ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

গবেষণায় বরাদ্দ বাড়িয়ে এর সদ্ব্যবহারের পরামর্শ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের

দেলোয়ার হোসেন শরীফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৭, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১২:৩০, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০
গবেষণায় বরাদ্দ বাড়িয়ে এর সদ্ব্যবহারের পরামর্শ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের

গবেষণার পীঠস্থান বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণা শুধু উচ্চশিক্ষার সুযোগকে বিস্তৃত করে না, ভবিষ্যতের কর্মবাজারেও দারুণ কার্যকরী। সাম্প্রতিককালে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান ও উচ্চশিক্ষার সংকট নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু অর্থাভাবে এবং প্রায়োগিক কার্যকারিতা যাচাইয়ের সুযোগের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা আলোর মুখ দেখতে কেবল পিছিয়েই যাচ্ছে।

সম্প্রতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) চলতি অর্থ বছরে ৫৩ কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে গবেষণা খাতে অনুদান দেওয়া হয়েছে মাত্র ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। যা মোট বাজেটের ২ শতাংশেরও কম। গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে এর সদ্ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

রসায়ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সৈয়দুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের মধ্যে একটি হচ্ছে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা এবং এর পর্যবেক্ষণ। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ পর্যাপ্ত না হলেও বিগত অর্থ বছরগুলোর তুলনায় বর্তমানে তা বেশি। দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে মোট ৮৪টি প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দিলেও যথাসময়ে জমা হয়েছে ৩০টিরও কম। যদিও পরবর্তী সময়ে তা বাড়িয়ে এ বছরের সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ করা হয়েছে। সুষ্ঠু নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে গবেষণা খাতে কার্যকরী ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতের জন্য সরকার যথাসাধ্য চেষ্ঠা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে আইকিউএসি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ বা আন্তরিকতা নেই। যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আলাদা আলাদাভাবে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে গবেষণা অ্যাওয়ার্ড ও প্রণোদনা ঘোষণা করে, তবে অনেকেই উৎসাহিত হয়ে এই কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হবে।

অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. তোফায়েল হোসেন মজুমদার বলেন, গবেষণা খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেটি খুবই কম। গবেষণা করতে যে সফটওয়্যারে ডেটা অ্যানালাইসিস করতে হয়, সেটার দামই ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা দিতে হয়। তারপর ডেটা কালেকশনেও অনেক খরচ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৭০-৭৫ হাজার টাকার যে ফান্ড দেওয়া হয় সেটা আসলে খুব কম।

তিনি আরও বলেন, তাছাড়া ফান্ডটা সঠিকভাবে বন্টনও করা হয় না। যেই আবেদন করে তাকে দিয়ে দেওয়া হয়। এভারেজে সবাইকে কমন একটা ফান্ড দেওয়া হয়। কেউ কাজ করে কেউ কাজ করে না। কেউ কেউ কোনরকমে কাজ করে জমা দিয়ে দেয়। অনেকে নিজেদের প্রমোশনের জন্য কিংবা বেতন বাড়ানোর জন্য ফান্ড নেন। কিন্তু যারা সত্যিকার অর্থে পরিশ্রম করে তাদের জন্য সে ফান্ডটি অপ্রতুল। দিন শেষে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা দেশের যে সামগ্রিক উন্নয়ন হওয়া দরকার সে মানের রিসার্চ হয় না।

বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা যায় যে শিক্ষক ফান্ড পান তাঁর রিসার্চ পেপার ভালো কোনো জার্নালে প্রকাশ করতে হয়। ভালো জার্নালে প্রকাশ না করতে পারলে পরবর্তী সময়ে তিনি আর ফান্ড পান না। আমাদের এখানে এ ধরনের কোন সিস্টেম নেই, বলেন তিনি।  

ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুদুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্ত গবেষণার কেন্দ্রস্থল। এর জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত কাঁচামাল ও গবেষণার  কাজের জন্য যন্ত্রপাতি। ফার্মেসি বিভাগের শুরুর দিকের ছাত্র হিসেবে বলতে পারি, এখানে গবেষণা করার মতো পর্যাপ্ত মেশিনারি তো দূরের কথা কাঁচামালও পাওয়া যায় না। তাই আমরা আমাদের গবেষণার বিভিন্ন  কাঁচামাল নিজেরাই ক্রয় করে নিতে হয়। গবেষণার বিভিন্ন কাজ বিএসসিআইআর এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে করিয়ে আনতে আমরা বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা দিয়ে আমার বিভাগের দুই তিনটা মেশিনারি ক্রয় করাও সম্ভব না। সেই সাথে তো অন্য বিভাগগুলোর কথা চিন্তা  করতে হবে।

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসাশনের দিকে দৃষ্টি আরোপ করে বলতে চাচ্ছি, গবেষণা খাতে বরাদ্দ দেওয়ার আগে গবেষণা খাতের জন্য কোন বিভাগের কি কি দরকারি কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি লাগবে তার তালিকা তৈরি করে তাতে বরাদ্দ দিলে ভালো হবে।

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান জানান, প্রথমেই আমাদের বিভাগে একটি ল্যাব খুব বেশি দরকার। ল্যাবের জন্য বাজেট আগেই হয়েছে শুনেছিলাম কিন্তু প্রয়োজনীয় জিনিশপত্র আসেনি। যেজন্য আমরা যে গবেষণাগুলো করতেছি, সেগুলো বেশিরভাগই অনুমানের উপর নির্ভর করে করা লাগছে। আমরা রিসার্চ করছি এবং আমাদের আগের ব্যাচের থিসিস চলমান রয়েছে। সেখানে ল্যাবের কাজ আছে কিন্তু সেগুলো করতে পারছি না প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে। প্রয়াজনীয় যে গবেষণাগুলো আমাদের কোর্সে আছে ল্যাবের অভাবে সেগুলো বই কিংবা শিট পড়ে শেষ করতে হচ্ছে।

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সঞ্জিত মন্ডল বলেন, পর্যাপ্ত গবেষণার সরঞ্জাম ও সামগ্রী দরকার আমাদের ল্যাবগুলোতে। গবেষণার জন্য আরও উপযুক্ত পরিবেশ দরকার। কর্তৃপক্ষের কাছে আমার অনুরোধ বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত সময় পরেও এবং ছুটির দিনগুলোতেও যাতে অন্তত একটি সমৃদ্ধ ল্যাব রুম ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, বিজ্ঞান ও গবেষণা বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ এবং বিজয়ী হওয়া প্রমাণ করে সম্ভাবনার কথা। দিন দিন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে বিজ্ঞান ও গবেষণায় এগিয়ে যাওয়ার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বানানো ড্রোন এবং রোবট সিনা।

তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মনস্ক শিক্ষার্থীরা যদি গবেষণার অনুদানের টাকার পর্যাপ্ত ব্যবহারের সুযোগ পায় তাহলে আমার বিশ্বাস গবেষণা খাতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ভবিষ্যতে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করে বাংলাদেশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক থেকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।

রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া তানজীদ বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি, সফলতা, আন্তর্জাতিক মান মূলত গবেষণা নির্ভরই। শুধু বেকার গ্র্যাজুয়েট বানানো এ প্রতিষ্ঠানের কর্ম হওয়া উচিৎ নয়। সেজন্য আমার মনে হয়, গবেষণায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে বাজেট পায়, সেটা খুবই অপ্রতুল। কমপক্ষে বাজেটের ১০-১৫ শতাংশ  উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া উচিৎ। আর আমাদের  ল্যাবগুলাতে অপ্রতুল এপারেটাস, রিয়াজেন্টের অভাব, মেশিনারিজ স্বল্পতা ইত্যাদি সমস্যা তো আছেই। আমাদের ছাত্রছাত্রীর তুলনায় মানসম্মত ল্যাবের সংখ্যাও নেই বললেই চলে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আরও সু-নজর দেওয়া উচিৎ গবেষণা খাতে।

ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলোজি বিভাগের শিক্ষার্থী জোহায়ের তানভীর রাফি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাজেটের বেশির ভাগ ব্যয় হয় উন্নয়ন কাজে। গবেষণা খাতে বরাদ্দ খুবই কম। অথচ সেখানে গবেষণাকে প্রথমেই প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ। প্রত্যেক বছরের মতো এবারও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বরাদ্দ খুবই কম। প্রযুক্তিনির্ভর ও গবেষণাধর্মী সাবজেক্ট যেমন আইসিটির মতো ডিপার্টমেন্টগুলোতে প্রধান  প্রয়োজন গবেষণা। সেখানে উপযুক্ত বাজেট, সরঞ্জামাদির অভাবে প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদের। ফলে মেধাবীরা হয়ে উঠে চাকরি নির্ভর অথবা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গমনে আগ্রহী।

কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ফজিলাতুন্নেছা সিমিন বলেন, সিএসই সম্পূর্ণ গবেষণা নির্ভর বিভাগ। এতে প্রতিটি কাজেই ল্যাপটপ, কম্পিউটার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই অনুযায়ী আমাদের প্রয়োজনীয় ক্ষমতাসম্পন্ন ডিভাইস নেই। আমরা নিজস্ব ফ্যাকাল্টিতে যাওয়ার পরও প্রয়োজনীয় ডিভাইস এখনো ল্যাবে পাইনি। তাছাড়াও প্রতিটি ব্যাচের শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুযায়ী ডিভাইস সংখ্যা খুবই স্বল্প, যা দিয়ে গবেষণা কাজ চালানো সম্ভব হচ্ছে না। শুধু কম্পিউটার বা ল্যাপটপ নয়, আমাদের অন্যান্য প্রয়োজনীয় হার্ডওয়ার এবং অন্যান্য আরও অনেক ধরনের ডিভাইস প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পেলে আমরা নেটওয়ার্কিং সাইটের কাজ, সিকিউরিটি সাইটের কাজ ইত্যাদিতে ভালো অবদান রাখতে পারব। আমাদের ডিপার্টমেন্টে অনেক ভালো ভালো প্রোগ্রামার আছে, অনেকে নেটওয়ার্ক নিয়ে অনেক ভালো কাজ করতে পারে। তাই পর্যাপ্ত বরাদ্দ পেলে আমরা ভালো কিছু করতে পারব।

কুবি/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়