ঢাকা     সোমবার   ০৬ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

ঢামেকে চালু হয়নি ডেঙ্গু কর্নার, ভোগান্তিতে রোগীরা

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৩০, ১৯ জুলাই ২০২৩  
ঢামেকে চালু হয়নি ডেঙ্গু কর্নার, ভোগান্তিতে রোগীরা

ডেঙ্গু পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, দেশের সব সরকারি হাসপাতালে আলাদা ডেঙ্গু কর্নার স্থাপন করা হবে। অধিদপ্তররের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, সব সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন।

বুধবার (১৯ জুলাই) সরেজমিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের ছয়তলায় গিয়ে দায়িত্বরত চিকৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে এখনও ডেঙ্গু কর্নার চালু করা হয়নি। চালু করার কোনো উদ্যোগও নেই। ঢামেকে ৬০১ ও ৬০২ মেডিসিন ওয়ার্ডের অন্য রোগীদের সঙ্গেই ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এতে নানারকম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ডেঙ্গু রোগীসহ সব ধরনের রোগীরা।

আরও পড়ুন: ডেঙ্গুতে একদিনে রেকর্ড ১৯ জনের মৃত্যু

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সবসময় রোগীদের ভিড় থাকে। সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রোগীদের ঢামেকে রেফার করার ফলে এ চাপ বাড়ছে। ডেঙ্গুর মৌসুমেও অন্যসব রোগীদের সামলাতে ব্যস্ত থাকতে হয়। সিটের অতিরিক্ত প্রচুর রোগীকে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকৎসা নিতে দেখা গেছে। এত বেশি রোগীকে চিবিৎসা সেবা দিকে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।

রোগীদের ভোগান্তিরও শেষ নেই। মেঝেতে একটা বিছানার জায়গা পেতেও তাদেরকে ‘ম্যানেজ’ করতে হয় বলে জানিয়েছেন একাধিক রোগী ও তাদের স্বজনরা। 

ঢামেকের প্যাথলজি মানেও ভোগান্তি। এছাড়া টাকা জমা দেওয়া, রিসিট নেওয়া, স্যাম্পল দেওয়া, রিপোর্ট নেওয়া-সব কাজেই সবাইকে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়াতে হয়। একেকটা কাজে এক-দুই ঘণ্টাও লেগে যায়। রোগীর অবস্থা যত খারাপই হোক ডেঙ্গু টেস্ট করতে, রক্ত পরীক্ষা করতে এসব ঝামেলা পোহাতে হয়।

কর্তব্যরত একজন চিকৎসক নাম না বলার শর্তে জানান, জুলাইয়ের শুরু থেকে এখানে ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেশি। প্রতিদিনই ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তরা এখানে চিকিৎসা নিতে আসছেন। এত রোগীর জন্য স্বাভাবিকভাবেই আলাদা ব্যবস্থাপনা দরকার। কিন্তু সেরকম কিছু এখানে করা হয়নি।

এই চিকিৎসক বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা কর্নার করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নির্দেশনা দিলেও এ হাসপাতালে এখনও হয়নি। রোগীর চাপে বাধ্য হয়ে আমরা মেডিসিন ওয়ার্ডে অন্য রোগীদের সঙ্গেই ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছি।

বারান্দায় অবস্থান নেওয়া এক ডেঙ্গু রোগীর স্বজন মারুফ হোসেন বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা না থাকায় টিকিট কাটা থেকে শুরু করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব কাজে সিরিয়াল ধরে করতে হচ্ছে। চিকিৎসা পেতে অনেক বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। যার ফলে কোনো কোনো রোগীর প্লাটিলেট দ্রুত কমে গিয়ে শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে।

রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢামেকে সঠিক, উপযুক্ত ও দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পেয়ে হতাশ অনেক রোগী। কেউ কেউ এই বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা বলছেন, সরকার বলার পরও এখানে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা কর্নার কেন করা হচ্ছে না? ডেঙ্গু রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোও এখানে আলাদাভাবে করার ব্যবস্থা করা যেত।

মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) বিকেল পর্যন্ত ঢামেক হাসপাতালের ৫০০ শয্যার মেডিসিন বিভাগে শুধু ডেঙ্গু রোগীই ভর্তি আছেন ২২৭ জন। তবে ভর্তির বাইরেও এই বিভাগের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভেতরে-বাইরে অনেক রোগী অবস্থান করছেন। তাদের সবাই ‘নন-এডমিট’ রোগী হিসেবে সেখানে অবস্থান করছেন। ফ্লোর, বারান্দা, সিঁড়ি, করিডোরসহ নানা জায়গায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বেড পেতে অবস্থান করে আছেন রোগী ও স্বজনরা।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ঢামেক নতুন ভবনের প্রতিটি ফ্লোর রোগী ও স্বজনে ঠাসা। বেড তো খালি নেই-ই, হাসপাতালের বারান্দা, করিডোর ও সিঁড়ির নিচেও রোগীরা অবস্থান নিয়েছেন। যাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক আবার ডেঙ্গু রোগী।

একজন ডিউটি ডাক্তার জানান, অফিসিয়াল হিসাবের বাইরে অন্তত পাঁচগুণ বেশি রোগী তাদের প্রতিদিন হ্যান্ডেল করতে হয়। ভর্তির চেয়ে অ-ভর্তি রোগীর সংখ্যাই বেশি। তাদের সবাইকে  চিকিৎসা দিতে হয়। সকাল থেকে তিনি নিজে ৫০-৬০ জন রোগীকে হ্যান্ডেল করেছেন বলে জানান এই চিকিৎসক। 

ভোগান্তির নাম রক্ত পরীক্ষা
প্যাথলজি বিভাগের সামনে গিয়ে দেখা যায়, রোগী ও স্বজনদের দীর্ঘ লাইন। সিরিয়াল নিয়ে সারাক্ষণ হট্টগোল লেগে আছে। দেড় দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকে টেস্টের স্যাম্পল দিতে পারেননি বলে অভিযোগ করেন। ক্লিনিকাল প্যাথলজি বিভাগের সামনে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা রোগীর স্বজন রবিউল হোসেন বলেন, এখানে সব সেবাই পাওয়া যায়, তবে তা অতিরিক্ত টাকা খরচ করলে। টাকা দিলে লোক আপনার রোগীর স্যাম্পল কালেকশন করে নিয়ে যাবে, রিপোর্টও দিয়ে যাবে।

এসব বিষয়ে জানকে চাইলে প্যাথলজি বিভাগের এক কর্মকর্তা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ডেঙ্গুর জন্য এখানে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৩০০ স্যাম্পল টেস্ট করা হয়। একজনের একবার টেস্ট করা হলে ৪/৫ দিন আগে আর সিরিয়ালই পাওয়ার সুযোগ নেই। রোগীর অনেক চাপ, ঢাকার রোগীদের পাশাপাশি সারা দেশের রোগীরা এখানে আসেন।

নরসিংদীর মাধবদী থেকে গত শনিবার রবিউল হোসেন (৪৪) নামের এক রোগী এসে ভর্তি হয়েছেন। বেড পেয়েছেন গতকাল মঙ্গলবার। তিন দিন ফ্লোরেই বিছানা পেতে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। 

রবিউল বলেন, ডেঙ্গুতে তার প্লাটিলেট কমে এখন ৩০ হাজার হয়। ডাক্তাররা বলছেন সমস্যা নেই, ঠিক হয়ে যাবে। স্যালাইন দিয়েছেন। মুখের ওষুধও দিয়েছেন। এখন প্লাটিলেট বেড়ে হয়েছে ৮০ হাজার।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক নিয়মিত মেডিসিন ওয়ার্ড পরিদর্শন করেন বলে জানান রোগী ও চিকৎসকরা। এই বিভাগে চিকিৎসকরাও নিয়মিত রাউন্ডে আসছেন।

একজন রোগীর স্বজন বলেন, এখানকার চিকিৎসরা বেশ ভালো। শয়ে শয়ে রোগী, তারপরও তারা ঠিকভাবে চিকিৎসা দিচ্ছন। তবে নার্সরা রোগীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে, ডাকলে আসে না। রোগী বমি করলে নার্সরা কোনো সহযোগিতা তো করছেই না, উল্টো বমির জন্য রোগীকে বকাবকি করে। আয়া বুয়ারাও তেমন কাজ করেন না, তবে টাকা দিলে কাজ করে দেন।

সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, ঢামেকে ডেঙ্গুর জন্য কোনো কর্নার করিনি। কোনো পরিকল্পনাও নেই। মেডিসিন রোগীদের সঙ্গেই ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা চলবে।

মেঝের রোগীরা মশারি টানাতে পারছে না, মশার মাধ্যমে অন্য রোগীদেরও ডেঙ্গু ছড়াতে পারে- এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়-এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে পরিচালক বলেন, বাসায় মশারি লাগানো দরকার, হাসপাতালে জরুরি নয়। আক্রান্ত হওয়ার পর মশারি দিয়ে কী হবে? তবে বেডে থাকা ডেঙ্গু রোগীদের মশারি লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ডিএনসিসির যে ডেডিকেটেড হাসপাতাল আছে, সেখানে যাওয়ার অনুরোধ জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক।

/মেয়া/এসবি/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়