ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

নবান্ন: বারো মাসে তেরো পার্বণের একটি

মাফরুহা অদ্বিতী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৭, ১৬ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৭:১৮, ১৬ নভেম্বর ২০২০
নবান্ন: বারো মাসে তেরো পার্বণের একটি

‘‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান 

সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান’’

অঘ্রাণ মাস এলে মনের মধ্যে কেবলি এই লাইন দুটি বাজে। হেমন্ত শব্দটাই যেন কেমন লিলুয়া বাতাসে মন দোলে, সোনা রাঙা ধানের শন শন আওয়াজ ভাসে। এই ঋতুতে সুখ-দুখ হাত ধরাধরি করে চলে। আসলে আগের দিনে কার্তিকের মঙ্গায় মুমূর্ষু দিনাতিপাতে ক্লিষ্ট জনপদ অগ্রহায়ণে প্রাণে যে আরাম পায়, প্রকৃতিতে সেই ছাপ স্পষ্ট। মাঠজুড়ে পাকা ধান, ধান কাটার গান বাজে আকাশে, বাতাসে ধান সেদ্ধর ঘ্রাণ। চাষি বউদের কুলায় চাল ঝাড়ার ত্রিতাল ছন্দ। সেই নতুন চালের ভাত আর পায়েসের গন্ধ আজ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেলেও সবটা নিয়ে যায়নি এখনো। 

আমরা জানি বাংলা মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রের নামানুসারে, যখন যে তারাগুলো বেশি উজ্জ্বল দেখায়, সেই তারার নামের সঙ্গে মিল রেখে সেই মাসটির নাম দেওয়া হয়েছে। তেমনই কৃত্তিকা ও আদ্রা এই দুটি তারার নাম থেকে-কার্তিক ও অগ্রহায়ণ। মরা কার্তিকের পরেই গোলা ভরা ফসলের আনন্দ নিয়ে অগ্রহায়ণের আগমন, ধান কাটার মৌসুম। কৃষকের সোনালী এই সময়কে মাথায় রেখেই সম্রাট আকবর অগ্রহায়ণ মাসকে বছরের প্রথম মাস বা খাজনা তোলার মাস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে অগ্রহায়ণ মাসের এক তারিখে নবান্ন উৎসব পালন করা হলেও গ্রামের মানুষ আমন ধান কাটা শেষ করে তবেই নবান্নের সুর তোলে। দূর-দূরান্ত থেকে ধান কাটতে আসা কৃষকদের দাওয়াত থাকে জোতদার গৃহস্থদের ঘরে। চলে ঢেঁকিতে চাউলের গুড়া তৈরির নাচন আর পিঠা পায়েসের উৎসব। এত দিনের হিসেব করে চালানো সংসারে আধপেটা খাওয়া বাচ্চাদের দল চড়ুইভাতির আনন্দে মেতে ওঠে।

এবার আসি নবান্ন উৎসবের ইতিকথায়। বারো মাসে তেরো পার্বণের উৎসবের দেশ আমাদের।  বাংলাদেশে প্রচলিত উৎসবের মধ্যে নবান্ন অন্যতম। ইংরেজিতে যাকে বলে 'New Rice Festival' নবান্ন মানে নতুন অন্ন। আমন ধান কাটার পর এই নতুন ধানের চাল দিয়ে রান্না উপলক্ষে নবান্ন উৎসব হয়ে থাকে। কোনো কোনো অঞ্চলে ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে নিয়ে ঘরের চালে বেঁধে রাখে ও সেই নতুন চালের পায়েস রান্না করে নবান্ন করে থাকে।  গবেষকদের মতে কৃষি প্রথা চালু হবার পর থেকে নবান্ন উৎসব পালন হয়ে থাকে। তবে ৪৭ এর দেশভাগের পর এই উৎসব ধীরে ধীরে কদর হারাতে থাকে।

আগের দিনে অনেক অঞ্চলেই নতুন ধানের পায়েস বা খিচুড়ি রান্না করে আগে মসজিদে  দেওয়ার পর ঘরের মানুষ খেতো। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে নানারকম প্রথা পালন করা হয় নবান্ন উৎসবকে ঘিরে, এর অন্যতম প্রথা হচ্ছে কাকবলি। একটি কলার ডোগায় নতুন চাল, কলা, নারকেল নাড়ু কাককে খাওয়াতে হয়। প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নিয়ে ছড়া আছে। ছোট ছেলে-মেয়েরা ছড়া কেটে দাড় কাককে নিমন্ত্রণ করতো। 

কাকবলির আগে আরও তিনটি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হতো- লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ, বীরবাশ। বীরবাশের প্রথা অন্য অঞ্চলে প্রচলিত না থাকলেও বরিশালে প্রচলিত। বাড়ির উঠানের মাঝখানে একটি গর্ত করা হয়। তার চারপাশে পিটুলী দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। গর্তে জ্যান্ত কই মাছ ও কিছু দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোতা হয়। সেই বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে ধানের ছড়া বাধতে হয়। এটাকে বীরবাশ বলে। এখানেই শেষ হতো না, সাধ্যানুসারে এই উৎসব উপলক্ষে প্রায় কুড়ি থেকে চল্লিশ পদের রান্না হতো। বিভিন্ন রকমের শাক রান্না করা হতো। 

গ্রামে গ্রামে এখনো এমনই চিত্র।  শহরের মানুষ অবশ্য নবান্ন উৎসবকে বইয়ের পাতায় আর টেলিভিশনের পর্দায় দেখেই অভ্যস্ত। তবে ১৯৯৮ সাল থেকে আমাদের ঢাকা শহরে জাতীয় নবান্ন উৎসব উদযাপন পর্ষদ তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। 

নবান্ন উৎসব উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন মাসব্যাপী উৎসবের আয়োজন করা হয়। এসব উৎসবে অংশগ্রহণ করে আপনিও নিতে পারেন সেই পুরনো দিনের নবান্ন উৎসবের আমেজ।

লেখক: কথাসাহিত্যিক।  

ঢাকা/মেসবাহ্/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়