ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শিক্ষার কেন গুরুত্ব নেই? 

সুমাইয়া আক্তার কেয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১১, ১৬ জুন ২০২১   আপডেট: ১৫:২৪, ১৬ জুন ২০২১
শিক্ষার কেন গুরুত্ব নেই? 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালে প্রথম চীনে গিয়েছিলেন শান্তি সম্মেলনে যোগদান করতে। তিনি সেখানে গিয়ে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলেন চৈনিকদের চারিত্রিক, অবকাঠামোগত এবং প্রশাসনিক দিক দিয়ে আমূল পরিবর্তন দেখে। মাত্র কয়েক বছর আগেও যারা আফিমখোর জাতি হিসেবে বিশ্বে পরিচিত ছিল, তারা এত দ্রুত কিভাবে নিজেদের বদলে ফেলল! বহু বছর ধরে চলা চিয়াংকাইসেক সরকারের স্বৈরশাসন থেকে কিভাবে মাও সেতুং সরকার এত দ্রুত নিখুঁত একটা সিস্টেমের প্রবর্তন করলেন? 

চীনের হাট-বাজারে কয়েক দিন ঢু মেরেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন তাদের এই বদলে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে তাদের মধ্যে নতুন করে জেগে ওঠা জাতীয়তাবোধ। হ্যাঁ, মাও সেতুং সরকার তার নিজ জাতির মধ্যে জাতীয়তাবোধ এবং সরকারের প্রতি আস্থাবোধ জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু চীনের সেলুনে গিয়ে দেখলেন সবাই দাড়ি কামায় খুর দিয়ে কিন্তু পাকিস্তানিরা দাড়ি কামায় ব্লেড দিয়ে আর চীন দেশেও সেসময় ব্লেডের আমদানি অসম্ভব ছিল না। তাহলে সমস্যাটা কী? আসলে সমস্যা অন্য জায়গায়, চৈনিকরা নিজেদের উৎপাদিত পণ্য ছাড়া অদরকারি কোনো বিদেশি পণ্য ব্যবহার করবে না বলে শপথ নিয়েছে। 

এবার আমাদের কথা একবার ভাবুন! আমরা স্নো কিনি ইন্ডিয়ান, জামা কিনি পাকিস্তানি লোন, জুতা কিনি এটা-সেটা ইত্যাদি। এসব বড় বড় ব্র্যান্ডের ভিড়ে বাংলার ঐতিহ্য বড়ই পানসে। সেগুলো স্থান পায় শুধু বছরে কয়েকটা উৎসবে। আসলে আমরা জাতি হিসেবে বাঙালি হলেও আমাদের কোনো জাতীয়তাবোধ নেই। তাই কারো মতের সঙ্গে মতের অমিল হলেই আমরা হরহামেশাই গালি দিয়ে বলি ইন্ডিয়ার দালাল, পাকি বীর্য ইত্যাদি। বাংলার মানুষ হয়েও আমরা কেউ ওই পন্থী আবার সেই পন্থী। আমার প্রশ্ন, তাহলে বাংলাদেশি কারা? 

যাই হোক, বঙ্গবন্ধু যতই চীনকে দেখলেন, ততই চৈনিকদের সততা, ডিসিপ্লিন দেখে মুগ্ধ হলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য অনু্যায়ী সব জাতিরই নাকি একটা প্রিভিলেজ ক্লাস থাকে। চৈনিকদেরও ছিল৷ আর তাদের প্রিভিলেজ ক্লাস ছিল শিশুরা অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা এবং তাদের সর্বোচ্চ ইনভেস্টমেন্ট ছিল এই খাতের উপর। হ্যাঁ চীন সরকার শিক্ষার মূল্যটা যথার্থই বুঝতে পেরেছিল। তাই শিশু শিক্ষার্থীদের সেভাবেই গড়ে তোলার জন্য আলাদা খাবারেরও বরাদ্দ করেছিলেন। সাংস্কৃতিক সব কর্মকান্ডে তারা শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। 

চীনা স্কুলগুলোতে বালক-বালিকারা একই পোশাক পরতো। আর এটা নারী-পুরুষ একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক বড় প্রেরণা। যা আমরা একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কল্পনা করতে পারি না। যাই হোক, শান্তি সম্মেলনের অতিথিদের ফুল দিয়ে, গান গেয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল এই চীনা প্রিভিলেজ ক্লাস শিক্ষার্থীরাই। শিশুদের মননে মগজে ডিসিপ্লিন, সততা, সমতা শুরু থেকেই ঢুকিয়ে দেওয়ার একটা সুন্দর প্রচেষ্টা। আর ওই সময় চীন সরকার সঠিক পথে হেঁটেছিলেন বলেই বিশ্বব্যাপী চীনের জয়জয়কার আমরা এখন দেখতে পাই। 

চীনের কথা বলছি দেখে অনেকেই হয়তো মনে মনে রাগ করে বলছেন ‘আমরাই তো উন্নয়নের রোল মডেল। বিশ্ব এখন আমাদের অনুসরণ করে। আমাদের শিক্ষার হার তো হু হু করে বেড়েই চলছে।’ হ্যা কথা সত্য, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিবিএস এর জরিপ অনুযায়ী আমাদের বর্তমান শিক্ষার হার ৭৪.৭ শতাংশ, যা ২০২০ এ ছিল ৭৩.৯ শতাংশ। এছাড়া শিক্ষার্থীদের আমরা ব্যাপক প্রিভিলেজ দেই। শিক্ষার্থীদের সুরক্ষিত রাখার জন্য আমরা কত পদক্ষেপ নিচ্ছি। করোনাকালে অফলাইন ক্লাসে জীবনের ঝুঁকি আছে, তাই শিক্ষামন্ত্রী বললেন, ‘আমরা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না। শিক্ষার্থীরা কি পারবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিদিন ক্লাস করতে?’    

আমার আফসোস এখানেই। আমরা কেন ধরে নিচ্ছি শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারবে না? একটা শিশু এক থালা কাদার মতো। তাকে আপনি যেভাবে গড়ে তুলবেন, সে সেভাবেই গড়ে উঠবে। তাই করোনাকালীন ডিসিপ্লিন শিক্ষাটা হতো আমাদের শিশুদের জন্য সবচেয়ে সময়োপযোগী শিক্ষা। নিউ নর্মালটাকে মেনে নিয়েই অন্য সেক্টরের মতো চলতে পারত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মননে ও মগজে খুব সুন্দর করে প্রতিদিন কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দিতে পারতেন স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো। এতে ভবিষ্যতে আমরা হয়তো ডিসিপ্লিনড একটা প্রজন্ম পেতাম। 

দায়িত্বশীলরা চিন্তাই করছেন না এই দীর্ঘ মেয়াদি বন্দিদশা এবং তারা এসব বুলি শিক্ষার্থীদের মনে কতটা বিরূপ প্রভাব ফেলে। কয়েকদিন আগে একটি বেসরকারি টিভির প্রতিবেদনে দেখা গেলো, পাবনা জেলার একটা কিন্ডার গার্টেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দেওয়া হয়েছে, অভিভাবক এবং সহকারী শিক্ষকদের চাপে। এক অভিভাবক বললেন দীর্ঘ দিন ঘরে বন্দি থেকে তার বাচ্চা এখন পাগলের মতো আচরণ করছে। তাই তিনি বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন। প্রধান শিক্ষক বললেন, স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষকেরা আর্থিক সংকটে পড়ে গেছেন এবং অভিভাবকেরা চাপ দিচ্ছেন তাই স্কুলটি খুলে দেওয়া হয়েছে। অথচ শিক্ষামন্ত্রী বলছেন এক বছর লেখাপড়া না করলে কিছু হবে না। 

অনলাইন, টিভিতে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে, অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। দুঃখের বিষয় গুগলে সার্চ দিলে সব অ্যাসাইনমেন্টের উত্তর পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীরা এজন্য বই ঘাটার প্রয়োজন মনে করে না। অনলাইন ক্লাসের সুবাদে ইন্টারনেট প্রযুক্তিতে পারদর্শী হয়ে তারা পাবজি, ফ্রি ফায়ার গেমে আসক্ত হচ্ছে। এজন্য দায়িত্বশীলরা উঠে পড়ে লাগলেন এসব বন্ধ করতে অথচ এর আগে কি শহরের প্রতিটা শিক্ষার্থীর সুষ্ঠু বিকাশের জন্য একটা খেলার মাঠ নিশ্চিত করতে পেরেছেন? অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। গ্রামের প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য কি পেরেছেন একটা ডিজিটাল ডিভাইস এবং একটা টিভির ব্যবস্থা করতে?

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা গেছে, করোনাকালে শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে গেছে। নিম্ন আয়ের মানুষ সন্তানদের পড়াশোনার পরিবর্তে কাজে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন পরিবারকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। এছাড়া বেকারদের হাজার হাজার নিয়োগ পরীক্ষা আটকে আছে সরকারের তথাকথিত নিয়মের প্রহসনে। কিন্তু এসব দায়িত্বশীলদের ভাববার বিষয় নয়। তারা অন্য কিছুতে ব্যস্ত। 

করোনার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেও শিক্ষার তেমন একটা গুরুত্ব নেই। তাই আশ্চর্যজনকভাবে করোনাকালে শিক্ষার হার বাড়লেও আমরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি না। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে পড়াশোনা করেও আমরা চাকরি পাই না বা স্বাবলম্বী হই না, চৈনিকদের ধারে কাছেও যেতে পারি না।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

জবি/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়