ঢাকা     মঙ্গলবার   ২১ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৭ ১৪৩১

বাজার নিয়ন্ত্রণ জরুরি

রিশিত খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৮, ৩০ জুলাই ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাজার নিয়ন্ত্রণ জরুরি

রিশিত খান : নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে । মাঝখানে কিছু দিন স্থিতি থাকলেও নতুন করে আবারও বাড়ছে সব রকম নিত্যপণ্যের দাম। গত রমজান মাস থেকে এই মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

 

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায় মূল্যবৃদ্ধির চিত্র। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে শিম ১০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪০ টাকা, বেগুনের কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়েছে। সাদা বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা ও লম্বা বেগুন ৫০ টাকা। দেশি গাজরের দাম কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা। বরবটির দাম বেড়েছে ১০ টাকা। পেঁপের দাম ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা করে। কচুরমুখির কেজি ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ধুন্দলের কেজি ৩৫ টাকা বেড়ে ৪০ টাকা হয়েছে। ঝিঙার দাম বেড়েছে ১৫ টাকা। আগে ছিল ৩৫ টাকা, এ সপ্তাহে বিক্রি করা হচ্ছে ৪৫ টাকায়। কলার মোচা এক পিস ২০ টাকা ছিল, এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়।

 

এ ছাড়া চাল কুমড়া এক পিস ৩০ টাকা, বোম্বাই মরিচের হালি ১০ টাকা, করোলার কেজি ৪০ টাকা, মিষ্টি কুমড়ার ফালি ২০ টাকা, পোটল ৪০ টাকা, মূলা ৪০ টাকা, শসা ৪০ টাকা, ফুলকপি এক পিচ ৪০ টাকা, কচুর লতির আটি ৪০ টাকা, চায়না গাজর ১০০ টাকা, দেশি আদা দেড়শ, আমদানিকৃত প্রতিকেজি আদা ৫০ টাকা, দেশি পেয়াজ ৪০ টাকা, আমদানিকৃত পেয়াজ ৩০ টাকা, দেশি রসুন ১২০ টাকা ও আমদানিকৃত রসুন ১৬০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।

 

বিক্রেতারা জানান, ডাটা শাকের আটি গত সপ্তাহে ছিল ১০ টাকা। এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা করে। কচু শাকের আটি ছিল ৮ টাকা, বেড়েছে ২ টাকা। লাউ শাক ২০ টাকা ছিল, বেড়েছে ১০ টাকা। ভেন্ডি ৫০ থেকে ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা।

 

পুঁই শাকের আটি ২০ টাকা, কলমি শাকের আটি ৮ টাকা, কাচকলার হালি ৩০ টাকা, জালি শাক ২০ টাকা, পালং শাক ২০ টাকা, লাল শাকের আটি ১৫ টাকা, পাট শাকের আটি ১০ টাকা, কচু একটি ৫০ টাকা, কাঁচা মরিচের কেজি ১০০ টাকা। 

 

এই দাম বৃদ্ধি নিয়ে প্রতিনিয়ত একে অপরকে দুষছেন  ব্যবসায়ীরা। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি বাজারে মূল্য বেশি হওয়ায় বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে। অন্যদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে বেশি নিচ্ছেন না বলে জানাচ্ছেন।

 

বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডাল, গুড়োদুধ, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, ডিমসহ কাঁচাবাজারের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। এর মধ্যে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে চিনির দাম। গত রমজান থেকেই ৪৪ টাকা কেজি দরের চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। চাল, আটা, দুধ, মাছ, মুরগির দামও বেড়েছে আরেক দফা।

 

গত দুদিন রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, মসুর ডাল ১২০ টাকায়, খেসারি ডাল ৬৫ টাকায়, তেল ৯০ থেকে ১০০ টাকায়।

 

টিসিবি খোলা বাজারে বিক্রি করছে পণ্য। এ বছর খোলা বাজারে বিক্রির জন্য ৩ হাজার মেট্রিক টন তেল, দেড় হাজার মেট্রিক টন ছোলা, ১৫০ মেট্রিক টন খেজুর ও ২ হাজার মেট্রিক টন মসুর ডাল আমদানি করা হয়েছে। তিনি বলেন, টিসিবির নির্ধারিত বাজারদর হচ্ছে- কেজিপ্রতি মসুর ডাল ১০৩ টাকা,  সয়াবিন ৮৯ টাকা,  চিনি ৩৭ টাকা  এবং ছোলা ৫৩ টাকা।

 

অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জামানের একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে, জোট সরকারের বিদায় লগ্নে রমজান মাসে জিনিসপত্রের দাম গত পাঁচ বছরের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পণ্যের দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে ছিল জোটের প্রশ্রয়ে জন্ম নেওয়া ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।

 

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারের এ দুর্বিসহ অবস্থা দু’একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানোর যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে তা থেকে দেশের সব পর্যায়ের ভোক্তা-ক্রেতা শ্রেণির যেন পরিত্রাণ নেই। নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের কাছে এখন বাজারে যাওয়া মানেই আতঙ্ক আর অস্থিরতা।

 

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নানা ক্ষেত্রেই বেশ কিছু ভালো কাজের নজির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, মজুদদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারিভাবে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই বললেই চলে। 

 

এক সময় সরকারিভাবে ডাইরেক্টরেটের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী মজুদের সময়সীমা দেখার নিয়ম ছিল। কিন্তু বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে ১৯৯৯ সালে সেই সংস্থাটি বিলপ্ত করা হয়। এখন আমদানিকারক বা পাইকারি ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য গুদামে দীর্ঘকাল সংরক্ষণ করতেই পারে। মজুদদারদের এই একচ্ছত্র অধিকারের বাধা এসেছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে।

 

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করার সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যে দাম রেখে গিয়েছিল, সে দাম দ্বিগুণ করে বিদায় নেয় জোট সরকার। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের জুন মাস পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সময়কালে জিনিসপত্রের দাম এবং জোট সরকারের ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ এর অক্টোবর সময়কালে নিত্য ব্যবহার্য প্রতিটি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হারে রয়েছে বিশাল তফাৎ।

 

২০০১ সালেও ১৮০ টাকায় এক কেজি গরুর মাংস পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন এই মাংস ক্রেতাদের কিনতে গুনতে হচ্ছে ৪২০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা। খাসির মাংসের ক্ষেত্রেও তাই। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে আটার দাম ছিল ১২ টাকা। বর্তমানে সেই আটার দাম দাঁড়িয়েছে প্রতিকেজি ৩৫ টাকা। ২০০১ সালে প্রতিকেজি চিনির দাম ছিল ২৮ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৭০ টাকা। ২০০১ সালের অক্টোবরের দিকে প্রতিকেজি আলুর দাম ছিল ৮ টাকা। এখন সেই আলুর দাম কেজি ২৫ টাকা। ২০০১ সালে অক্টোবরে প্রতিকেজি গুড়ো দুধের দাম ছিল ১৭০ টাকা। এখন যেই গুড়ো দুধ বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৫০০ টাকায়।

 

একইভাবে সয়াবিন তেলের দাম প্রতিকেজি ৩৫ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ টাকা। একইভাবে বেড়েছে বিভিন্ন ধরনের চাল, মসলা, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ধরনের নিত্য ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রীর দাম।

 

বাংলাদেশ কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশনের মূল্য তালিকা অনুযায়ী দেখা গেছে, গত ১০ বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের মূল্যই বেড়েছে। যেমন, পাঁচ বছরে বাজারে সব ধরনের চালের দামই অনেকাংশে বেড়েছে।

 

ক্যাবের অপর এক জরিপ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জোট সরকারের আমলে বাজার নিয়ন্ত্রণের কোনো অঙ্গীকারই তারা পূরণ করেনি। ২০০১ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৫ দশমিক ৪২ ভাগ আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল ১ দশমিক ৪০ ভাগ। ২০০২ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৫২ ভাগ আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ দশমিক ৭২ ভাগ।

 

২০০৩ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৪৮ ভাগ এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ দশমিক ৮৪ ভাগ। ২০০৪ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ১ ভাগ এবং ৩ দশমিক ৪২ ভাগ। ২০০৫ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৭ ভাগ এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ দশমিক ৩২ ভাগ।

 

আর ২০০৬ সালে এ চিত্র আরো ভয়াবহ। এদিকে আমদানিকারক, পাইকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের দাম চাপিয়ে দিচ্ছেন খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের ওপর।

 

আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর বহু ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মানুষ এসব পরিবর্তনকে স্বাগত জানাচ্ছে। মানুষ আশা করছে বাজারে যে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে সেক্ষেত্রে যেন একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। যাতে করে মানুষ একটু হলেও স্বস্তিতে থাকতে পারে।  আর এই উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই।

 

লেখক : জ্যেষ্ঠ গণমাধ্যমকর্মী

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জুলাই ২০১৬/রিশিত/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়