ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আন্তর্জাতিক যুব দিবস ও আজকের যুব সমাজ

কামারুজ্জামান শানিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৩, ১২ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
আন্তর্জাতিক যুব দিবস ও আজকের যুব সমাজ

যুব সমাজ, যাকে আমরা ইয়াং জেনারেশন বা ইয়ুথ নামে উপস্থাপন করি। মানুষ তার ক্ষুদ্র জীবনে নানা রকম ধাপ-উপধাপ পাড়ি দিয়ে বার্ধক্য অবধি পৌঁছায়। আর এর মধ্যে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে যৌবন। এই যৌবনে পদার্পণকারী সবাইকে নিয়েই আমাদের যুব সমাজ।

একটি দেশের সর্বোপরি সফলতার গুরু অংশ নির্ভর করে যুব সমাজের উপর। একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হয়ে থাকে এই যুব সমাজের দ্বারাই। যুব সমাজকে বলা হয় ভবিষ্যৎ গঠনের কারিগর। যৌবন এমন এক স্বনিয়ন্ত্রিত অবস্থা, যেখানে চেতনায় থাকে তারুণ্য, থাকে না কোনো পিছুটান, থাকে অসীম সাহস। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের ভাষায়, ‘এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য/ বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে।/ প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য,/ সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।’ তাইতো দেশের যেকোনো পরিস্থিতিতে যুব সমাজকেই এগিয়ে আসতে দেখা যায়। 

এ দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেমন যুব সমাজ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল, যেমনি করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে যেমন ভূমিকা রেখেছিল, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যেমন করে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তেমনি করে এ দেশকে যখন আবিষ্কার করবো এক মহা সংকটে, তখন এগিয়ে আসবে এই যুব সমাজ।

দেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপরিচালনাকারী তৈরি হবে এই যুব সমাজ থেকেই। দেশকে সার্বিক সংকট থেকে উদ্ধার করবে এই যুব সমাজই। মানুষরূপী অসুর দেশকে যখন দুর্নীতি আর অনাচারের রসাতলে গ্রাস করে নেবে, তখন সেই গভীর খাদ থেকে টেনে তুলবে এই যুব সমাজই। শুধু প্রয়োজন সেই চেতনা। হার্বার্ট হুভার যেমনটা বলেছেন, ‘যুদ্ধের ডাক দেয় প্রৌঢ় রাজা, কিন্তু যুবকরাই যুদ্ধ করে, শহীদ হয় ও দেশ স্বাধীন করে।’

বিশ্বের বর্তমান এই মহামারিতেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে আসছে যুব সমাজ। সার্বিক সংকট উত্তরণে এগিয়ে আসছে যুবকরা। কর্মহারা মানুষকে সাহায্য করা থেকে শুরু করে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সচেতনতা তৈরিতে এবং সচেতন করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে যুব সমাজ।

তবে এই চিত্রের বিপরীতে রয়েছে ভিন্ন চিত্র। যুব সমাজ যেমন একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তেমনি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তেও উপনীত করতে পারে। বর্তমান সমাজে যুবকদের মধ্যে এর প্রকোপ তুমুলভাবে বেড়ে চলেছে। সমাজে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির পেছনেও যুব সমাজই দায়ী। মাদকের ছড়াছড়ি, সন্ত্রাসী, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি অস্থিরতার পেছনে বড় একটি অংশই এই যুব সমাজ।

তারুণ্যের বিকাশ ও উন্নয়নে ১৯৯৮ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অব মিনিস্টার রেসপনসিবল ফর ইয়ুথ’ সম্মেলনে ১২ আগস্টকে ‘আন্তর্জাতিক যুব দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব করে। পরের বছর ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১২ আগস্টকে ‘আন্তর্জাতিক যুব দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই বছর থেকেই ১২ আগস্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

আন্তর্জাতিক যুব দিবসে সবার চাওয়া হোক যুব সমাজের অন্ধকার দিককে আলোকিত করে আবারও সেই বায়ান্ন-একাত্তরের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া। এই দিবসকে ঘিরে কী ভাবছে দেশের সচেতন যুব সমাজ? কথা বলেছিলাম দুইজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সঙ্গে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ইউছুব ওসমান বলেছেন, যুব সমাজ দেশের সবচেয়ে সচেতন নাগরিক। দেশের যেকোনো পরিস্থিতিতে তাদের তাদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত লক্ষণীয়৷ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ যুব শ্রেণিভুক্ত। দেশের জাতীয় ইতিহাস যুব সমাজ গৌরবদীপ্ত ভূমিকায় ভাস্বর। 

জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত প্রতিফলন যুবদের মাধ্যমেই দেখানো সম্ভব। কেননা, যুবসমাজ সবসময়ই যেকোনো দেশের সর্বাপেক্ষা বলিষ্ঠ, আত্মপ্রত্যয়ী, সৃজনশীল ও উৎপাদনক্ষম চালিকা শক্তি! এই করোনা মহামারিকালেও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে যেমন ভূমিকা রাখছে এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে করোনা মোকাবিলায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। দেশের বিভিন্ন উদ্ভাবনীমূলক প্রকল্পেও যুবসমাজের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গতিশীলতা পেয়েছে! 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ বলেছেন, বলা হয়ে থাকে, ইতিহাস লিখেন বয়স্করা কিন্তু তৈরি করেন তরুণরা। সেই হিসেবে বাংলাদেশের তরুণদেরও রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। 

দেশে গণজাগরণ মঞ্চ প্রথম যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তাও করেছিল তরুণ সমাজ। বাংলাদেশের ‘জাতীয়  যুব নীতিমালা’ অনুসারে আবার ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের ‘যুব’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ হিসেবে দেশের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশই যুব। 

তারুণ্যের এ বয়সটিকে অভিহিত করা হয় ‘যুদ্ধে যাবার সময়’ হিসেবে। একসময় ঢাল-তলোয়ার নিয়ে পরাশক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল। এখনকার যুদ্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে সব অকল্যাণের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা। জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন তরুণদের কর্মের মাধ্যমেই সম্ভব। তরুণদের অফুরন্ত সম্ভাবনাকে নিজেদের জন্য, সমাজের জন্য ও জাতির জন্য কাজে লাগানো বিশেষ প্রয়োজন। 

দুজন শিক্ষার্থীর সুচিন্তিত, নিরপেক্ষ ও তথ্যবহুল আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, আজকের যুব সমাজ সেই কাঙ্খিত যুব সমাজ নয়। যে যুব সমাজ পথে-প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান, যে যুব সমাজ পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা, সেই যুব সমাজকে গ্রাস করে নিচ্ছে মাদক, রাজনৈতিক শক্তির অপব্যবহার, অধিক মাত্রায় প্রযুক্তি নির্ভর জীবন। যুব সমাজের চেতনায় ভাঙন মোটেও কাম্য নয়। 

বাঙালির ইতিহাস, গর্বের ইতিহাস। বাঙালির সাহস, জাতীয়তাবাদ, চেতনা সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত। আসুন, আমরা সেই চেতনা আর সেই মান বজায় রাখি। ফিরে আসি আলোর পথে। ফিরিয়ে আনি অন্ধকারের চাদরে আচ্ছাদিত যুবকদের। এভাবে ফিরিয়ে আনি আমাদের সোনার বাংলাকে।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

জবি/মাহি

রাইজিংবিডি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়