ঢাকা     রোববার   ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২২ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

স্মরণ

রকিব হাসান: তাঁকে যেমনটি দেখেছি

অনীশ দাস অপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৩, ২১ অক্টোবর ২০২৫   আপডেট: ১২:৫৩, ২১ অক্টোবর ২০২৫
রকিব হাসান: তাঁকে যেমনটি দেখেছি

রকিব ভাইয়ের লেখার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৮০ সালে। আমি তখন স্কুলে পড়ি। বরিশাল হেমায়েতউদ্দিন খান রোডের এ কে স্কুলে। ওখান থেকে ঢিল মারা দূরত্বে, বিবির পুকুরপাড়ে ছিল বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি। হলুদ রঙের রহস্যময় একটি বিল্ডিং। ভেতরে ঢুকতে কেমন গা ছমছম করত। লাইব্রেরিতে বসে অনেকেই বই পড়তেন। স্কুল ছুটির পরে বহুদিন বাসায় না গিয়ে ঢুকে পড়েছি লাইব্রেরিতে। বেশিরভাগ সময় পড়তাম পশ্চিমবঙ্গের দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রকাশিত কিশোর ক্ল্যাসিক অনুবাদ। বড় বড় কাঠের আলমারিতে থাকত বইগুলো।

একদিন এ রকম একটি বই আলমারি থেকে আনতে গিয়ে দেখি এক কোণায় পড়ে আছে ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’। রূপান্তর: রকিব হাসান। ড্রাকুলা মুভি বিটিভিতে দেখেছি আমি, তবে এটির যে অনুবাদ বেরিয়েছে জানতাম না। সেবা প্রকাশনীর অনেকগুলো কুয়াশা এবং জুল ভার্নের অনুবাদ ততদিনে আমার পড়া হয়ে গেছে। এই প্রকাশনীর রীতিমত ভক্ত হয়ে গেছি। তবে রকিব হাসানের কোনো বই আমি তখনো পড়ি নি, নামটিও জানতাম না। পরে জেনেছি তিনি ১৯৭৭ সাল থেকে লিখতে শুরু করেন।

তাঁর প্রথম বই ছিল মাসুদরানা সিরিজের ‘কুউউ!’ গোস্টরাইটার হিসেবে লিখেছিলেন। যেহেতু বইয়ের নাম ছিল ‘ড্রাকুলা’ তাই আমি আগ্রহী হয়ে আলমারি থেকে বইটি নিয়ে কোণার দিকে একটি টেবিল বেছে নিয়ে পড়তে বসে যাই। সেবার পাঠক মানেই জানেন সেবার সিনিয়র লেখকদের অনুবাদে কী দারুণ যশ! বলাবাহুল্য রকিব হাসানও আমাকে দারুণভাবে ধরে রাখেন। ড্রাকুলা দুই খণ্ডে বেরিয়েছিল। আমি হাতে পেয়েছিলাম প্রথম খণ্ডটি। বই পড়ার সাংঘাতিক নেশা আমাকে একজন ফাস্ট রিডারে পরিণত করেছিল। সম্ভবত দুই ঘণ্টার মধ্যে প্রথম খণ্ড পড়া শেষ। মন তখন আকুপাকু দ্বিতীয় খণ্ড পড়ার জন্য।  খেয়ালও করিনি কখন সাঁঝ গড়িয়ে প্রকৃতির বুকে নেমেছে রাত। সেরেছে, আজ বাসায় নির্ঘাত পিট্টি খেতে হবে। তবে মার খাওয়ার ভয়ের চেয়ে আমার বুকে আরেকটা ভয় সাপের মতো হিলহিল করে ঢুকে গিয়েছিল। ড্রাকুলার ভয়! সেই রাতে কীভাবে যে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাসায় ফিরেছিলাম সেই গল্প হবে আরেকদিন।

তবে ড্রাকুলার দ্বিতীয় খণ্ড আমি পাবলিক লাইব্রেরিতে পাই নি। কেউ হয়তো হাপিশ করে দিয়েছিল। দ্বিতীয় খণ্ডটি আমি মরণদার (মরণ চক্রবর্তী, যাকে বরিশালের সবাই এক নামে চেনেন। তিনি এক/দুই টাকায় সেবা প্রকাশনীসহ অন্যান্য প্রকাশনীর বই ভাড়া দিতেন। বরিশাল কসাই মসজিদের ঠিক সামনেই ছিল তাঁর দোকান।) কাছ থেকে এক টাকায় ভাড়া নিয়ে পড়েছিলাম।

সেই শুরু। কাজী আনোয়ার হোসেনের পরে সেবার যে লেখক আমাকে কিশোর বয়সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধরে রেখেছিলেন তিনি রকিব হাসান। পরে আমাকে আরও দু’জন লেখক দারুণ মুগ্ধ করেছিলেন― প্রয়াত শেখ আবদুল হাকিম এবং নিয়াজ মোর্শেদ। হাকিম ভাইয়ের ভক্ত হয়ে যাই তাঁর রচিত রহস্যোপন্যাস ‘কামিনী’ পড়ে। আর নিয়াজ ভাইয়ের অনূদিত কিশোর ক্ল্যাসিকগুলোর তো তুলনাই হয় না। আমার সৌভাগ্য সেবা’র এই তিন সুপারস্টার লেখকের সান্নিধ্য এবং স্নেহ আমি লাভ করি রহস্যপত্রিকায় লিখতে গিয়ে।

রকিব ভাইকে আমি প্রথম দেখি সেগুনবাগিচার রহস্যপত্রিকা অফিসে। ১৯৯১ সালের শরতের এক স্নিগ্ধ বিকেলে। আমাকে রহস্যপত্রিকা অফিসে এর আগের বছর, একদিন সকালে নিয়ে গিয়েছিলেন আমার ডিপার্টমেন্টের জয়দা (তপন সিনহা জয়। তিনিও ঢাবিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পড়তেন। রহস্যপত্রিকায় টুকটাক লিখতেন। সেই সুবাদে তাঁকে একদিন ধরে বসি আমাকে স্বপ্নের সেবা প্রকাশনীতে নিয়ে যাবার জন্য।) রহস্যপত্রিকার সহকারী সম্পাদকরা বিকেলে বসতেন জানতাম না। তাই বেশ হতাশই হয়েছিলাম। তবে রহস্যপত্রিকার সমন্বয়কারী শেখ মহিউদ্দিন ভাই বলেছিলেন যে কোনো শনিবার বিকেল চারটার পরে যেতে। ওইদিন পত্রিকার তিন সহকারী সম্পাদককেই পাওয়া যাবে। তিনি আমাকে লেখা নিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ওই ঘটনার প্রায় বছরখানেক বাদে আমি আবার যাই রহস্যপত্রিকা অফিসে দুটো লেখা নিয়ে। তবে এবারে একা। দুরুদুরু বক্ষে পত্রিকা অফিসে প্রবেশ আমার। আজ কি সত্যি দেখা হবে আমার প্রিয় লেখকদের সঙ্গে যাদের বই পড়ে বড় হয়েছি! বিশেষ করে রকিব হাসানের কথা ভেবে ভয় একটু বেশিই লাগছিল। উনি কি আদৌ আমাকে পাত্তা দেবেন? শুনেছি কাঠখোট্টা স্বভাবের মানুষ। কাউকে তোয়াক্কা করেন না।

আসলেই সেদিন আমাকে পাত্তা দেন নি রকিব ভাই। আমার দিকে ভালো করে তাকান নি পর্যন্ত। কিন্তু হাকিম ভাই আমার গল্পটি এক পাতা পড়ে মন্তব্য করেছিলেন, দেখে তো মনে হচ্ছে ভালোই। রেখে যান। তিন মাস পরে খবর নিয়েন। (আমার ওই গল্পটি হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি! পরে গাদাগাদা লেখার স্তূপ থেকে ওটাকে আমি উদ্ধার করি এবং পরের মাসেই ঘুণপোকা নামে রহস্যপত্রিকায় ছাপা হয়। এরপর আক্ষরিক অর্থেই আমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। কারণ গল্পটি পড়ে বহু পাঠক ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিলেন। হাকিম ভাই তারপর আমাকে নিয়মিত লিখতে উৎসাহ দেন।)

নিয়াজ মোর্শেদ ভাইয়ের জন্য রিডার্স ডাইজেস্ট পত্রিকার একটি ফিচার অনুবাদ করে নিয়ে গিয়েছিলাম। স্বল্পভাষী লেখকটি শুধু সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়েছিলেন―মানে রেখে যাও। পরে পড়ব। আর রকিব ভাই? তাঁকে আদাব দিয়েছিলাম আমি। তিনি শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে কী একটা লেখা এডিট করছিলেন সেটাতে ফিরে গেলেন এবং খানিক পরে ‘কিচ্ছু হয় নাই’ বলে ওটাকে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ছুড়ে ফেলে দিলেন। তারপর মহিউদ্দিন ভাইকে বললেন, ‘মহিউদ্দিন, চা আনান।’ এরপর শুরু হলো তাঁর বকবক। আমি যে একটা মানুষ, বসে আছি তাঁর সামনে, তাঁকে তৃষিত নয়নে দেখছি তিন গোয়েন্দার লেখক, ড্রাকুলাসহ বিভিন্ন শিকার কাহিনির দুর্দান্ত অনুবাদক হিসেবে; খেয়ালই করলেন না। কিংবা লক্ষ্য করলেও গ্রাহ্য করলেন না। এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর এমন কত হাজার হাজার ভক্ত আছে দেশজুড়ে।

তবে আমার ইগোতে খুব লাগল। রকিব হাসানকে প্রথম দর্শনেই মনে হলো অত্যন্ত অহঙ্কারী একজন মানুষ এবং রসকষহীন যিনি চিৎকার করে কথা বলেন এবং অন্যদের কথা শুনবার চেয়ে নিজের কথা বলতেই বেশি ভালোবাসেন। তবে পরবর্তীতে তাঁর সঙ্গে যখন আমার রসায়ন মিলে গেল তখন দেখলাম তিনি অহঙ্কারী বটে ( আত্মবিশ্বাসী বেশিরভাগ মানুষ অহঙ্কারী হয়ে থাকেন, এতে দোষের কিছু নেই) তবে নিরস নন। এবং দেশের অনেক জনপ্রিয় লেখকের প্রতি তাঁর একটু নাক সিঁটকানোর অভ্যাস আছে। ‘স’ আদ্যাক্ষরের একদা জনপ্রিয় এক লেখককে তিনি লেখক বলেই মনে করতেন না। বলতেন ওর তো বাক্য গঠনই হয় না। তবে কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রতি তাঁর অসম্ভব শ্রদ্ধাবোধ ছিল। সেবা থেকে অভিমান করে ২০০০ সালের দিকে চলে গেলেও তাঁকে কোনোদিন কাজীদা সর্ম্পকে কোনো কটূক্তি করতে শুনি নি। তিনি বলতেন কাজীদা তাঁকে নিজের হাতে লেখক হিসেবে গড়ে তুলেছেন।

রকিব ভাইয়ের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ আমার ঘটে সম্ভবত ১৯৯৩ সালের দিকে। ততদিনে হরর লেখক হিসেবে রহস্যপত্রিকায় আমার একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছে। একদিন বিকেলে রহস্যপত্রিকা অফিসে গেছি হাকিম ভাইকে একটি গল্প দিতে। তিনি তখনো আসেন নি। আমি তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় রকিব ভাই আমাকে ডাক দিলেন, ‘অনীশ, এদিকে আসেন।’  আমি লাফ মেরে তক্ষুণি তাঁর টেবিলের সামনে। তিনি রিডার্স ডাইজেস্টের লেটেস্ট সংখ্যাটি আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, ‘এটা নিয়ে যান। এতে হাঙরের ওপর একটা লেখা আছে। পড়ে দেখেন। ভালো লাগলে অনুবাদ করবেন।’

আমি নাচতে নাচতে পত্রিকা নিয়ে জগন্নাথ হলে ফিরলাম। দুইদিন পরেই আমার ইনকোর্স পরীক্ষা। রকিব ভাইকে সেটা জানাই নি পাছে লেখাটি তিনি অন্য কাউকে অনুবাদের জন্য দিয়ে দেন! ‘পরীক্ষার গুল্লি মারি’ বলে সেই রাতেই লেখাটি নিয়ে বসে পড়লাম। রকিব ভাই যদিও আমাকে তিনদিন সময় দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি পরদিনই লেখাটি মহিউদ্দিন ভাইকে দিয়ে এলাম। লেখার শিরোনাম: সাগরতলের আতঙ্ক। তারপর শুরু হলো আমার অন্তহীন বেদনাদায়ক অপেক্ষা। মনে ভয় কী হয়! কী হয়! লেখাটি রকিব ভাইয়ের পছন্দ না হলে ওটার শেষ আশ্রয় নির্ঘাত ময়লা ফেলার ঝুড়ি। আর উনি যা খুঁতখুঁতে! লেখা পছন্দ না হলে আর কোনো দিনই হয়তো তাঁর বিভাগে লেখার চান্স পাব না। ওনাকে জিজ্ঞেস করারও সাহস নেই। পাছে রেগেটেগে যান। একদিন মহিউদ্দিন ভাইকে ফোনও করেছিলাম জানতে লেখাটার কী অবস্থা। জানলাম রকিব ভাই পড়ার সময় করে উঠতে পারেন নি এখনো। তবে পরের মাসে আমার জন্য দারুণ একটি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল। তখন আমি নিয়মিত সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকায় কিনতাম। একদিন পত্রিকা স্টলে ২০০০ কিনতে গিয়ে দেখি সেই মাসের রহস্যপত্রিকা ঝুলছে দোকানে। প্রচ্ছদে একটি হাঙরের ছবি। নিচে ক্যাপশন―সাগরতলের আতঙ্ক। আশ্চর্য খুশিতে ভরে উঠল মন।

এরপর থেকে রকিব ভাই আমাকে দিয়ে নিয়মিত ফিচার অনুবাদ শুরু করালেন। আমার অসংখ্য অনুবাদ ফিচার দিয়ে রহস্যপত্রিকায় কভার করা হয়েছে। তিনি এক পর্যায়ে আমাকে দিয়ে ধারাবাহিক লেখা লেখাতে লাগলেন। প্রথমে দিয়েছিলেন জিম করবেটের আত্মজীবনীমূলক বই ‘মাই ইন্ডিয়া’। বইটি ‘বনের গল্প’ নামে এক বছরেরও বেশি সময় রহস্যপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। পরে ২০০৩ সালে বই আকারে সেবা থেকে প্রকাশিত হয়। তিনি জেরাল্ড ডুরেলের ‘মাই ফ্যামিলি অ্যান্ড আদার অ্যানিম্যালস’ নামে আরেকটি বই অনুবাদ করতে দিয়েছিলেন। এটিও রহস্যপত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছে ‘মানবজন্তু’ নামে। সেবা থেকে আমার যত বই বেরিয়েছে আমি সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পেয়েছি এই বইটির জন্য। রকিব ভাই নিজেও আমার অনুবাদের প্রশংসা করেছেন। মহিউদ্দিন ভাইয়ের কাছে শুনেছি তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘অনীশের লেখা আগে এডিট করতে হতো। কিন্তু এখন আর হাত দেওয়ার দরকার হয় না।’ 

রকিব হাসান ছিলেন কাজীদার পরে সেবা প্রকাশনীর সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। তাঁর তিন গোয়েন্দা মাসে সাত হাজার কপি বিক্রি হতো। তাঁর লেখা ‘গরমের ছুটি’ বইটি তিনদিনে প্রথম এডিশন শেষ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে তিনি তাঁর বইয়ের রয়ালটি তুলেছিলেন ৯২ হাজার টাকা। এটা মাত্র তিন মাসের বইবিক্রির রয়ালটি। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকার সময় তিনি সেবা ত্যাগ করেন।  কী ছিল তাঁর অভিমান সেটি কোনোদিনই খোলাসা করেন নি। তবে সেবা ছেড়ে চলে আসার পরে বছর কয়েক রকিব ভাই একটু বিপাকেই ছিলেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন বাংলাবাজারের প্রকাশকরা তাঁকে লুফে নেবে। কিন্তু শুরুতেই এটা ঘটে নি। সময় লেগেছে। ওই সময় ফোনে রকিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।

আমি তখন সেবার পাশাপাশি বাংলাবাজারেও নিয়মিত লিখছি। তাই তিনি বাংলাবাজারের হালহকিকত বুঝতে চাইতেন আমার সঙ্গে কথা বলে। তাঁর সঙ্গে দেখাও করতাম তিনি চাইলে। আমি বলতাম, কোন কোন প্রকাশক ঠিকঠাক টাকাপয়সা দেয়, কারা ঠকায়, কাদের ওপর ভরসা রাখা যায় ইত্যাদি। সেবা প্রকাশনীর মতো পাইপয়সা হিসাব করে দেওয়ার মতো প্রকাশক খুব কম আছে শুনে তিনি হতাশই হতেন। পরে সিদ্ধান্ত নেন এককালীন পেমেন্ট নেবেন। এবং তিনি তাই করতে থাকেন। একসময় তাঁর কাছে বাংলাবাজারের প্রকাশকরা নক দিতে শুরু করেন। সবাই তাঁর কাছে তিন গোয়েন্দার মতো সিরিজের আবদার করতেন। কিন্তু তিন গোয়েন্দার গ্রন্থস্বত্ব ছিল সেবা প্রকাশনীর। তাই রকিব ভাই তিন বন্ধু ইত্যাদি শিরোনামে বই লিখতে থাকেন। 

রকিব হাসানকে নিয়ে অসংখ্য স্মৃতি আছে আমার যা এই স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। বাংলাবাজারে লেখালেখি সংক্রান্ত কোনো পরামর্শের দরকার হলেই তিনি আমাকে ফোন দিতেন। তবে তিনি অসুস্থ হবার পরে যোগাযোগটা কমে যায়। একদিন তিনি অত্যন্ত দুর্বল কণ্ঠে ফোনে বললেন, তিনি আর লিখতে পারছেন না। কারণ সবসময় হাত কাঁপে। সম্ভবত পারকিনসন্স ডিজিজে আক্রান্ত হয়েছিলেন রকিব ভাই। তিনি আলঝিমার্স রোগেও ভুগছিলেন। স্মরণশক্তি কমে যাচ্ছিল ক্রমে। দুটো নম্বরে কথা বলতেন আমার সঙ্গে। একটি ছিল গ্রামীণ ফোন, অপরটি সিটি সেল। তিনি ফোন করেই বলতেন, ‘হ্যালো, অনীশ কী খবর?’  বরাবরই উচ্চস্বরে কথা বলতেন। আর একবার ফোন করলে সহজে ছাড়তেন না। বিল উঠে যাচ্ছে সমানে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই! হাসির কথায় ঘর ফাটিয়ে হাসছেন। যে মানুষটিকে প্রথম দর্শনে আমার অপছন্দ হয়েছিল সেই তিনিই হয়ে গিয়েছিলেন আমার একজন প্রিয় বন্ধু, আমার অগ্রজ যার কাছে লেখা সম্পাদনার অনেক কিছুই শিখেছি। 

আফসোস, যে মানুষটির একটি পাণ্ডুলিপি নেওয়ার জন্য প্রকাশকরা হাজার হাজার টাকা নিয়ে তাঁর বাড়িতে যেতেন, তিনি অসুস্থ থাকাকালীন কেউ তাঁর খোঁজ নেয় নি। এ জন্যেই তিনি মৃত্যুর আগে অভিমান করে তাঁর ছেলেদের বলে গিয়েছিলেন, তাঁর লাশ নিয়ে কেউ যেন কোনো আদিখ্যেতা না দেখায়। প্রচারবিমুখ এই মানুষটি একরকম নীরবেই প্রস্থান করেছেন। বিদায় মায়েস্ত্রো! অন্যেরা ভোলে ভুলুক কিন্তু আমরা পাঠকরা, যাদের কৈশোর আপনি রঙিন করে দিয়েছিলেন তারা কোনোদিনই আপনাকে ভুলব না!
 

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়