করোনার চেয়ে বেশি মৃত্যু পানিতে ডুবে
জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিশু (১ থেকে ৫ বছর বয়সী) পানিতে ডুবে মারা যায় বাংলাদেশে। মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে দেশে গড়ে প্রতিদিন যে পরিমাণ মানুষ মারা গেছে, এরচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে পানিতে ডুবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে গণমাধ্যম ও উন্নয়ন যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’ পরিচালিত এক বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ২৫০টি ঘটনায় ৪৪৮ জন ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা গেছেন। এর মধ্যে ৩১৭ জনের বয়স ৯ বছরের কম। মৃতদের মধ্যে ১৬৯ জন নারী বা কন্যাশিশু। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে আগস্ট মাসে।
ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস, জন হপকিন্স ইন্টারন্যাশনাল ইনজুরি রিসার্চ ইউনিট, দি সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ (সিআইপিআরবি) এবং আইসিডিডিআরবি যৌথভাবে ২০১৬ বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করে একটি জাতীয় জরিপ পরিচালনা করে। প্রায় এক লাখ শিশুসহ মোট তিন লাখের বেশি মানুষের ওপর জরিপ চালানো হয়। জরিপর ফল ওঠে আসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আইডিআরসি প্রণীত বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভেতে। ২০১৬ সালের এই জরিপ এ সংক্রান্ত তথ্যের জন্য সর্বশেষ জাতীয় জরিপ।
দেশের ১৬টি জেলায় শহর ও গ্রামে পরিচালিত সর্বশেষ জরিপে বলা হয়- বাংলাদেশে গড়ে দিনে ৪০টি শিশু মারা যাচ্ছে পানিতে ডুবে। এর মধ্যে ৩০টি শিশুর বয়স পাঁচ বছরের কম। আর সব বয়সী মৃত্যুবরণকারীর সংখ্যা গড়ে প্রায় ৫০ জন। সে হিসেবে প্রতি ২৯ মিনিটে দেশে একজন করে মানুষ মারা যায় পানিতে ডুবে। আর প্রতি ৩৬ মিনিটে মারা যাচ্ছে একজন করে শিশু। এর আগে ২০০৩ ও ২০০৪ সালেও প্রায় একই ধরণের জরিপ হয়। তখনো একই ধরনের ফল পাওয়া যায়।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে গড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে ২৮ থেকে ৩০ জনের মতো। করোনাকে বিশ্বজুড়ে মহামারি আকারে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশেও করোনাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পানিতে ডুবে মারা যাওয়া রোধের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
হেলথ ও ইনজুরি সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, ইনজুরি বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারায় আত্মহত্যা করে ১৪.৭ শতাংশ। এরপর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪.৪ শতাংশ এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যু, মোট মৃত্যুর ১১.৭ শতাংশ। তবে এটি সব বয়সী মানুষের ওপর পরিচালিত জরিপের তথ্য। বয়স বিবেচনায় (১ থেকে ১৭ বছর) জরিপের ফল নির্ণয় করলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর গড়ই সবচেয়ে বেশি হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর তিন লাখ ৫৯ হাজার ৪০০ জন ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা যায়। এদের ২০ শতাংশের বয়স পাঁচ বছরের কম। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হারে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম। ১ থেকে ৪ বছর বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর ৪৩ শতাংশের জন্য দায়ী পানিতে ডুবে যাওয়া।
বাংলাদেশে ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সিনার্গোস জানিয়েছে, চলতি বছর এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত চার মাসে পানিতে ডুবে ১ হাজার ৯২৯ শিশুর মৃত্যু হয়।
জানা গেছে, শিশু মৃত্যুর জন্য দায়ী বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকে বৈশ্বিকভাবে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রার অন্তর্ভুক্ত করা হলেও পানিতে ডুবে মৃত্যুকে অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত করা হয়নি। ফলে অসুস্থতাজনিত কারণে শিশু মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হলেও পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার প্রতিরোধে কর্মসূচি গ্রহণ না করা হলে, সার্বিকভাবে শিশুমৃত্যুর উচ্চহার থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে পানিতে ডুবে বেশি শিশু মারা যাওয়ার বেশকিছু কারণ চিহ্নিত করা গেছে। কারণগুলো হলো- বাংলাদেশে চারদিকে প্রচুর পুকুর, ডোবা, বিল। পুকুরের সংখ্যা অনেক বেশি। ৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা পুকুরেই হয়, যেটি বাড়ির সীমানা বা ঘরের ২০ মিটারের মধ্যে। শিশুদের দেখ-ভাল করার অভাব। তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞান না থাকা। চিকিৎসা কেন্দ্রে বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি এখনো, ফলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণের অভাব রয়েছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ডুবে যাওয়া শিশুর ফার্স্ট রেসপন্স সম্পর্কে প্রশিক্ষিত ব্যক্তির অভাব রয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) পরিচালক ড. আমিনুর রহমান বলেন, শিশুমৃত্যুর ঘটনাগুলো বিছিন্নভাবে হয় বলে জাতীয়ভাবে বিষয়টির প্রভাব অনুধাবণ করা হচ্ছে না। এমনকি বিচ্ছিন্নভাবে তথ্য আসে বলে গণমাধ্যমে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে প্রকাশ পায় না। ফলে এ নিয়ে সরকারি পর্যায়ে বা জাতীয়ভাবে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ শিশুমৃত্যুর সব কারণের পরিসংখ্যান এক করে পানিতে ডুবে মৃত্যু- শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০ বছর বয়সে শিশু সাঁতার শেখার উপযুক্ত হয়। আবার শিশুদের যদি দিনের ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে পানি থেকে দূরে রাখা যায়, তাহলে বিপদ এড়ানো সম্ভব। এই চিন্তা থেকে বেশ কয়েকটি জেলায় প্রতিরোধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিআইপিআরবি। প্রতিষ্ঠানটি দেখেছে, ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে শিশুদের রাখলে ৮০ শতাংশ এবং সাঁতার শেখালে ৯৫ শতাংশ মৃত্যু কমানো সম্ভব।
গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের কান্ট্রি লিড রুহুল কুদ্দুস বলেন, সরকারের দিক থেকেও এ ধরনের প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের সাঁতার শেখার বিষয়ে আগ্রহী করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বর্ষাকালে গ্রামীণ এলাকায় বাড়িঘরের চারপাশ যখন জলমগ্ন হয়, তখন বিপদের ঝুঁকি বেশি থাকে। বিশেষ করে এই সময়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালালে অনেক শিশুকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
হাসান/সাইফ
আরো পড়ুন