রাবণ আত্মমর্যাদাশীল যোদ্ধা নাকি ভয়ঙ্কর খলনায়ক
কুমার দীপ || রাইজিংবিডি.কম
রাবণ কর্তৃক সীতা হরণের সময় জটায়ুর বাধা, শিল্পী: রাজা রবি বর্মা, ছবি: উইকিপিডিয়া
শুরু হয়েছে শারদীয় দুর্গাপূজা। পুরাণে বর্ণিত আছে, রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য রামচন্দ্র দুর্গাপূজা করেছিলেন যখন, তখন শরৎকাল। তার আগে দুর্গাপূজা হতো বসন্তকালে। যেটাকে আমরা বাসন্তীপূজা বলি। রাবণ নিজেও বসন্তকালে দুর্গপূজা করতেন বলে কোনো কোনো পুরাণে উল্লেখ আছে। রাবণ যেহেতু আগেই দুর্গাকে সন্তুষ্ট করে অজেয় হয়েছিলেন, তাই তার উপরে রামের কোনো অস্ত্র কাজ করবে না। এমন ধারণা থেকে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার আগে ব্রহ্মার পরামর্শে দেবী দুর্গার পূজা করেন রামচন্দ্র।
কিন্তু শরৎকালে দেবলোকে নাকি দক্ষিণায়ন চলে। দক্ষিণায়নে দেবপূজা বিধিসম্মত নয় বিধায় পূজার আগে দেব-দেবীকে বোধন বা জাগিয়ে তুলতে হয়। রাবণবধের জন্য দেবী দুর্গাকে অসময়ে বা অকালে জাগিয়ে এই পূজা করতে হয়েছিল বলে শরতের দুর্গাপূজাকে অকাল-বোধন বলা হয়। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো, যে রামায়ণ থেকে রাম-রাবণের যুদ্ধটা আমাদের কাছে এসেছে, আদিকবি বাল্মীকি রচিত সেই রামায়ণে কিন্তু রামের দুর্গাপূজার কোনো প্রসঙ্গ নেই। তাহলে কোথা থেকে এলো এই অকাল-বোধনের ধারণা? কৃত্তিবাসী রামায়ণে অবশ্য অকাল-বোধন আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং আরও কোনো কোনো গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মহাপরাক্রমশালী রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য রাম অকাল-বোধন তথা শারদীয় দুর্গাপূজা করেছিলেন। সেই থেকে কি না জানি না, কিন্তু কালক্রমে শারদীয় দুর্গাপূজাই বাঙালি হিন্দু সমাজের সবচেয়ে বড়ো উৎসবে পরিণত হয়েছে।
বাল্মীকি রামায়ণে যেহেতু অকাল-বোধন বা শারদীয় দুর্গাপূজার প্রসঙ্গ নেই, সেহেতু বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে এই পূজার প্রচলন খুব একটা চোখে পড়ে না। বাংলা ঘেঁষা বিহার-উড়িষ্যা-আসাম এমনকি উপমহাদেশের বাইরে কোথাও কোথাও শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়, তবে সেটা হয় বাঙালিত্বের প্রভাবে, না-হয় সেখানে কিছু সামর্থ্যবান বাঙালি আছেন বলেই। কিন্তু এই নিবন্ধের প্রধান উদ্দিষ্ট অকাল-বোধন বা শারদীয় দুর্গাপূজা নয়, উদ্দিষ্ট হলো রাবণ, যার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য দুর্গার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন রামচন্দ্র কিংবা যে-রাবণ নিজেও দুর্গাপূজা করতেন বলে জানা যায়। তবে রাবণ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আমরা অগণিত সাধারণ মানুষের প্রথাগত ধারণার ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না।
রাবণ কে ? ভারতীয় পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মার পুত্র পুলস্ত্য, পুলস্ত্যর পুত্র বিশ্রবা; এই বিশ্রবা মুনির ঔরসে কৈকসী নামের এক রাক্ষসীর (রাক্ষস নামে আসলে কোনো জাতি ছিল না পৃথিবীতে, বহিরাগত আর্যরা এ দেশের আদিবাসী কালো মানুষকে রাক্ষস, অসুর প্রভৃতি অবজ্ঞাসূচক শব্দে অভিহিত করেছে ) গর্ভে জন্ম রাবণের। রাবণের অন্য দুই সহোদর কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ, সহোদরা শূর্পনখা। রাক্ষসী হলেও সুমালীকন্যা কৈকসী নাকি পরমাসুন্দরী ছিলেন। সুমালীর ইচ্ছা ছিল কন্যার গর্ভে এমন একটি পুত্র হবে যে বিষ্ণুকে দমন করতে পারবে। কৈকসীর জ্যেষ্ঠপুত্র রাবণ বীভৎস (আর্য পুরাণের মতে) রাক্ষস। তার দশটি মস্তক, কুড়িটি বাহু, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, কেশ প্রদীপ্ত, লোহিতবর্ণ ওষ্ঠ। দেবতাদের আশীর্বাদপুষ্ট কুবের রাবণের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা। কৈকসীর উদ্দেশ্য ছিল তার সন্তান যেন কুবেরের মতো ঐশ্বর্য ও তেজস্বিতা অর্জন করতে পারে। রাবণ ঘোরতর তপস্যার দ্বারা ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে দেব, দানব, দৈত্য, যক্ষ, রক্ষ সকলের অজেয় ও অবধ্য বর পেয়েছিলেন। বর পেয়ে কুবেরকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে লঙ্কার সিংহাসনে বসেন।
রাবণ
অনেক যুদ্ধে জয়ী রাবণ নিজের হাতে কৈলাস পর্বত উত্তোলন করতে গিয়ে মহাদেবের কাছে নিপীড়িত হয়ে তীব্র রব তুলে আর্তনাদ করেন বলে তার নাম হয় রাবণ। এর পূর্বে তিনি ‘দশানন’ নামে পরিচিত ছিলেন। রাবণ ছিলেন পর্বতের মতো লম্বা, ফলে হাত দিয়ে নাকি চন্দ্র-সূর্যের গতি রোধ করতে পারতেন। অনেক বেশি যুদ্ধ করতেন বলে ইন্দ্রের বজ্র, ঐরাবত এবং বিষ্ণুর চক্রসহ নানা অস্ত্রের আঘাত ছিল তার শরীরজুড়ে। এই রাবণ বোন শূর্পণখা, যাকে তিনি দণ্ডকারণ্যে বসবাসের অনুমতি দিয়েছিলেন, তার অপমানিত হওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে বনবাসী রামপত্নী সীতাকে হরণ করেন। আর সীতা হরণের ফলে রামচন্দ্র তার ভাই লক্ষণসহ অন্যান্য সহযোগী বানরসেনাদের নিয়ে লঙ্কা আক্রমণ করে রাবণকে পরাজিত ও হত্যা করে সীতাকে উদ্ধার করেন। যুদ্ধ শেষে রাবণের ছোট ভাই বিভীষণকে ( যিনি ভাইকে ত্যাগ করে রামপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন) লঙ্কার সিংহাসনে বসিয়ে দেন।
বাল্মীকি রচিত রামায়ণে রাবণ সার্বিক অর্থেই খলনায়ক, কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই যিনি যে-কোনো খারাপ কাজ করতে পারেন। অত্যন্ত অহঙ্কারী, অপরিণামদর্শী ও অবিবেচক প্রকৃতির রাক্ষসরাজ তিনি। সেখানে রাবণের নারী লোলুপতা তীব্র। দশগ্রীব রাবণকে সর্বৈব দুষ্টু লোক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাল্মীকি। কিন্তু কৃত্তিবাসের রামায়ণে রাবণ রাক্ষস হলেও তার ভেতরে মানবিক বৈশিষ্ট্য বর্তমান। তিনি বিদ্বান, পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল এবং দারুণভাবে রামভক্ত। যতটা না বোন শূর্পণখার অপমানের প্রতিশোধ নিতে, তার চেয়ে বেশি, বলা যায় রামের হাতে মরে, মুক্তিলাভের জন্যেই রাবণ সীতাকে চুরি করেছেন বলে মনে হয়। সবকিছু জেনেশুনেই রাবণ সীতাকে হরণ করে রামের শত্রু হতে চেয়েছেন। তার ভাবখানা এমন যে, রামের হাতে মৃত্যুতেই তার রাক্ষস জীবনের মুক্তি হবে; কিন্তু রাম তো খালি খালি তাকে হত্যা করবেন না, তাই যে-কোনো প্রকারে রামের শত্রু হতে হবে। রাবণ যখন মহাযুদ্ধে রামের মুখোমুখি, তখনও তিনি রামের প্রশংসাকীর্তন করছেন- কৃত্তিবাসের রামায়ণে। রাম নিজেও তাকে বধ করতে বিব্রত হচ্ছেন এমন প্রশংসাবাক্যে।
কিন্তু রাম বা রাবণ চরিত্র কোনো একটি বা দুটি উদাহরণ দিয়ে সার্বিক মূল্যায়ন ও মন্তব্য করা কঠিন। কারণ, শুধু বাল্মীকির সংস্কৃত রামায়ণ বা কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ নয়, ভারতের বিভিন্ন ভাষা ও জাতি-গোষ্ঠীর ভেতরে প্রায় ৩০০ ধরনের রামায়ণ বা রামকথা প্রচলিত বলে গবেষকরা ধারণা করেছেন। সে-সবের একটির থেকে অন্যটিতে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে রাম, রাবণ, সীতাসহ বিভিন্ন চরিত্রসমূহ উপস্থিত। কোনো কোনো জায়গায় রাবণ যেমন খল চরিত্রের, কোথাও আবার তিনি মহাজ্ঞানী ও মহাবিদ্বান হিসেবে পরিচিত। বেদ ও বৈদিক কালের মন্ত্রে লুকিয়ে থাকা রহস্য ও বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত রামায়ণগুলোতে রাম-রাবণের পরিচিতি আমাদের জানা ধারণা থেকে স্বতন্ত্র। কোনো কোনো আদিবাসী রামায়ণ অনুসারে রাবণ ছিলেন এক মহান রাজা। সসাগরা পৃথিবী তিনি শাসন করতেন। তাঁর ইচ্ছের ওপর মানব প্রজাতি, পশু-পাখি ও জিনিসের জীবন নির্ভর করতো। কোনো কোনো আদিবাসী রামায়ণে আবার রাবণের অত্যাচারী স্বভাবের কথাও বলা হয়েছে।
লঙ্কায় রাম-রাবণের যুদ্ধ, ছবি: উইকিপিডিয়া
ভারতীয় পুরাণ অনুসারে রাবণ দুর্বিনীত ও দুরাচারী এবং ভয়ঙ্কর ভিলেন বা খলনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সত্যি কি তিনি ভিলেন ছিলেন? ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের গবেষকরা কী বলেন? আধুনিক কালের যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী লেখকরাই-বা রাবণকে কীভাবে দেখতে বা দেখাতে চেয়েছেন?
একাধিক ইতিহাস গবেষক ও পণ্ডিতের আলোচনায় আমরা জানতে পারি, রামায়ণ হচ্ছে আর্যদের ভারত জয়ের কাহিনি। এই বিজয় যতটা না বীরত্বের মাধ্যমে তার চেয়ে বেশি ছল-চাতুরী ও স্থানীয় কিছু মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার দ্বারা অর্জিত। রামের লঙ্কাবিজয়ে রামের পক্ষাবলম্বনকারীদের দিকে সজাগ দৃষ্টি দিলে এ কথার সত্যতা মেলে। বাল্মীকির আদি রামায়ণে রামকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়নি। পরবর্তীকালে আর্য প্রতিভু তথা ব্যাহ্মণ্যধর্মের প্রচারকরা প্রক্ষিপ্তভাবে রামকে বিষ্ণুর অবতাররূপে প্রতিষ্ঠিত করে সীতাকে সতীত্বের আদর্শস্থানীয় কল্পনা করে ধর্ম প্রচার করেছেন। আর বাঙালির রামায়ণ বলে পরিচিত কৃত্তিবাসী রামায়ণে তো আরও অধিক ভাবাবেগ দিয়ে রাম-রাবণকে দেখানো হয়েছে, যেখানে খলনায়ক হয়েও রাবণ তুলনাহীনভাবে রামভক্ত। কিন্তু এ-সকল রামায়ণই তো বহিরাগত আর্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লিখিত। আর্যরা যাদেরকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে তাদের ক্ষমতা ও রাজ্য বিস্তার করেছিলেন, সেই দ্রাবিড়দের দিক থেকে যদি দেখা যায়, তাহলে রাবণকে কী মনে হয়?
দুর্গাপূজায় দশভূজা দুর্গার হাতে যার পরাজয়ের কাহিনিটাই মুখ্য, সেই মহিষাসুর আর্যধর্মানুসারীদের কাছে ভয়ঙ্করতম অসুর বা দানব হলেও আদিবাসী ভারতীয়দের কাছে তার পরিচয় ভিন্ন। অসুররা যে দৈত্য বা রাক্ষস ছিল না, তার প্রমাণ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড রাজ্যে এখনও ‘অসুর’ নামেই একটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস রয়েছে, যাদেরকে বিভিন্ন পুরাণে বিদ্বেষমূলক মনোভাব থেকে কথিত বীভৎস চেহারা ও ভয়ঙ্কর স্বভাবের সাথে মেলানো যায় না। অসুর ছাড়াও অন্যান্য আদিবাসীদের লোকগাথা অনুযায়ী মহিষাসুর ছিলেন তাদের মহান রাজা। অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রজাবৎসল এই রাজাকে আর্যরা পরাজিত করতে না পেরে এক গৌরবর্ণা সুন্দরী নারীকে পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধে। মহিষাসুরের রাজ্যে নারীকে অনেক সম্মান করা হতো এবং নারীর সাথে যুদ্ধ করায় মহিষাসুরের আপত্তি থাকতে পারে এটা জেনেই আর্যরা এই গৌরবর্ণা নারীকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে মহিষাসুরকে পরাজিত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন আর্যরা।
অনুরূপভাবে আমরা যদি রাবণকেও বিবেচনা করতে চেষ্টা করি, দেখা যাবে রাবণও অত্যন্ত শক্তিশালী, প্রজাবৎসল এবং স্বদেশপ্রেমী এক রাজা ছিলেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রূপকার মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’কে সামনে আনলে এই ধারণা অনেকটা মজবুত হয়। রামায়ণে প্রচলিত ভিলেন রাবণকে মধুসূদন তাঁর মহাকাব্যের নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রাবণ এখানে রাজকীয় গৌরবে অধিষ্ঠিত, আত্মমর্যাদাশীল, দেশপ্রেমিক এবং আপন সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্বশীল একজন নেতা। তিনি শুধু অতুলনীয় ঐশ্বর্যে ভাস্বরিত লঙ্কার অধীশ্বর নন, তিনি স্ত্রী-পুত্র ভাই-বোন আত্মীয়-পরিজনসহ সকলেরই কর্তা। অসম সাহসী বীরধর্মের পাশাপাশি তাঁর স্নেহ-মায়া-মমতা ও শোকাবহ সময়গুলো রঞ্জিত হয়েছে নিজস্ব হৃদয়ানুভূতির রঙে। রাজ্যের প্রদীপ একে একে নিভে যাওয়ার পর হতবিহ্বল হৃদয় নিয়েও তিনি কখনও শত্রুর সঙ্গে সমঝোতা বা পালানোর পরিচয় দেননি। মধুসূদনের রাবণ পরাজিত হয়েও শেষ পর্যন্ত অপরাজেয় থেকেছেন বলা যায়।
অশোকবনে সীতা ও রাবণের কথোপকথন, ছবি: উইকিপিডিয়া
অন্যদিকে লঙ্কা আক্রমণকারী রামকে একাধিক স্থানে ‘ভিখারী রাঘব’ বলে সম্বোধন করে তাকেই করে তুলেছেন কাপুরুষ ও ছল-চাতুরীর মাধ্যমে পররাজ্য দখলকারী। আর রাবণহত্যায় সবচেয়ে বেশি যার সহযোগিতা ছিল, সেই রাবণ-ভ্রাতা বিভীষণ তো দেশ্রপ্রেমশূন্য বিশ্বাসঘাতকের প্রতীক। বিভীষণের এরূপ নীচতাকেও প্রবলভাবে তিরষ্কার করেছেন রাবণ আর তার পুত্র মেঘনাদ। বলা যায়, প্রথাগত রামায়ণ থেকে রাবণায়নে যাত্রার এই ধারণাটি আমরা মধুসূদন দত্তের নিকট থেকে পেয়ে যাই।
আর্যদের ভারতে আগমন ও তার পরবর্তী প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের রাবণায়নের মতো বৈপ্লবিক ধারণাকে পাথেয় করে আমরা যদি রাবণ চরিত্রটিকে আধুনিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখি, তাহলে রাবণ হয়ে ওঠেন ইতিহাসের একজন শ্রেষ্ঠ স্বদেশপ্রেমিক বীর শাসক, নিপীড়িত জনগণের বন্ধু, সাম্যবাদী এবং উচ্চ-নিচ ভেদাভেদে বিলোপকারী। মূল রামায়ণে আমরা দেখেছি অত্যন্ত কাপুরুষতার সাথে রামচন্দ্র সুগ্রীবের সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্য তার ভাই বালীকে পেছন থেকে তিরবিদ্ধ করে হত্যা করছেন, লঙ্কার রাজা বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে রাবণেরই অনুজ বিভীষণকে দিয়ে অগ্রজ এবং সমগ্র রাজ্যের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র করাবার প্ররোচনা দিচ্ছেন। যুদ্ধজয়ের পরে সীতাকে তার সতীত্বের জন্য একাধিকবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হচ্ছে, রাম সীতাকে অত্যন্ত অহংকৃত ও অভদ্র ভাষায় প্রত্যাখ্যান করছেন। ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও নিজ বংশের মর্যাদা রক্ষার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে সীতাকে পুনর্বার যখন অগ্নিপরীক্ষা দিতে বলেছেন, অপমানিত সীতা মাটিতে প্রবেশ করে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।
রামের এই আচরণকে রাজশেখর বসু ‘অরামোচিত’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আমরাও আশ্চর্য হয়ে যাই এই কথা ভেবে, যে-রামচন্দ্র একদা সীতার জন্য অপরিসীম উৎসাহ আর অপরিমেয় পরিশ্রম দ্বারা অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন, সেই রামচন্দ্র সীতাকে এভাবে তিরস্কারপূর্বক বিসর্জন দিলেন ! ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যাকে ‘রামরাজ্য’ বলে গর্ব প্রকাশ করে, সেই রাজ্যে এক ব্রাহ্মণের ছেলে অকালে মারা গেলে এর কারণ বলা হয় রাজ্যে নাকি পাপাচার হচ্ছে। কী সেই পাপাচার? শম্বুক নামে এক শূদ্রসন্তান অমরত্ব লাভের জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করেছেন- এটাই নাকি পাপাচার! রামচন্দ্র নিজে সেই শম্বুককে খুঁজে বের করে মাথা কেটে দিলেন। সমস্ত ব্রাহ্মণরা এতে ধন্য ধন্য করলো আর অগস্ত্য মুনি রামকে দিব্য অলঙ্কার দান করলেন। অন্যদিকে রাবণকে রাক্ষস, দৈত্য, ভয়ঙ্কর ইত্যাদিরূপে দেখানো হলেও তিনি যে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং নারী মর্যাদারক্ষায় দৃঢ়, তার পরিচয় মেলে শূর্পণখার অপমানের প্রতিশোধস্পৃহায় কিংবা সীতাকে নিজরাজ্যে এনেও জোরপূর্বক তার শ্লীলতাহানি না-করার ভেতরে। অসহায় সীতাকে চুরি করে আনার মধ্য দিয়ে একটি ঘোরতর অন্যায় যে রাবণ করেছেন তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু সীতার মতো অপরূপা সুন্দরীকে একেবারে নাগালের ভেতরে নিয়ে রেখেও যে ভোগ করেননি, সেই যুগের প্রেক্ষাপটে এটা প্রায় অবিশ্বাস্য একটি ব্যাপার। এই একটিমাত্র কারণে অনেক সম্মানের পাত্র হয়ে ওঠেন রাবণ। এ ছাড়া, রাবণের অধিকাংশ যুদ্ধ ও সংগ্রামই যে বলশালী দেবতা ও অহংকারী ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে সেকথা বলাই বাহুল্য।
একটি কথা বলে রাখা ভালো, উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে রাবণের দোষ-ত্রুটিগুলোকে সম্পূর্ণ খারিজ করে দিতে চাই না। রাবণও যে কুস্বভাবী, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও প্রচণ্ডভাবে অপরিণামদর্শী ছিলেন, তাঁর ক্রিয়াকর্মেই এ কথার প্রমাণ মেলে। কিন্তু রাবণ কেন এমন হলেন তার অনুসন্ধানে জানা যায় শৈশব থেকেই অনাদর, অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। রাবণের জন্মদাতা পিতা বিশ্রবা আর্যত্বের অহমিকাপুষ্ট ব্রাহ্মণ ছিলেন বিধায় রাবণজননী কৈকসী ও তাঁর সন্তানদেরকে অত্যন্ত অবজ্ঞার চোখে দেখতে শুরু করেন এবং নানাভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করতেন। অন্যদিকে বিশ্রবার আরেক স্ত্রী, ভরদ্বাজকন্যা দৈববর্ণিনীর পুত্র, বৈমাত্রেয় অগ্রজ কুবের কর্তৃকও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন শৈশব-কৈশোরের রাবণেরা। পিতার হাতে মায়ের লাঞ্ছনা এবং নিজেদের প্রতি এহেন অবজ্ঞা রাবণকে ক্রুর স্বভাবের ও প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলবে এটাই তো স্বাভাবিক। এসব কারণে তাকে দোষ দেওয়া যায় বটে, কিন্তু এতে তার দুঃসাহসী বীরত্ব, স্বদেশপ্রেম, প্রজাবাৎসল্য ইত্যাদি গুণের অপলাপ হয় না কিছুতেই।
রাবণ, ১৯২০ সালে অজ্ঞাতনামা শিল্পীর আঁকা, ছবি: উইকিপিডিয়া
রামায়ণের বহুবিধ ও বিচিত্র ঘটনাপ্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘এই সমস্ত ইতিহাসকে ঘটনামূলক বলিয়া গণ্য করিবার কোনো প্রয়োজন নাই, আমি ইহাকে ভাবমূলক বলিয়া মনে করি। ইহার মধ্যে তথ্য খুঁজিলে ঠকিব কিন্তু সত্য খুঁজিলে পাওয়া যাইবে।’
এখানে ‘তথ্য’ বলতে খুব সম্ভবত ঐতিহাসিক তথ্যের কথা বলেছেন, আর সত্য বলতে জীবনের সত্য বা বাস্তব সত্য। এ কথার অনুসরণে আমরা বলতে পারি, রামায়ণ ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের অংশ, তবে সেটা সাহিত্যিক, সেখানে ঘটে যাওয়া ঘটনার অবিকল প্রতিফলন নেই; তবে বর্ণিত ঘটনাবলীর ভেতর দিয়ে আমরা সেই যুগের ইতিহাসের অনেক সত্যকেই অনুসন্ধান করে পেতে পারি। সেই অনুসন্ধানে আমরা যদি শুধু আর্য দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ ঘটাই, অন্য অনেক তথাকথিত অসুর বা রাক্ষসের মতো রাবণকেও আমরা প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার কাঠগড়ায় ফেলে ভয়ঙ্কর ভিলেন বা খলনায়ক বলে চালিয়ে দিতে পারি। অন্যদিকে আর্যদের আগমনের পূর্ব থেকেই এই মাটিতে বসবাসকারী দ্রাবিড়গোষ্ঠী তথা আদিবাসীদের দৃষ্টি থেকে যদি বলি, তবে ভিলেন বা খলনায়ক নয়, রাবণ হলো মহাশক্তিধর এক নায়ক বা রাজা, যিনি নিজের এবং রাজ্যের সম্মান বাঁচাতে প্রাণ বাজি রেখে বহিঃশত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু যদি মোটামুটি নিরপেক্ষ দৃষ্টি ধরে রাখবার চেষ্টা করে বলি, রাবণ দোষে-গুণে সমৃদ্ধ এক মানুষ, যিনি নিজের ভুলের কারণে ভয়াবহ এক যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছিলেন। আপন সহোদর ষড়যন্ত্র না-করলে সে-যুদ্ধে হয়তো তিনি বিজয়ীই হতেন। আর বিজয়ী হলে তার নামটা খলনায়কের খাতায় লিখবার সাহস পেতেন না কেউ। কারণ, আমরা তো জানি ইতিহাস বিজয়ীরাই লেখেন এবং সেখানে বিজয়ীপক্ষেরই গুণকীর্তন ধ্বনিত হয়।
অতএব, একুশ শতকের এই সময়ে বসে ইতিহাস, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিবর্তনের ধারায় রাবণকে যদি নায়ক বা খলনায়ক না-বলে আত্মমর্যাদাশীল এক অসামান্য যোদ্ধা বলি, আর্য-অনার্যের সম্মিলিত প্রয়াসে প্রতিষ্ঠিত এই সভ্যতার প্রতি বোধকরি অবিচার করা হয় না।
ঢাকা/তারা
আরো পড়ুন