ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘আমনেরা ক্যাম্পাসে নাই, বেচা-বিক্রিও নাই’ 

মানছুর আলম, কুবি  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৩, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১  
‘আমনেরা ক্যাম্পাসে নাই, বেচা-বিক্রিও নাই’ 

‘মামা ক্যাম্পাস কি আর খুলবো না? মুক্তমঞ্চে কি আর আমনেরা গান গাইবেন না? আমনেরা না থাকলে আমারও ভালো লাগে না।’ কথাগুলো বলছিলেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাদাম বিক্রেতা আব্দুল হাকিম।

সবুজে মোড়ানো লালমাটির ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখ হাকিম মামা। করোনায় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও মামার পদচারণা থেমে নেই। বন্ধ ক্যাম্পাসেও নিয়মিত বাদাম নিয়ে আসেন তিনি। কখনো অনায়াসেই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারেন, আবার কখনো তাকে পড়তে হয় প্রহরীদের বাধার মুখে। তখন বিষণ্ণমনেই ফিরতে হয় তাকে।

কথা হয় হাকিম মামার সঙ্গে। তিনি জানান, ২০১৭ সালে অভাবের তাড়নায় বাবার সঙ্গে কুমিল্লায় আসেন। এর আগে গ্রামে কৃষি কাজ করতেন কিন্তু দুর্বল শরীর নিয়ে কাঠফাটা রোদের সাথে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেননি। তাইতো নিজের জন্মভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলা ছেড়ে কুমিল্লায় আসা। শুরু করেন বাদাম বিক্রি। প্রথমে কুমিল্লা শহরের ধর্মসাগর পাড়ে বিক্রি শুরু করেন, তারপর রাণীর দিঘি, নানুয়ার দিঘি ও টাউন হলসহ পুরো শহর চষে বেড়াতেন। আয় রোজগারও হতো ভালো কিন্তু উঁচু দালানে বসবাসরত শহুরে মানুষের বাজে আচরণ, বখাটেদের টাকা না দেওয়া, গালমন্দসহ নানা অন্যায় তাকে সহ্য করতে হয়েছে। একসময় হাঁপিয়ে উঠেন গ্রামের সহজ সরল ছেলে হাকিম। খুঁজতে থাকেন একটু প্রশান্তির জায়গা।  

তারপর একদিন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে এসে অন্য সবার মতো তিনিও আসন পেতে বসেন মুক্তমঞ্চে।  উপভোগ করেন  থিয়েটার, প্রতিবর্তনের মতো সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর আয়োজিত বর্ণিল সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। সেদিনের পর হাকিমের নতুন গন্তব্য হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার; ছোট বড় ঢেউ তোলা টিলায় ভরা ৫০ একরের ক্যাম্পাসে।

ক্যাম্পাসের মনোরম পরিবেশ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতায় ভালোই কাটছিল তার দিন। কিন্তু বৈশ্বিক করোনার প্রভাবে গত বছরের ১৭ মার্চে অন্যসব প্রতিষ্ঠানের মতো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা বাড়ি চলে গেলেও থেকে যান হাকিম। ক্যাম্পাসের আশেপাশে থাকা দু’চারজন শিক্ষার্থী আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে বাদাম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে ছুটে আসেন ক্যাম্পাসে। বিকেলের সময়টা এখানেই কাটান। ছোট একটি টুকরিতে বাদাম আর মাথায় একটি গামছা দিয়ে পুরো ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ান। 

এভাবেই কিছুক্ষণ গোলচত্ত্বর তারপর মুক্তমঞ্চ হয়ে শহীদমিনারে ছুটে চলেন। তারপর সেন্ট্রাল ফিল্ডে ঘুরে ঘুরে খেলা দেখেন আর বাদামের হাক ডাকেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় সন্ধ্যাটা ভালোই কাটে তার। তারপর সন্ধ্যা হয়ে গেলে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে ভিসি বাংলো ও মেয়েদের হল হয়ে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত্ব হলের খাড়া পথ বেয়ে আবার ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। এভাবে পুরো ক্যাম্পাস কয়েকবার চষে তারপর শহরের পথ ধরেন।

বন্ধ ক্যাম্পাসেও প্রায় প্রতিদিনই দেখা মেলে হাকিমের। তিনি বলেন, মামা আমনেরা ছাড়াতো এইহানে আমার আর কেউ নাই। এহানে ব্যবসা কম হয়, এইডা ঠিক কিন্তু আমনেরার লগে থাকতে আর ভালা লাগে।  আমনেরা নাই, বেচা-বিক্রিও নাই। 

আসার সময় একমুঠো বাদাম আমাদের দিয়ে বলেন, মামা এগুন আমনেরা রাহেন, আমার পোলাডার জন্য একটু দোয়া কইরেন, যেন আমনেরার মতো বড় হইতে পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

শরীফ/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ