ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হো চি মিন থেকে হ্যানয়ের পথে

ফেরদৌস জামান    || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৭, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৩:০৫, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১
হো চি মিন থেকে হ্যানয়ের পথে

বিজন দ্বীপের স্বরলিপি: ৭ম পর্ব

যথারীতি পরের দিনও খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। ঘরের অন্যান্য বাসিন্দারা তখনও বিভোরে ঘুমাচ্ছে। পাশের বিছানার আফ্রিকান যুবক নাকের গর্জন ছড়িয়ে দিয়েছে ঘরের কোণায় কোণায়। এই মুহূর্তে খোলা ছাদই হতে পারে সর্বাপেক্ষা উত্তম জায়গা।

অন্ধকার কেটে যেতে বেশি দেরি নেই। বেরিয়ে আসবে আর একটা নতুন দিনের সূর্য। আপাতত সেই অপেক্ষা। বের হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে কয়েক মিনিট পর আবারও ছাদে ফিরে দেখি শহরের বাতিগুলো একটা-দুটো করে নিভতে শুরু করেছে। পথের মধ্যে নেমে এসেছে হাতে গোনা কয়েকজন ভ্রমণকারী; গন্তব্য রিভার সাইড। কিছুক্ষণ পর ধীর কদমে নেমে পড়লাম। হোটেলের দরজা তখনও খোলা হয়নি। চোখে ডলা দিতে দিতে একজন এসে খুলে দিলেন। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম দূরে, যেখানটায় বিরাজ করছে আরও বেশি নীরবতা।

শহরটা যেন থমকে আছে। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে, পাখি ডেকে যাচ্ছে, গাছ থেকে দু’একটা পাতাও ঝরে পড়ছে। সকাল সকাল প্রকৃতির কাছ থেকে এমন সম্ভাষণ পেয়ে মনের মধ্যে ফুরফুরে প্রশান্তি অনুভূত হলো। এগিয়ে চললাম আরও কিছুটা পথ। এবার কিছু খাওয়া দরকার। পার্কের মতো খোলা জায়গা, পাশেই একটা টং দোকান। কাছে গিয়ে দেখি সত্ত্বাধিকারী একজন মাঝবয়েসী নারী। কফি তার দোকানের প্রধান পণ্য। গোছগাছ এখনও শেষ হয়নি। বিনয়ের সঙ্গে অপেক্ষা করতে বলে দ্রুত বাকি কাজ সেরে নিলেন। দিনের প্রথম খদ্দের পেয়ে তার মধ্যে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকলেও আগোগোড়ায় পেশাদারিত্বের বহিঃপ্রকাশ। বরফ কুচি মেশানো থকথকে এক গ্লাস কফি মাত্র পঞ্চাশ সেন্ট। পরিমানে এক লিটারের কাছাকাছি। কফির গ্লাস একটা হাতলওয়ালা পলিথিনের ক্যারিয়ারে ঢুকিয়ে দিলে গলা পর্যন্ত এসে ঝুলে থাকল। তাতে করে বালতির মতো ঝুলিয়ে সারা শহর ঘুরে ঘুরে বা যতক্ষণ খুশি সময় নিয়ে পান করা যায়। শহরের ব্যস্ত লোকেরা যাদের কোনো এক জায়গায় বসে কফি পান করার সময় নেই তাদের হাতে এমন হাতলওয়ালা পানীয়ের গ্লাস ঝুলতে দেখা যায়। কেউ কেউ তো মোটরসাইকেলের হ্যান্ডেলে গ্লাস ঝুলিয়ে ছুটছে।

এবার গ্লাসের ঢাকনির ফুটা দিয়ে ডুবানো নলে একটা করে টান দিতে দিতে শেষবারের মতো রিভার সাইডে গিয়ে উপস্থিত হলাম। এ বেলায় সমবেত হওয়া প্রায় সব মানুষ শরীরচর্চার নানা কসরত করায় ব্যস্ত। কবুতরের দল বরাবরের মতোই  ছিটিয়ে দেওয়া দানা খুঁটে খাওয়ায় মগ্ন। হাঁটাহাঁটির ফাঁকে কোথাও দু’দণ্ড বসতেই কবুতরের দানা খাবার বিক্রেতা এসে অনুরোধ শুরু করে দেয়। অবশেষে এক কিশোরের কাছ থেকে কিনে নিয়ে সামান্য কয়টা ছিটিয়ে দিতেই মুহূর্তে এক পাল কবুতর এসে ঘিরে ধরল। কিছুক্ষণের মধ্য শেষ হয়ে গেল সমস্ত খাবার। ফিরে এসে নাস্তা খেয়ে উঠে পড়লাম হোটেলে।

ফ্লাইট বেলা সোয়া দুইটায়। মোটরসাইকেল চালককে আগের রাতেই বলা আছে সময় মতো এসে উঠিয়ে নেবে। সোয়া নয়টা বেজে গেল কিন্তু তার পাত্তা নেই। আর অপেক্ষা না করে চেক আউট করলাম। ফুটপাথ ধরে বোধহয় দুই থেকে তিন মিনিট এগিয়েছি। দেখি ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে আমার মোটর সাইকেল। কথা না বাড়িয়ে চেপে বসলাম। দক্ষতার সঙ্গে সঠিক সময়ের মধ্যেই বিমানবন্দরে পৌঁছে দিলো সে। এরপর অপেক্ষার পর্ব। টার্মিনালের যতটুকু ঘুরে দেখা যায় তা শেষ। ছোট্ট টার্মিনাল ভবন তবে পরিপাটিতে ষোলআনা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বেলাতেও ছাড় নেই। পানির পিপাসা নিবারণে খুঁজে পেলাম চমৎকার এক বন্দোবস্ত। ট্যাপের নকশাটাই এমন যে, নল কিছুটা উঁচুতে তুলে আবার খানিকটা বাঁকানো। আশপাশে কোনো পানপাত্র রাখা নেই। কোনো প্রকার কালক্ষেপণ হওয়ার আগেই আবিষ্কার করলাম, কল চালু করে মুখটা পানির ধারার কাছে নিয় কাজ সারতে হবে।

ভাবলাম পিপাসা যখন নিবারণ হলো তখন কন্টেইনার ভরিয়ে নিলে সমস্যা কোথায়? তাতে বরং পরের বার উঠে আসতে হবে না। এই গোলটা বাঁধল! কন্টেইনার উছলে সামান্য পানি নিচে পড়তেই মুছুনি নিয়ে মুহূর্তেই একজন হাজির। হাসি মুখে মুছে পরিষ্কার করে দিলেও তার হতাশা অথবা বিরক্তির পরিমাণটা খুব সহজেই অনুমান করা গেল। হয়ত মনে মনে ভাবল, হায় খোদা! এরা কবে সভ্য হতে শিখবে! গুরুতর কোনো অপরাধ আমি করিনি, তারপরও মনে হলো এই সব ছোট ছোট বিষয়ও সাবধানতার সঙ্গে করা উচিত। একটা ধন্যবাদ জানালে পুনরায় মুখে হাসির ছবি ফুটিয়ে তুলে বিদায় হলো।

পরপর দুইটা ফ্লাইট ভিয়েতনাম এয়ারলাইন্সের। নতুন একটা এয়ারলাইন্সের অভিজ্ঞতা নিতে যাচ্ছি, সে উপলক্ষে আমার মন খানিকটা উতলা। কাউন্টারে ব্যাগ জমা দিয়ে আরও কিছুটা সময় অতিবাহিত করার পর শুরু হলো ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা। এরপর সাধারণত যা হয়, শপিং মলে ঘুরে ঘুরে সময় পার করা। বিদায় কম্বোডিয়া, বলে জাহাজে উঠে পড়লাম। বাজেট এয়ারলাইন্স, সুতরাং অনেক কিছুই আশাতীত। তাই বলে আসনের সামনে একটা মনিটরও কি থাকবে না? ক্ষুধায় পেট মেরুদণ্ডের সঙ্গে ঠেকে গেছে। ভেবেছিলাম ফ্লাই করার পর কিছু না কিছু নাস্তা দেওয়া হবে। বাস্তবে ঘটল তার উল্টো। পরিবেশন করা হলো শুধু এক বোতল পানি। সংক্ষিপ্ত যাত্রা, গন্তব্য ‘হো চি মিন সিটি’। ক্ষুধার কথা ভুলে গিয়ে বোবার মতো বসে থাকলাম।

হো চি মিন থেকে পরের ফ্লাইট রাজধানী হ্যানয়ের উদ্দেশ্যে। ফ্লাইট ট্রান্সফারের জন্য হাতে সময় মাত্র দুই ঘণ্টা। ব্যস্ত বিমানবন্দর হো চি মিন। একসঙ্গে কতগুলো ফ্লাইট অবতরণ করেছে কে জানে? মানুষে গিজগিজ করছে। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে দীর্ঘ একেকটা লাইন। সকলের মতো আমিও একটা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছি। কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করি পাশের লাইনটা দ্রুতই অনেক ছোট হয়ে এসেছে। সুযোগ বুঝে লাইন পরিবর্তন করে সেখানে যুক্ত হলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি পাঁচ সেকেন্ড পরই আমার সাবেক লাইনের মাঝ থেকে ভেঙে নিয়ে তৈরি করা হলো আরো একটা লাইন। আফসোসের অন্ত রইল না। আগের জায়গায় থাকলে নিশ্চিত সামনের দুই-তিনজনের মধ্যে থাকতাম! অনেকটা সময় এখানেই চলে গেল। ব্যাগেজ সংগ্রহের পর যেতে হবে অন্য টার্মিনালে। ট্রলিতে ব্যাগ চাপিয়ে একরূপ দৌঁড় দিতে হলো। ইতোমধ্যে সাউন্ড সিস্টেমে ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে। বারবার যে দুটি নাম ধরে ডাকা হচ্ছে তার মধ্যে দ্বিতীয়টি আমার। দ্রুত আনুষ্ঠানিকতা সেরে একেবারে শেষ মুহূর্তে গিয়ে জাহাজে আরোহণ করলাম। আর কয়েক মিনিট দেরি করলে নির্ঘাত ফ্লাইট মিস করতে হতো।

ভেবেছিলাম হো চি মিন নেমে খেয়ে নেব। তাড়াহুড়োর কারণে তা আর হলো কই? এমন পরিস্থিতিতে জাহাজ থেকে পরিবেশিত খাবারের অপেক্ষা ছাড়া বিকল্প নেই। একইসঙ্গে আগের ফ্লাইটের অভিজ্ঞতার কথা মনে করে সেটা নিয়েও শঙ্কায় আছি। ক্ষুধায় আমার কিছুই ভালো লাগছে না। জাহাজের চাকা গড়াল, উড্ডয়ন হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে মেঘের গোল্লা গোল্লা কুণ্ডলীর উপর গলে পড়ল গোধূলীর সোনালি আলো। আমার দুই পাশে দুইজন সহযাত্রী, তাদের দিকে ভ্রক্ষেপ করার মতো ইচ্ছা বা শক্তি কোনটাই আমার নেই। কোমরবন্ধনী খুলে ফেলার ঘোষণা আসতেই ছুট দিলাম টয়লেটে। মুখে পানির ঝাপটা দিলে প্রাণ ফিরে পেলাম। টয়লেট থেকে বেরিয়েই পড়লাম আরেক ফ্যাসাদে। চলাচলের পথটার মধ্যে খাবারের ট্রলিসহ ঢুকে পড়েছে দুজন বিমানবালা। তারা আমাকে দেখার পর থেকেই বারবার দুঃখ প্রকাশ সূচক ইশারা করতে থাকল। অগত্যা টয়লেটের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো প্রায় দশ মিনিট।

আসনে ফিরে দেখি আমার জন্য দ্বিগুন খাবার রাখা। পাশের যাত্রী জানাল, আপনার অনেক কষ্ট হয়েছে, তাই তারা দুইটা খাবার দিয়েছে এবং সংবাদটা আপনাকে দিতেও বলেছে। তাতে অবশ্য আমি যারপর নেই খুশি। ভদ্রলোকের নাম টিন। জনাব টিন পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, পাশাপাশি পুরোদস্তুর একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসার সূত্রেই তার হ্যানয় যাত্রা। ভালোই হলো আড়াই ঘণ্টার এই পথে একজন সঙ্গী পাওয়া গেল। পরিচয় পর্বের পর দুজনেই খাবার শুরু করলাম। ওদিকে আমার বাম পাশে যাত্রী মহোদয় বিমান ছেড়ে দেওয়ার আগ থেকেই মুখে কম্বল ঢাকা দিয়ে রেখেছেন। তার খাতিরে আমাদের আলাপচারিতায় খানিকটা সতর্কতা বজায় রাখতে হলো। পানীয় পরিবেশন করতে এলে বিমানবালাগণ প্রথমে জানতে চাইলেন- কি নিতে চাই? আমি তো কফি নেব। তার আগে দ্বিগুন খাবার দেওয়ার জন্য একটা ধন্যবাদ জানালে দুঃখপ্রকাশ পূর্বক তিনি বললেন, আপনার অনেক কষ্ট হয়েছে, আর কি কিছু করতে পারি? জি অবশ্যই পারেন, আমাকে কিছুক্ষণ পর আর একটা কফি দিতে হবে- বললাম আমি। (চলবে)

আরো পড়ুন:

ষষ্ঠ পর্ব: ভিয়েতনামের ফ্লাইটের অপক্ষোয়
পঞ্চম পর্ব: পথ রোধ করলো প্রাচীন নিদর্শন
চতুর্থ পর্ব: শেকড়ে ঢাকা মানুষের ইতিহাস

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়