ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

দ্য রেপ অব নানকিং

সাইফুল আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দ্য রেপ অব নানকিং

সাইফুল আহমেদ : চ্যাং ঝি কিয়াং। তখন তার বয়স ছিল নয় বছর। সে তার মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। পথে তাদেরকে আটকে ফেলে সৈন্যরা। তার মাকে ধর্ষণ করতে চায়। কিয়াং বাধা দিলে তাকে ধরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তার মাকে বিবস্ত্র হতে বলে। কিয়াংয়ের মা তা না করলে তাকে স্তনে বায়োনেটে দিয়ে সজোরে আঘাত করে। এতে তার মা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। মৃত ভেবে সৈন্যরা চলে যায়। কিয়াং এবার গিয়ে তার মাকে ডেকে তোলার চেষ্টা করে। তার বুকের ক্ষত পরিমাপ করতে বস্ত্র সরাতেই ক্ষুধার্ত ছোট ভাইটি মায়ের স্তনে মুখ দেয়। কিন্তু তার মুখ ভরে উঠে রক্তে। ততক্ষণে তার মা সত্যিই না ফেরার দেশে চলে গেছে।

 

ঝ্যাং জিউ হংয়ের বয়স তখন ১২ বছর ছিল। তার বাবা-মা কিছু দিন আগেই প্রাণ হারিয়েছে সৈন্যদের হাতে। সৈন্যরা তাদের বাসায় এসে তাকে নিয়ে যেতে চায়। তার দাদা বাধা দিলে তাকে হত্যার হুমকি দেয়। তবুও হংকে ছাড়তে চান না তার দাদা। তিনি বলেন, ‘উৎসর্গ হওয়ার মতো বয়স এখনো তোমার হয়নি।’ তবে হং জানে সৈন্যদের সঙ্গে না গেলে সে ও দাদা দুজনকেই প্রাণ হারাতে হবে। এর চেয়ে একজনের প্রাণ যাওয়াই ভাল। দাদার বাধা সত্ত্বেও সে সৈন্যদের সঙ্গে যায়। সৈন্যরা পাশের কক্ষে নিয়ে তাকে পাশবিকভাবে ধর্ষণ করে। ধর্ষণ শেষে অজ্ঞান হংকে সৈন্যরা রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে যায়।

 

ওপরের দুটি ঘটনাই ১৯৩৭ সালের, নানকিনে। চ্যাং ঝি কিয়াং ও ঝ্যাং জিউ হং দুজনই তৎকালীন বর্বর জাপানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার। তবে শুধু তারাই নয়, কয়েক লাখ নানকিনবাসী তখন এমন দুঃসহ সময় পার করেছেন।

 

দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধের সময় ১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বরে জাপান চীনের তৎকালীন রাজধানী নানকিং (বর্তমান নাম নানজিং) দখল করে নেয়। সেদিন থেকে শুরু করে ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে নানকিংয়ে জাপানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও ব্যাপক ধর্ষণ ইতিহাসে ‘নানকিন গণহত্যা’ বা ‘দ্য রেপ অব নানকিন’ নামে পরিচিত। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে স্বল্পতম সময়ে সংঘটিত সবচেয়ে ভয়াবহতম ও জঘন্যতম হত্যা ও ধর্ষণ অধ্যায়। এই  সময়ে জাপানি বাহিনী প্রায় ৩ লাখ বেসামরিক ও নিরস্ত্র লোককে হত্যা করে। ধর্ষণ করে হাজার হাজার কিশোরী, তরুণী এমনকি বৃদ্ধাকেও। পাশাপাশি ছিল লুটতরাজ।

মিনি ভট্রিন নামের এক মার্কিন নাগরিক সে সময় ছিলেন নানকিনের জিনলিং উইমেন কলেজের ডিন। তার বর্ণনায় পাওয়া যায় নানকিংয়ে জাপানি বাহিনীর নিষ্ঠুরতার চিত্র। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই শত শত বেসামরিক লোককে হত্যা করা হতো। নানকিং শহরের এমন কোনো স্থান ছিল না, যেখানে লাশ ছিল না। লাশের গন্ধে সবসময় পেট ফুলে থাকত। ৮/১০ বছরের মেয়েরাও ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পেত না। বাসা থেকে মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো। অনেক সময় বাবা-ভাইয়ের চোখের সামনেই তাদেরকে ধর্ষণ করা হতো।’

 

জর্জ ফিচ নানকিনে তখন মিশনারির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘নানকিং মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছিল। মানুষের পালানোর মতো জায়গা ছিল না। চোখের সামনে আমি বহু বেসামরিক লোককে হত্যা করতে দেখেছি। গুলি করে হত্যার পাশাপাশি বহু মানুষকে শিরশ্ছেদও করা হয়েছে।’

 

ওয়াং ওয়েন য়ুর বসয় তখন ছিল ১৭। তিনি বলেন, ‘আমাদের ঘরবাড়ি সব কিছু আগেই জাপানি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এরপর যখন তারা নানকিং দখল করল, তখন থেকে শুরু হলো অমানসিক নির্যাতন। আমার চরম সৌভাগ্য যে আমি মৃত্যুকে এড়াতে সক্ষম হয়েছিলাম। ওরা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। শহরের এখানে-সেখানে লাশ পড়ে থাকত। আমি এক আত্মীয়ের সঙ্গে নানকিং ছাড়তে সক্ষম হই। আমরা পালিয়ে যাওয়ার সময় যখনই দেখতাম জাপানি সৈন্যরা টহল দিচ্ছে, আমরা লাশের সঙ্গে শুয়ে পড়তাম। তারা আমাদেরকে লাশ ভেবে চলে যেত। এত লাশ ছিল যে, তার সঙ্গে মিশে থাকলে বোঝার উপায় ছিল না।’

 

জাপানি বাহিনী যখন নানকিং দখল করে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে তখন এর প্রতিবাদ করে কয়েকটি দূতাবাস থেকে জাপান সাম্রাজ্যের কাছে বার্তা পাঠানো হয়। তবে তারা এর জবাব দেয়নি। জাপানি বাহিনী বরাবরই দাবি করে, তারা চীনা সৈন্যদের হত্যা করছে। তবে সত্যি হলো- চীনা সৈন্যরা জাপানি বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে আগেই নানকিন ছেড়ে পালিয়েছিল। নানকিনে জাপানি সৈন্যরা সাধারণ মানুষের ওপরই অত্যাচারের খড়গ নামিয়ে দেয়।

সে সময় সাধারণ মানুষের রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কয়েকটি দূতাবাসের চেষ্টায় একটি ‘সেফ জোন’ গড়ে তোলা হয়। সেখানে আশ্রয় নেওয়াদের বেশির ভাগই ছিল নারী ও শিশু। তবে সেখানেও চীনা সৈন্যদের খুঁজে বের করার নামে ‘সেফ জোন’ তছনছ করে ফেলে জাপানি সৈন্যরা।

 

নানকিং দখলের আগে নৌবাহিনীর সহায়তায় সাংহাই দখল করে জাপানি বাহিনী। এরপর তারা নানকিন দখল করতে অগ্রসর হয়। সে সময় সৈন্যদের সঙ্গে থাকা এক জাপানি সাংবাদিক বলেন, ‘১০ম আর্মি নানকিং দখল করার জন্য খুব দ্রুত এজন্য এগুচ্ছিল যে, সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যদের মাঝে এই ধারণা ছিল, তারা সেখানে ইচ্ছেমতো লুট ও ধর্ষণ করতে পারবে।’

 

জাপানি ঔপন্যাসিক তাৎসুজো ইশিকাওয়া তার ‘ইকিতেইরু হেইতেই’ (বেঁচে থাকা সৈন্যরা) উপন্যাসে নানকিনে জাপানি সৈন্যদের ভয়াবহ অত্যাচারের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি ১৯৩৮ সালের জানুয়ারিতে জাপানি সৈন্যদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে উপন্যাসটি রচনা করেন।

 

নানকিনে জাপানি সৈন্যদের নিষ্পেষণ কতটা ভয়াবহ ছিল, তা ফুটে ‍উঠেছে সেই সময় জাপানি ভাষার পত্রিকা ‘টোকিও নিচি নিচি শিম্বুন’ ও জাপানি ইংরেজি ভাষার পত্রিকা ‘জাপান অ্যাডভারটাইজার’ এ। পত্রিকা দুটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দুজন জাপানি সৈন্য এক প্রতিযোগিতায় নেমেছে- কে আগে শুধু তরবারি দিয়ে ১০০ লোককে হত্যা করতে পারে।’

 

নানকিনে জাপানি বাহিনীর বর্বরতা এতটাই নির্মম ছিল যে, তার জের ধরে আজও জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারেনি চীন।

 

সূত্র : প্রামাণ্যচিত্র : নানকিং, ইরিস চ্যাংয়ের বই : দ্য রেপ অব নানকিং ও উইকিপিডিয়া

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ ডিসেম্বর ২০১৬/সাইফুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়