ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

‘ও স্যার, আমার মায়ের হাড্ডিগুলা খুইজ্জা দেন স্যার!’

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:২১, ৯ জুলাই ২০২১   আপডেট: ২২:২৪, ৯ জুলাই ২০২১
‘ও স্যার, আমার মায়ের হাড্ডিগুলা খুইজ্জা দেন স্যার!’

করোনায় মরছে মানুষ। মরছে রাস্তায় সড়ক দুর্ঘটনায়। কেমিক্যালের গুদাম, পোশাক কারখানা কিংবা অন্য অনেক কারখানায় আগুন লেগে মরছে মানুষ। পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছে মানুষ হাসপাতালের বিছানায়। বেঁচে আছে দুঃসহ শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে। এরকম নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জেও এমন এক কারখানায় আগুনে পুড়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৫২ জন। 

এসব দুর্ঘটনা কবলিত মৃত্যু নিয়ে শোকে মুহ্যমান বিবেকবান মানুষেরা। অনেকে এই নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন ক্ষোভ, কষ্ট আর প্রতিবাদের ভাষায়। প্রতিটা দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়, মালিক পক্ষের গাফিলতি আর অব্যবস্থাপনার চিত্র। অনেক মানুষের প্রাণ যায়। গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। চলে তদন্ত। সে তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে কখনো, কখনো ফাইলের ভারে চাপা পড়ে। বেশিরভাগ সময় রিপোর্ট দেবার আগে ঘটে আবারও কোনো দুর্ঘটনা। ভুলে যায় মানুষ আগের ঘটনা-দুর্ঘটনা।

শুধু কষ্টে কাতর হয়ে বুক চিরে বেরিয়ে আসে দুঃখীর দীর্ঘশ্বাস যার চলে যায় সেই জানে হায়, বিচ্ছেদে কি যন্ত্রণা!’ 

গণমাধ্যমকর্মী 'আপন তারিক' তার নিজের ফেসবুক পেজে লিখেছেন, 'তোমরা বলছো এটি দুর্ঘটনা, আমরা বলছি খুন। ঠাণ্ডা মাথায় খুন। আগুন লাগার পরও গেট খোলেনি কর্তৃপক্ষ। যদি শ্রমিকরা মহামূল্যবান জাতীয় সম্পদ চুরি করে নিয়ে যায়! তোমরা বন্ধ করে রেখেছো নেমে আসার সিঁড়ি... তারপর সস্তা শ্রম বিক্রি করা ৫২ শ্রমিক পুড়ে কয়লা হয়ে গেলো! রূপগঞ্জে আজ লাশের মিছিল...।'

'গরীবের প্রাণের মূল্য নেই, জলের মতোই সস্তা! তোমরা মৃতের পরিবারের হাতে তুলে দিচ্ছো মাত্র ২০ হাজার টাকা। কী বলবো... তোমরা, তোরা আসলে মিথ্যুক, রাক্ষস!' 

'এই দেশে অভাগা শ্রমিকের মৃত্যুতে আসলে কিচ্ছু হয়না, হবেও না জানি.. তারপরও আজ শোক নয়, শাস্তি চাই তাদের, যারা বলে এটি দুর্ঘটনা, যারা তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে, এটি স্রেফ দুর্ঘটনা আর কাজ করতে গেলে নাকি আগুন লাগতেই পারে!' 

আরেক গণমাধ্যমকর্মী এবং কথা সাহিত্যিক 'রুদ্রাক্ষ রহমান' লিখেছেন, 'আমাদের দখিনের জানালা দিয়ে সকালে এলো লইট্টা শুটকি রান্নার ঘ্রাণ। এখন মউ মউ করছে পোলাও বাতাস! এখনো, এই মৃতশহরে রন্ধনকালীন ঘ্রাণ ভাসে!' 

ফ্রি ল্যান্স সাংবাদিক এবং এনজিও কর্মকর্তা 'শরিফুল হাসান' এর বিশাল লেখার অংশ বিশেষ, তিনি লিখেছেন, 'আহা জীবন! ৫২ জন মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল! জীবনের এমন করুণ পরিনতির নামই বোধহয় বাংলাদেশ! একটু অপেক্ষা করেন জানতে পারবেন, কারখানার ভেতরে কেমিক্যাল ছিল। এরপর শুনবেন বের হওয়ার সিড়ি বন্ধ ছিল। তারপর জানবেন ফায়ার সেফটি সামগ্রী যথাযথভাবে ছিল না। আরও পরে জানবেন ভবনটা নিরাপদ ছিল না। সবশেষে হয়তো শুনবেন বহু ধরনের অনুমোদন ছিল না।' 

'আফসোস! বছরের পর বছর ধরে একই গল্প। সাংবাদিক হিসেবে বহু আগুনে পোড়া লাশ দেখতে হয়েছে। গল্পগুলো একই রকম...। প্রত্যেকটা দুর্ঘটনার পর একই কথা শুনবেন। এই রাষ্ট্রের সবাই যেন ঘুমাচ্ছিল! কারও যেন কোন দায় নেই।' 

'... কয়েকটা কমিটি হবে। আগামী কয়েকদিন এ নিয়ে ঢের আলোচনা হবে। তারপর আবার সব হারিয়ে যাবে। এরপর আবার একই দুর্ঘটনা। একই গল্প।  ভবনে আগুন লাগলে অনুমোদন নেই। তদন্ত কমিটি আছে! নেই শুধু মানুষের জীবনের দাম!'

'... স্মৃতিতে ভেসে আসে নিমতলীর আগুন কিংবা নিশ্চিন্তপুরে গার্মেন্টসে পোড়া শত লাশ। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া একটা কঙ্কালের নাকের নোলক দেখে একটা লাশ খুঁজে বের করেছিল পরিবার। আচ্ছা এই ধরনের ঘটনা বন্ধ করা কি খুব কঠিন কাজ? এগুলো তদারকি করা কি খুব কঠিন কাজ? হ্যাঁ কঠিন কাজ ততোদিন যতোদিন শত মানুষের মৃত্যুর ঘটনার পরেও দায়িত্বে অবহেলার কারণে কারো ফাঁসি হবে না।' 

'... এভাবেই বারবার বাবা-মায়ের কাধে উঠবে সন্তানের লাশ, সন্তান কাঁদবে মায়ের জন্য। ভাই নিয়ে যাবে বোনের লাশ, বোন অপেক্ষা করবে ভাইয়ের লাশের। আমরা সব জানি শুধু জানি না কবে থামবে এই আহাজারি-‘ও স্যার, আমার মায়ের হাড্ডিগুলা খুইজ্জা দেন স্যার।'

সাংবাদিক, কবি-প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক এক লাইনে বিশাল এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে লিখেছেন, 'কল কারখানায় জরুরি নির্গমন পথ তালা বন্ধ থাকে কেন?' সাংবাদিক 'ইমতিয়ার শামীম' কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতা 'সবিনয় নিবেদন' এর চারটি লাইন তুলে দিয়েছেন তার টাইমলাইনে। তিনি লিখেছেন, 

'যে মরে মরুক, অথবা জীবন
কেটে যাক শোক করে—
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন
দিয়েছি নরক করে।’

ঢাকা/এমএম

সম্পর্কিত বিষয়:

ঘটনাপ্রবাহ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়