৭ নভেম্বর: ঐতিহাসিক বাস্তবতা, গণতন্ত্র ও বিএনপির প্রাসঙ্গিকতা
জব্বার আল নাঈম || রাইজিংবিডি.কম
বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক একটি দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সিপাহি-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবে দেশের তৎকালীন রাজনীতির গতিধারা পাল্টে গিয়েছিল। দেশ ও জাতি পেয়েছিল নতুন দিশা। দিনটিকে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’, ‘সিপাহী বিপ্লব’, আবার অনেকে ‘গণতন্ত্র পুনরুত্থান দিবস’ হিসেবে উদযাপন করেন।
কিন্তু রাজনৈতিক ভিন্নতা অতিক্রম করে ইতিহাসের মূল প্রেক্ষাপটের ভেতর চোখ রাখলে দৃশ্যমান হয়, দিনটি ছিল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার এক সন্ধিক্ষণ, যখন বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে এক চরম সংকট, বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই মুহূর্তে নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ ছিল অপরিহার্য, তখনই দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে পুনর্গঠিত হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণ, ভিত্তি, রাষ্ট্রযন্ত্রে ফিরে আসে নিয়ন্ত্রণ ও স্থিতি এবং পরবর্তীতে শুরু হয় নতুন একটি গণতান্ত্রিক ধারার অগ্রযাত্রা।
১৯৭৫ সালের আগস্ট মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময় ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অস্থির অধ্যায়। শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার পর দেশজুড়ে টানা হয় বিভক্তি ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের রেখা। রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে আস্থা ও কর্তৃত্বের সংকট চরম আকার ধারণ করে, সেনাবাহিনী বিভক্ত হয়ে পড়ে নানা গোষ্ঠীতে, প্রশাসন হয়ে পড়ে অচল, সাধারণের মনে তৈরি হয় চরম অস্থিরতা। এদিকে ওই একই বছর ৩ নভেম্বর কারাগারে নিহত হন জাতীয় চার নেতা। ফলে জাতি এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ৭ নভেম্বর যে ঘটনাটি ঘটে তা ইতিহাসে একদিকে যেমন সেনা-জনতার অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে, অন্যদিকে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সূচনাও হয় ওই একই দিনে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান চলে আসেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। তার নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বতন্ত্র শক্তিশালী সত্তা লাভ করে। গণতন্ত্র অর্গলমুক্ত হয়ে অগ্রগতির পথে এগিয়ে যায়। এই দিন থেকেই দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়।
ফলে সিপাহী বিপ্লব ও সংহতি দিবসের ঐতিহাসিক ভিত্তি বিশ্লেষণের আলোকে বলা যায়, এটি শুধু এক ধরনের প্রতিবিপ্লব নয়, বরং রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক প্রক্রিয়া। একদিকে বামশক্তিরা সেনাবাহিনীর ভিতরে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল, অন্যদিকে প্রশাসনিক দুর্বলতা দেশকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছিল। এমন পরিস্থিতিতে সামনে আসেনে জিয়াউর রহমান। তার নেতৃত্বে সেনা ও জনগণের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য গঠিত হয়, যা ছিল প্রকৃত অর্থে জাতীয় একত্রীকরণ, গণতন্ত্র উদ্ধারের দিন।
ইতিহাসের পুনঃপুনঃ বিশ্লেষণে, যদি ৭ নভেম্বরের পর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ অন্য কারও হাতে যেত, বিশেষত সেই সময়কার বামপন্থী প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কাছে, তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ সম্ভবত ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে পারতো, বিপর্যয় তৈরি হতো, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেতো না, অথবা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করতে হতো।
মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিশৃঙ্খল সেনাবাহিনীতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা পায়, প্রশাসনে ফেরে স্থিতি এবং ধীরে ধীরে দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। পৃথিবীর দিকে চোখ রাখলে দেখতে পাই—পাকিস্তান, মিশর, ব্রুনাই, লিবিয়া, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া এবং হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে বাংলাদেশ অর্থাৎ সামরিক শাসকরা সাধারণত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে চান; সেখানে জিয়া ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি দলীয় রাজনীতিকে পুনরায় বৈধতা দেন। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের পথে অগ্রসর হন। তার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি এই দর্শনেরই ধারক ও বাহক।
২.
৭ নভেম্বরের তাৎপর্য বহুমাত্রিক। এটি কেবল একটি সামরিক ঘটনা নয়, বরং রাজনৈতিক রূপান্তরের সূচনাকাল। সংকটকালে রাষ্ট্রের নতুন জন্ম। জিয়াউর রহমানের আহ্বানে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা বিকশিত হয়, যা বাঙালি জাতিসত্তাকে রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার বাইরে নিয়ে সার্বভৌম নাগরিক পরিচয়ের নতুন পরিধি তৈরি করে। তিনি অনুধাবন করলেন, মুক্তিযুদ্ধের অর্জন টিকিয়ে রাখতে হলে জনগণকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন ঘোষণা করতে হবে। তার সময়েই কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের সূচনা, বিদেশে কর্মসংস্থান তৈরি, গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশ লাভ এবং বিভিন্ন কর্মসূচিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ে। এই অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতার দর্শনই ছিল ৭ নভেম্বরের ‘সংহতি’র বাস্তব রূপ অথবা সাধারণ জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন।
কিন্তু সময়ের প্রবাহে ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক মূল্যবোধ রাজনীতির মঞ্চে যেন কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে। একদল আখ্যা দিয়েছে সেনা বিদ্রোহ হিসেবে, অন্যদল নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে এর তাৎপর্য বিকৃত করেছে বারবার। অথচ, ইতিহাসের প্রকৃত বিচার হয় আবেগ দিয়ে নয়, বাস্তবতার নিরিখে; ফল দিয়ে। আর ফল বলছে, এই দিনটির কারণেই বাংলাদেশ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে পেয়েছিল, গণতন্ত্রের পথ খুলে গিয়েছিল এবং এক নতুন রাজনৈতিক দর্শনের জন্ম হয়েছে। বিএনপি মূলত গণতন্ত্র, আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, অর্থনৈতিক ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। ফলে আজকের বিএনপির দায় ও দায়িত্ব অনেক বেড়েছে। বিএনপি কেবল একটি দল নয়; একটি দর্শন, যা মূলত ৭ নভেম্বরের যোগ্য উত্তরাধিকার। জিয়াউর রহমান যে দর্শন রেখে গেছেন তা হলো, বাস্তববাদ, কর্মনিষ্ঠা এবং জাতীয় ঐক্য—বিএনপির পুনর্জাগরণের ডাক। সিপাহী বিপ্লব ও সংহতি দিবসে বিএনপির অবস্থানকে তিনভাবে মূল্যায়ন করা যায়।
প্রথমত রাষ্ট্রের আরও সংকটকালীন মুহূর্ত সন্নিকটে, এ জন্য বিএনপিকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংহতি সুদৃঢ় ও পোক্ত করার পাশাপাশি জাতীয় ঐক্য নিয়ে কাজ করতে হবে। দলের ভেতরে বিশ্বাসের ভিত্তি আরও মজবুতের পাশাপাশি জাতীয় বিভাজন রেখা চিরতরে বন্ধ করে জনগণের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়ার দিকে মনোযোগী হতে হবে । কারণ, ৭ নভেম্বরের মূল শিক্ষা ছিল—ঐক্যই শক্তি। আজকের বাংলাদেশকে স্বীকার করতে হবে, বিএনপির জন্ম হয়েছিল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য; বিভাজনের জন্য নয়, যা দলটি চলমান রেখেছে এবং আমরা আশা করব ভবিষ্যতে এই ধারা তারা অব্যাহত রাখবে।
দ্বিতীয়ত বিএনপির এখন প্রয়োজন বাস্তবমুখী রাজনীতি। জিয়াউর রহমান কর্মঠ মানুষ ছিলেন। তার নীতি ও আর্দশ ছিল—দেশের কাজই গুরুত্বপূর্ণ। আজকের বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপিকেও সেই পথেই ফিরতে হবে। দেশের বড় সংকট যতটা রাজনীতি তারচেয়েও কয়েকগুণ বেশি—চাকরি, মূল্যস্ফীতি, নিরাপত্তা। তরুণ প্রজন্ম বর্তমানে দিক ও দিশাহারা। কারণ তারা কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা পাচ্ছে না। বর্তমান বিএনপি যদি সত্যিকারভাবে মেজর জিয়াউর রহমানের আদর্শে বিশ্বাসী হয়,তাহলে দেশ ও জনগণমুখী হবে এবং রাজনীতির মাধ্যমে জনগণের কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি মুক্তির লড়াই জারি রাখবে। যার মাধ্যমে দেশের তরুণরা প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে আত্মনির্ভর হবে, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
তৃতীয়ত নির্বাচন ও ক্ষমতাগ্রহণ পরবর্তীতে বিএনপিকে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের দর্শন বাস্তবায়নের ভূমিকায় দেখতে চায় এ দেশের জনগণ। যেমন বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি দেশীয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা, বিনিয়োগ এবং কৃষিকে লাভজনক করে গড়ে তোলা—যা জিয়ার নীতি ও দর্শন। কারণ, গরিব মানুষের দল হিসেবে বিএনপির শক্তি গ্রামীণ অর্থনীতিতে; সেই বাস্তবতা বাস্তবায়নই হবে বাংলাদেশের উন্নয়ন।
জাতীয় ঐক্য, সমন্বয়, নীতি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, কর্ম ও যোগ্যতার মূল্যায়ন এবং কাজের পুনর্লিখন ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের বাস্তব উদাহরণ। তাই মাঠ ও মতবাদ গোছানো, জান ও জীবনের নিরাপত্তার আওয়াজ, অর্থ ও কর্মসংস্থানের ভিত্তি বাস্তবায়নই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সিপাহী বিপ্লব ও সংহতি দিবসের তাৎপর্য। এই দিনে সেনা ও জনতা এক হয়েছিল রাষ্ট্রকে বাঁচাতে, আজকে আবার গণতন্ত্র চর্চার সংকটকাল চলছে, বিএনপি থাকবে সেই ঐক্যের নেতৃত্বে আর গণতন্ত্র বাঁচানোর ভূমিকায়, যা বাস্তবায়ন হবে—বক্তৃতায় নয়, কর্মকৌশলে।
আলোচনার শুরুতে বলা হয়েছে, বিএনপি গরীব ও মেহনতি মানুষের দল। এই দিনে জনতা এবং সেনাদের সমন্বয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়। ৭ নভেম্বর সমুন্নত রেখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারসাম্যের এক নতুন অধ্যায় শুরু। কারণ ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে—যে শক্তি জনগণের সঙ্গে মিশে থাকে, রাজনীতি কর্মনিষ্ঠা ও সংহতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, শেষ পর্যন্ত সময় তাদের পক্ষেই যায়। বিএনপির অবস্থান সেখানেই।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক
ঢাকা/তারা//