ঢাকা     শনিবার   ১৭ মে ২০২৫ ||  জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩২

তালপাতার পাখা: প্রয়োজন কমেছে, আবেদন কমেনি

কাঞ্চন কুমার, কুষ্টিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ২ মে ২০২৫   আপডেট: ০৯:২৬, ২ মে ২০২৫
তালপাতার পাখা: প্রয়োজন কমেছে, আবেদন কমেনি

কারিগররা তালের পাখা তৈরির কাজে ব্যস্ত। ছবি: লেখক

“তালের পাখা প্রাণের সখা, শীতকালেতে যায় না দেখা’’— গ্রাম বাংলায় এমন একটি প্রবাদ থাকলেও  আধুনিক ও যান্ত্রিক যুগে অনেকটাই বিলুপ্তির পথে হাতে তৈরি তালপাতার পাখা। তবে এখনও রয়েছে এর আবেদন। ঐতিহ্যবাহী এই পাখা যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় তৈরি করে চলেছে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার সদকী ইউনিয়নের মালিয়াট গ্রামের শতাধিক পরিবার। 

গ্রাম বাংলার এই প্রাচীন ঐতিহ্য হাতপাখা তৈরির প্রধান কাঁচামাল তালগাছের পাতা, বাঁশ, সুঁতা বা লোহার চিকন তার (জি আই তার)। তালপাতার শোভা বাড়াতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন রং। কয়েকজন নারী ও পুরুষ মিলে একটি করে দল গঠন করে তৈরি করে এইসব পাখা।

আরো পড়ুন:

তীব্র তাপপ্রবাহ ও প্রচণ্ড গরমে হাতপাখার কদর বেড়েছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পাখা তৈরির কারিগরদের ঘুমও হারাম হয়ে গেছে। কারিগররা এখন দিনরাত সমান তালের পাখা তৈরির কাজে ব্যস্ত।

সরেজমিন মালিয়াট গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কেউ তালপাতাগুলো পানি দিয়ে ভেজানোর কাজ করছেন, কেউ পাতা রোদে শুকাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার পাতা কেঁটে সাইজ করছেন, বাঁশ চিরে শলা তৈরি করছেন। কেউবা সুঁতা ও বাঁশের শলাতে রং লাগাচ্ছেন। এভাবেই কয়েক জনের হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে তালপাতার হাতপাখা। 

কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, মালিয়াট গ্রামের শতাধিক পরিবারের প্রায় ৪ থেকে ৫ শতাধিক নারী ও পুরুষ পাখা তৈরির কাজ করেন। পাখা তৈরির উপকরণ তালপাতা জেলার বিভিন্ন স্থান সংগ্রহ ও তৈরি পাখা বিক্রির কাজ মূলত পুরুষরাই করে থাকেন। তবে সংসারের কাজের পাশাপাশি রং মিশ্রিত বাঁশের কাঠি, সুই ও সুতা দিয়ে পাখা বাঁধার কাজটি করেন গৃহবধূরা। পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা পাখা তৈরির কাজে সহযোগিতা করে থাকেন। কারিগরদের সাথে আলাপকালে আরো জানা যায়, জেলা ও জেলার বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাখা তৈরির প্রধান কাঁচামাল তালের পাতা প্রতি পিস কেনা হয় ৫-৮ টাকা দরে। প্রতি পিস পাতায় ৮-১০টি পাখা তৈরি করা যায়। প্রতি পিস বাঁশ কেনা হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। প্রতিটি বাঁশে শতাধিক পাখা হয়। প্রতি পিস পাখা তৈরিতে খরচ হয় ৫ থেকে ৬ টাকা। তৈরিকৃত পাখা পাইকারি বিক্রয় হয় ১০ থেকে ১২ টাকায় আর খুচরা বিক্রয় হয় ২০ থেকে ২৫ টাকা। এখানকার তৈরিকৃত পাখাগুলো স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জেলার বাইরেও বিক্রি করা হয়।

এ বিষয়ে মালিয়াট গ্রামের করম আলী শেখের ছেলে রিজাউল শেখ বলেন, ‘‘খুব ছোট থেকেই একাজ করে আসছি। বিদ্যুৎ আর যান্ত্রিক যুগে হাত পাখার চাহিদা কমে গেলেও পৈতৃক পেশা হিসেবে ধরে রেখেছি।’’

তিনি আরও জানান, নারী ও পুরুষ সবাই মিলে দল বেঁধে আমরা কাজ করি। প্রতিটি দল দিনে ২৫০ থেকে ৩০০ পিস পাখা তৈরি করি। নারী কারিগর রহিমা বেগম বলেন, ঘরের কাজের পাশাপাশি পাখা তৈরির কাজ করে যা পাই, তাতে সংসার ভালভাবে চলে যায়। 

কুমারখালী পৌরবাজার এলাকার খূচরা বিক্রেতা করিম মোল্লা (৫৫) বলেন, ‘‘৩৫ বছর ধরে পাখার ব্যবসা করি।বৈদ্যুতিক আর প্লাস্টিক পাখা এসে আগের আর তালপাখার চাহিদা নেই। তবও সৌখিন হিসাবে অনেকেই কেনেন।’’

চৌরঙ্গী মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক আনিছুর রহমান বলেন, ‘‘ছাত্র জীবনে হাত পাখার ব্যাপক ব্যবহার করলেও বাড়িতে এখন বৈদ্যুতিক পাখা। তবে ঐতিহ্যবাহী হাতপাখার প্রচলন গ্রাম বাংলায় এখনও চোখে পড়ার মত।

এ বিষয়ে সদকী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল মজিদ বলেন, ‘‘ঐতিহ্যবাহী এই কুটিরশিল্পটি আমাদের ইতিহাসের স্বাক্ষী। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সরকারী ও বেসরকারীভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’’ 

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়