আইরিশ ঔপন্যাসিক সিমা হিনি'র সাথে তাঁর কথোপকথন পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। এই সাক্ষাৎকারটি সমন্বয় করেছেন রিচার্ড কিয়ার্নি, আর অনুবাদ করেছেন শরীফ আতিক-উজ-জামান]
[জীবন-বৃত্তান্ত: ১৮৯৯ সালের ২৪ আগস্ট হোর্হে লুইস বোর্হেস জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০১ সালে তাঁর বোন নোরাহ'র জন্ম হয়। শৈশবে পিতা-মাতার সাথে বোর্হেস পালের্মোতে চলে যান, যেখানে তাঁর অনেক গল্পের চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর মাতামহী ছিলেন ইংরেজ এবং শৈশবে তিনি দুটি ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি ইংরেজি ভাষায় গ্রীক মিথলজির সারসংক্ষেপ রচনা করেন। নয় বছর বয়সে অস্কার ওয়াইল্ডের 'দ্য হ্যাপি প্রিন্স' অনুবাদ করেন।
১৯১৪ সালে বোর্হেসের বাবা দৃষ্টিশক্তি হারান, তখন তাঁর পরিবার ইউরোপ ভ্রমণে যায়। লন্ডন ও প্যারিস ভ্রমণের পর তারা জেনেভায় পৌঁছান। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তারা সেখানে আটকা পড়েন। বোর্হেস এই সময়ে ফরাসি ও জার্মান ভাষা শেখেন এবং শোপেনহাওয়ার ও নিৎসের রচনা পড়েন। তিনি ফরাসি ভাষায় কবিতা লেখার চেষ্টা করেন এবং জেনেভার একটি দৈনিকে স্প্যানিশ বইয়ের সমালোচনা লেখেন।
মাতামহীর মৃত্যুর পর বোর্হেস ইতালি ও স্পেন সফরে যান। ১৯২১ সালে তিনি আর্জেন্টিনায় ফিরে আসেন। এর দু’বছর পর, ১৯২৩ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই 'Fervor of Buenos Aires' প্রকাশিত হয়। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয় 'Moon of Opposite'। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয় 'San Martín Notebook'। এই সময়ে তিনি সাহিত্য বিষয়ক ম্যাগাজিন 'Prisma’ ও ‘Proa' বের করেন। ১৯৩১ সালে তিনি 'Ocampo Victory' প্রকাশ করেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্প-উপন্যাসগুলি রচনা করেন। ১৯৪৬ সালে পেরোন ক্ষমতায় এলে Miguel Cane লাইব্রেরি থেকে তাঁর চাকরি চলে যায়। এরপর তিনি আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়েতে বক্তৃতা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
১৯৫৫ সালে পেরোনের পতনের পর বোর্হেস জাতীয় গ্রন্থাগারের পরিচালক নিযুক্ত হন। পরের বছর তিনি জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি 'Formentor Prize' লাভ করেন, যা তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। ১৯৬৩ সালে মায়ের সাথে তিনি তৃতীয়বারের মতো ইউরোপ ভ্রমণে যান। তিনি ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড এবং স্পেনে বক্তৃতা করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি কিছুকাল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন। সেই সময় এলসা আসটিট মিলানের সাথে তাঁর বিবাহ হয়, যা তিন বছর পর ভেঙে যায়।
১৯৭৫ সালে তাঁর মা ৯৯ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। সেইসময় তিনি মারিয়া কোদামাকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতেন। ১৯৮৬ সালে মৃত্যুর মাত্র ১৪ মাস আগে বোর্হেস তাকে বিয়ে করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি সার্ভেন্টিস পুরস্কার লাভ করেন। নোবেলের সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম থাকলেও কখনো তিনি নোবেল পাননি।
[জীবন-বৃত্তান্ত: সিমাস হিনি জন্মেছিলেন ১৯৩৯ সালে। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডার্বিতে তাঁর বাবা প্যাট্রিক হিনির ৫০ একরের একটি খামার ছিল। তবে গরুর ব্যবসায়ই ছিল তাদের মূল ব্যবসা। পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাঁর এক কাকা প্যাট্রিককে এই ব্যবসায়ে নামিয়েছিলেন। তবে হিনির মা ছিলেন অভিজাত ম্যাকান পরিবারের মেয়ে। এই পরিবারের সদস্যরা লিনেন কারখানার সাথে জড়িত ছিলেন। গ্রামীণ বালক হিসেবে হিনি বেড়ে ওঠেন এবং গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনো করেন। সেই ছোট্ট বয়সেই তিনি নরম্যান্ডিতে অভিযান পরিচালনার জন্য তাদের বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে নির্মিত একটি অ্যারোড্রামে আমেরিকান সৈন্যদের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে দেখেন। এটা ১৯৪৪ সালের ঘটনা। ১৯৫৩ সালে তাঁদের পরিবার ওই খামার এলাকা ছেড়ে চলে যায়। তবে শৈশবের এই স্মৃতি তাঁর কবিতায় লক্ষ্য করা যায়।
বারো বছর বয়সে সিমাস হিনি সেইন্ট কলাম্ব'স কলেজে পড়ার জন্য একটি স্কলারশিপ পান। এই স্কুলটি ডেরি থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে অবস্থিত। এরপর তিনি বেলফাস্টে চলে আসেন এবং সেখানে ১৯৫৭ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত বসবাস করেন। পরবর্তীতে বেলফাস্ট ছেড়ে তিনি আয়ারল্যান্ডে এসে বসতি স্থাপন করেন। ১৯৮২ সাল থেকে তিনি আমেরিকায় শিক্ষকতা ক'রে আসছেন। সেইন্ট কলাম্ব'স কলেজে তিনি লাতিন ও আইরিশ ভাষা শেখেন। ১৯৬০ সালে তিনি প্রথম কবিতা লেখেন এবং তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। এরপর Sweeney Astray প্রকাশিত হয় ১৯৮২, Station Island ১৯৮৪ এবং Seeing Things ১৯৯১ সালে। এর মাঝে তিনি দুটি প্রবন্ধের সংকলনও প্রকাশ করেন। হিনির স্ত্রী মেরি ডেভলিনও একজন লেখক। আইরিশ মিথ ও লোককাহিনী নিয়ে ১৯৯৪ সালে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করেছেন। তিন সন্তান নিয়ে তাদের সুখী দাম্পত্য জীবন।
রিচার্ড কেয়ার্নি: আপনার রচনায় কল্পজগত, স্বপ্ন ও চৈতন্যহীন এক গোলকধাঁধার সাথে সার্বক্ষণিক আবিষ্টতার পরিচয় মেলে। মাঝে মাঝে আপনি সবকিছুর সাথে এতটাই একাত্ম হয়ে গেছেন যে আপনি, আপনার পাঠক ও সৃষ্ট চরিত্রের মাঝে আলাদা কোন সত্তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।
সিমাস হিনি: কল্পনা ও বাস্তবের এই মিথস্ক্রিয়া আপনার লেখনীর একটা মূল অংশ দখল করে আছে। এই স্বপ্ন-জগত কীভাবে আপনার কাজের ওপর প্রভাব ফেলে?
বোর্হেস: প্রতিদিন সকালে যখন আমি ঘুম থেকে উঠি তখনো স্মৃতিতে সজীব থাকে যে স্বপ্ন তা লিপিবদ্ধ করি। মাঝে মাঝে নিজেই ভেবে অবাক হই, আমি কি ঘুমিয়ে আছি নাকি স্বপ্ন দেখছি। কেউ কি জানতে পারে সে কখন স্বপ্ন দেখে? আমরা অন্যদের মতই সর্বক্ষণ স্বপ্ন দেখি। বার্কলি একবার বলেছিলেন যে, ঈশ্বরই আমাদের স্বপ্ন দেখান। সম্ভবত কথাটা সত্য... কিন্তু বেচারা ঈশ্বরের জন্য কাজটা কি বিরক্তিকর তাই না! প্রতিটি চায়ের কাপের প্রতিটি ফাটল ও প্রতিটি ধূলিকণার দাগ, অক্ষরমালার প্রতিটি অক্ষর ও প্রতিটি করোটিতে প্রতিটি ভাবনা―এই সবাইকে স্বপ্ন দেখাতে গেলে কি অবস্থা হয় ভেবে দেখেছেন। নিশ্চয় তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন!
সিমাস হিনি: আপনার স্বপ্নের জগত কি সরাসরি আপনার লেখার ফর্ম গড়ে দেয়? আপনি লেখায় ধার করা বিষয় বা স্বপ্নকে পাল্টে ব্যবহার করেন, আর সম্ভবতঃ বর্ণনা-দক্ষতা সেইসব চিত্রকল্পকে দেহরেখা (contour) ও ফর্ম দিয়ে থাকে, আপনার কি মনে হয়?
বোর্হেস: অজস্র এলোমেলো স্বাপ্নিক-কাল্পনিক উপাদান থেকে দরকারিটা বেছে নিয়ে পরিপাটি করে গুছিয়ে গল্প উপন্যাস লিখতে হয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেই শৃঙ্খলা আরোপিত অথবা তা ঐ এলোমেলো ভাবনাগুলোর মাঝেই নিহিত থাকে এবং কাহিনী সৃষ্টিতে বারংবার ব্যবহারের মাধ্যমে সেগুলোর গুরুত্ব বেড়ে যায়। গল্প বা উপন্যাস লেখককে সম্পূর্ণ নতুন ক'রে সুবিন্যস্ত করতে হয়। আমার ধারণা, শুধুমাত্র কোনকিছু হুবহু তুলে ধরে গল্প-উপন্যাস লেখা যায়না।
সিমাস হিনি: যা বললেন তার কিছু বাস্তব উদাহরণ দেবেন কি?
বোর্হেস: হ্যাঁ, আপনাকে আমি আমার ভাগ্নের একটি স্বপ্নের কথা বলবো যেটা সে প্রায়ই দেখতো। ছোট্ট এই ভাগ্নেটি কিছু সময়ের জন্য আমার কাছে ছিল। প্রতিদিন সকালে সে আমাকে তার রাতে দেখা স্বপ্নের কথা বলতো, কিন্তু একটা স্বপ্ন সে প্রায়ই দেখতো। স্বপ্নটা এইরকম, সে অনেক স্বপ্নের মাঝে হারিয়ে গেছে এবং শেষমেষ যেটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো সেখানে সে দেখলো আমি একটা সাদা রঙের কাঠের বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছি। এই পর্যায়ে গল্প বলা থামিয়ে সে জানতে চাইলো, 'মামা ঐ সাদা বাড়িটাতে তুমি কি করছিলে?' 'একখানা বই খুঁজছিলাম, বাবা,' তাকে উত্তরে বলেছিলাম। বাচ্চাটি সেই উত্তরে সন্তুষ্ট হয়েছিল। এই বাচ্চাটি যেমন তার স্বপ্ন থেকে বিচ্যুৎ হয়ে আমার ব্যাখ্যায় নিজের জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পেয়েছিল, সম্ভবত আমার লেখাও সেইভাবে এগোয়।
সিমাস হিনি: তাহলে স্বপ্নের উপাদান যত আছে তারচেয়ে বেশি আছে পথ যা প্রধানত আপনার কাজকে প্রভাবিত বা উৎসাহিত করে?.
বোর্হেস: আমি বলতে চাই সেখানে মাত্র দুটো পথ আছে। কয়েকবছর ধ'রে আমি যেসব স্বপ্ন দেখছি তার অনেকগুলো এক বা একাধিক ফর্মে আমার লেখায় ছাপ রেখে গেছে। প্রতীক বার বার বদলাতে পারে কিন্তু পন্থা ও কাঠামো একই রকম থেকে যায়। যেমন প্রায়ই আমি স্বপ্ন দেখি আমি একটি ঘরে আটকা পড়ে গেছি। চিকিৎসার জন্য গেছি কিন্তু আমি ফিরে এসে একটি ঘরে আটকা পড়ে গেছি। বাইরে পালাতে চাচ্ছি, বুঝতে পারছি না আমি বুয়েন্স আয়ারসে আছি নাকি মন্টিভিডিওতে? শহরে নাকি মাঠের মধ্যে? ঘরের দেওয়ালকে আমি বলছি আমার পরিচয় খুঁজে বের করতে, জানতে চাইছি এইসব প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু সেই দেওয়ালটিও আমার স্বপ্নেরই একটি অংশ। কিন্তু সেই প্রশ্নও বাকীগুলোর মত সেই ঘরের মধ্যেই ফিরে আসছে। এই স্বপ্ন আমার মাথায় সেই গোলকধাঁধার বিষয়টা ঢুকিয়েছিল যা বার বার ঘুরে ফিরে আমার লেখায় এসেছে। অন্য আর একটা স্বপ্ন আমাকে সম্মোহিত করে যেখানে একটি আয়নায় আমি অনেক মুখোশধারী মুখ দেখতে পাই যারা একটি আরেকটির উপর প্রতিস্থাপিত। আমি বারকয়েক সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলাম কিন্তু যতবার বেরিয়ে আসি ততবারই সাথে সাথে আয়নায় নতুন একটা মুখ এসে দাঁড়ায় কিন্তু সে আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়না, কিছু জিজ্ঞাসাও করেনা বা শুনতেও চায়না। তাদের পরিচয় জানা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সিমাস হিনি: মূলত, কারা মনে করেন যে, কার্ল জুং প্রতীক ও মিথের বিশ্লেষেণের উপর ভিত্তি
করে তার গবেষণা দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন? আপনি কি মনে করেন জুং-এর মৌল আদর্শই কল্পজগত ও স্বপ্নের অবচেতন জগতের যৌক্তিক ব্যাখ্যা?
বোর্হেস: আমি প্রচুর আগ্রহ নিয়ে জুং পড়েছি, তবে বিশ্বাস হয়নি। তাকে বড়জোর কাল্পনিক ও কৌতূহলী লেখক বলা চলে। তাঁর থেকে ফ্রয়েড অনেক খাঁটি কথা বলেছেন।
কেয়ার্নি: যে মতামত আপনি এইমাত্র রাখলেন তাতে স্পষ্ট যে, কল্পনার মতো মনোবিশ্লেষণেরও উদ্দীপনা সৃষ্টির ক্ষমতা আছে এবং আপনার মন্তব্য এই বৈজ্ঞানিক সত্যের কথাই মনে করিয়ে দেয় যে, সমস্ত দার্শনিক চিন্তা 'একটি অদ্ভুত কল্পনাপূর্ণ সাহিত্যের একটি শাখা'?
বোর্হেস: অবশ্যই। আমি মনে করি অধিবিদ্যা (metaphysics) কল্পনারই ফসল, যেমন কবিতা। সর্বোপরি ঈশ্বরের অস্বিত্ব বিষয়ক ধারণা কল্পনার চমৎকার এক আবিস্কার।
কেয়ার্নি: কিন্তু আমরা ঈশ্বর সৃষ্টি করেছি, নাকি ঈশ্বর আমাদের সৃষ্টি করেছেন? ঐশ্বরিক নাকি মানবিক, কোনটি আগে কল্পনার সৃষ্টি?
বোর্হেস: আহ, এই এক প্রশ্ন। হতে পারে উভয়ই।
সিমাস হিনি: সম্ভবতঃ ক্যাথোলিক ধর্ম সম্পর্কে বালখিল্য অভিজ্ঞতার কারণে কিছু টিকে যাওয়া আচার সম্পর্কে স্পর্শকাতরতা জন্মেছে। আমি এর ধর্মীয় অনুশাসন অপেক্ষা আনুষ্ঠানিকতা ও রহস্য নিয়ে কথা বলতে বেশি আগ্রহী। ‘ক্যাথোলিক ইমাজিনেশন’ বলে যার অস্তিত্ব আছে তা সাহিত্যাকর্মেও প্রকাশ পেতে পারে, যেমন―দান্তেকে উদাহরণ হিসেবে টানা যায়।
বোর্হেস: একজন আর্জেন্টিনিয়ানের ক্ষেত্রে ক্যাথোলিক হওয়া মানে আধ্যাত্মিক হওয়ার চেয়ে বেশিমাত্রায় সামাজিক হওয়ার প্রশ্ন। একজন আরেকজনের সাথে আলাদা শ্রেণি, দল বা সামাজিক গোষ্ঠীর কারণে। প্রাচ্যের ধর্ম সম্পর্কে আমার তেমন কোনো আগ্রহ ছিলনা। আমার ধারণা নারীরাই ধর্ম সম্পর্কে অধিক সচেতন। যখন আমি খুব ছোট্ট আমার মা আমাকে যীশুর নৈশভোজপর্ব উদযাপনের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন, সেখানে আমি গীর্জায় একজন ভদ্রলোককে দেখতাম। ধর্মে আমার মায়ের অগাধ বিশ্বাস ছিল। তিনি স্বর্গে বিশ্বাস করতেন। আর তা বিশ্বাস করা মানে স্বর্গ নামের বস্তুটি সেখানে আছে। যদিও আমি এখন আর ক্যাথোলিক মেডিকেল ইনস্ট্রাক্টর নই, আমি মায়ের এই বিশ্বাসের অংশীদার নই। প্রতিদিন আমি ভোর চারটেয় আমার মায়ের সেই ঘরটায় ঢুকি যেখানে ৪ বছর আগে ৯৯ বছর বয়সে তিনি মারা গিয়েছিলেন। ১০০ বছরে পা দিতে তিনি আতঙ্ক বোধ করেছিলেন। প্রতিদিন ঘরটাতে আমি যাই পবিত্র জল ছিটাতে ও তাঁর জন্য যীশুর কাছে প্রার্থনা করতে, কারণ মা এই কাজটা করার জন্য আমাকে বার বার বলে গেছিলেন। মৃত্যু থেকে অমরতা অবিশ্বাস্য বা অচেনা কোনোটাই নয়। আমার অজ্ঞেয়বাদী পিতা প্রায়ই বলতেন: 'বাস্তবতা হ'ল এই, কল্পনায় সবই সম্ভব, এমনকি একটা ত্রিনিদাদ বানানোও।' আমি এই নীতিতে বিশ্বাস করি যে, আমাদের এই মাটির পৃথিবীতে ভালো-মন্দ সবই আছে। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা। বার্নাড শ' মেজর বারবারা তে বলেছেন: আকাশের নবপরিণীতাকে আমি ফেলে এসেছি। আমার কাছে মনে হয় বৈশ্বিক ও অধিবিদ্যার প্রতি তাঁদের প্রচণ্ড আকর্ষণ ছিল। কিন্তু এই আকর্ষণ যতটা না ধর্মীয় তার থেকে বেশি নন্দনতাত্ত্বিক।
কেয়ার্নি: Tlon, Uqbar and Orbis Tertius -এ আপনি বলেছেন যে, বিশৃঙ্খলার অবিরাম পুনরাবৃত্তি ধীরে ধীরে এক অধিবিদ্যক শৃঙ্খলা তৈরি করে। একথা বলতে আপনি আসলে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন?
বোর্হেস: কথাটা লিখতে আমি খুব মজা পেয়েছি। এটাকে কোনো নীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা উদ্দেশ্য ছিলনা। সবকিছুই বিশাল এক দূরকল্পী ঠাট্টা। পুনর্জন্মের ধারণা স্টইকদের একটি অতি প্রাচীন বিশ্বাস। কিন্তু সেইন্ট অগাস্টাইন তাঁর Civitas Dei (ঈশ্বরের শহর)-এ এই বিশ্বাস নাকচ করে দেন যখন তিনি সময়ের আবর্তনশীলতার পৌত্তলিক (pagan) বিশ্বাসের সাথে, ব্যাবিলন শহরকে রৈখিক ধারণার সাথে ও সময়ের খ্রীস্টিয় ও ভবিষ্যৎসূচক ধারণার সাথে তুলনা করেন যা যীশুর শহর জেরুজালেমে রয়েছে। এই শেষ বিশ্বাসটিই পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতিতে চালু আছে যা সেইন্ট অগাস্টাইনের কাছ থেকে ধার করা। তাছাড়া আমি নিজে বিশ্বাস করি যে, প্রাচীন ধারণায় অবশ্যই কিছু থাকতে পারে, বিশ্বের এই বাহ্যিক বিশৃঙ্খলার পিছনে, যার কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি তার পিছনে কোনো লুকানো শৃঙ্খলা থাকতে পারে, যে শৃঙ্খলা সমস্থানিকতার কারণে অথবা ঘুরে ঘুরে আসে।
কেয়ার্নি: মাঝে মাঝে আপনি বলতেন এই আবর্তনশীলতা দেখা যায় না কিন্তু 'এক অত্যুচ্চ আশা' হিসেবে অবিরাম চলতে থাকবে।
বোর্হেস: বলতাম নাকি? ভালো, সত্যিই খুব ভালো। আমার মনে হয় এই বিরাশি বছর বয়সে আমি গুটিকয়েক স্মরণীয় লাইন লিখেছি আর সব 'হারিয়ে যাবে যেন কোথায়', যেমনটা আমার দাদীমা প্রায়ই বলতেন।
সিমাস হিনি: তিনি লেখার সময় আপনি কদাচিৎ কথা বলতেন। তাদের বইয়ে প্রচুর এলোমেলো বিচ্যুতি আছে। আপনার জন্য সবসময় লেখাটা কি বেশ আয়াসসাধ্য, জটিল ও বেদনাদায়ক কাজ বলে মনে হয়?
বোর্হেস: লেখাটা আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চালিত করতো লিখতে। শব্দগুলো যেন যাদুর খেলনা, প্রতি মুহূর্তে আমি যার সাথে খেলছি এবং এক ফর্ম থেকে আরেক ফর্মে বিচরণ করছি। পঞ্চাশ বছরে যখন চোখের জ্যোতি কমে এলো তখন থেকে আগের মতো আর স্বাভাবিক ছন্দে লিখে উঠতে পারিনা। প্রত্যেকটা জিনিস নির্দেশ দিতে হয়। পরে প্রত্যেকটা শব্দের থেকে সবকিছু আমার কাছে খেলার সাথী না হয়ে স্বৈরাচারী হয়ে ফিরে আসে। যখন কেউ অন্ধ হয়ে যায় তখন তাকে খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখা যায়না।
সিমাস হিনি: আমার মনে হয় লেখার টেবিলে কলম ও শারিরীক সামর্থ্যের অনুপস্থিতি এক বড় রকমের পার্থক্য গড়ে দেয়...
বোর্হেস: তা দেয়, কিন্তু অন্ধ মানুষের জন্য লেখার চেয়ে যদি পড়াটা বেশি হয় সেটা আশ্চর্যের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মাঝে মাঝে কিঞ্চিত শঠতার আশ্রয় নিতে হয়। নিজের চারিদিকে সবরকমের বই সাজিয়ে রাখি, বিশেষ করে ডিকশনারি, ইংরেজি, স্প্যানিশ, জার্মন, ইটালিয়ান, আইসল্যান্ডিক ইত্যাদি। তারা আমার চারিপাশে জীবন্ত হয়ে ওঠে, ফিস ফিস করে কানে কানে কথা কয়।
সিমাস হিনি: শুধুমাত্র বোর্হেসের পক্ষেই সম্ভব এইরকম কল্প-অভিনয়ের চর্চা করা। বোর্হেসের স্বপ্নগুলো এখনো আছে, ভালোমতই আছে যা তাঁর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কী বলবেন দৃষ্টিশক্তি হারানোর পরও গল্প-উপন্যাসের জগতে আপনার প্রয়োজনীয়তা বা টিকে থাকার সামর্থ্য বাড়ছিল?
বোর্হেস: দৃষ্টিশক্তি হারনোর পর থেকে আমার যা ছিল তা হলো স্বপ্ন দেখার আনন্দ, আমি দেখতে পাই এটা ভাবার আনন্দ। মাঝে মাঝে আমার স্বপ্নের পরিধি স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যায় এবং তারা আমার দেখার জগতে প্রবেশ করে। প্রায়ই ঘুমাতে যাবার আগে বা জেগে উঠে আমি স্বপ্নকে আবিস্কারের চেষ্টা করি, অন্ধকারে বিড় বিড় করি। এই অভিজ্ঞতা আমার বিশ্বাসকে দৃঢ় করে যে, সৃষ্টিশীল মন সতত সক্রীয়, সবসময়ই অল্প-বিস্তর ক্ষীণস্বপ্ন দেখতে থাকে। ঘুমানো হলো মৃত্যুকে আর জেগে ওঠা জীবনের স্বপ্ন দেখা। মাঝে মাঝে আমি পার্থক্য করতে পারিনা কোনটা আসলে কী- একজন আর্জেন্টাইন হিসেবে আমি স্প্যানিশ স্রোত থেকে দূরে অবস্থান করি। আমি আর্জেন্টিনায় জন্মেছি। ইংরেজ ও ফরাসী সংস্কৃতির সাথে যতটা, স্প্যানিশ সংস্কৃতির সাথেও ততটাই যোগসূত্র আছে। তাই আমি মনে করি আমি দ্বিগুণভাবে বিদেশী, তারপর স্প্যানিশ ভাষায় যখন লিখি তখন সত্যিই নিজেকে আগুন্তুক মনে হয়, এমনকি প্রধান ইউরোপীয় সাহিত্য-ঐতিহ্যের কিনারায়।
ঢাকা/লিপি