ঢাকা     বুধবার   ০৮ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৫ ১৪৩১

রাজশাহীতে নৌকার ‘পাশে নেই’ আ.লীগের সব নেতা

শিরিন সুলতানা কেয়া, রাজশাহী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৪১, ৯ জুন ২০২৩   আপডেট: ২১:১১, ৯ জুন ২০২৩
রাজশাহীতে নৌকার ‘পাশে নেই’ আ.লীগের সব নেতা

আজ শুকবার বিকেলে নগরীর ২০ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগ করেন আ.লীগের মেয়রপ্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন

রাজশাহী সিটিতে এখন ভোটের ডামাডোল। সিটি মেয়রের মসনদে আবার ফিরতে দিনরাত মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। চালাচ্ছেন প্রচারণা। কিন্তু ভোটগ্রহণের আর মাত্র ১২ দিন বাকি থাকলেও স্থানীয় রাজনীতির বিভেদের কারণে নগর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কয়েকজন নেতা এখনও নৌকার প্রচারে সক্রিয়ভাবে মাঠে নামেননি। তারা নৌকার পাশে আছেন কি নেই, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

দলীয় একটি সূত্র বলছে, মেয়রপ্রার্থী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে নগর আওয়ামী লীগের কয়েক নেতার দূরত্বের কারণেই তারা প্রচার-প্রচারনায় অংশ নেননি। আবার অনেকেরই ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ থাকলেও পদ-পদবী বাঁচাতে কাজ করে যাচ্ছেন। মেয়রপ্রার্থী লিটনকে নিয়ে কটূক্তি করে কথা বলার কারণে ইতোমধ্যে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক সভাপতিকে বৃহস্পতিবার বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে। 

অনেকেই নৌকার ‘পাশে না থাকলেও’ ভোটে কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন না লিটনের অনুসারীরা।

দূরে সরকার পরিবার: রাজশাহীর রাজনীতিতে এখন আলোচিত নাম ডাবলু সরকার। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। নগর আওয়ামী লীগে খায়রুজ্জামান লিটন সভাপতি আর ডাবলু সরকার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন টানা দুই মেয়াদে। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হলে লিটন নগরের পদ ছেড়ে দেন। দলীয় সূত্র বলছে, লিটন-ডাবলুর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না লম্বা সময় ধরেই। এখন সেই সম্পর্ক প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে বিরোধে।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগমুহূর্তে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের একটি আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। তখন তার বহিষ্কারের দাবিতে মাঠে সোচ্চার হন লিটন অনুসারীরা। এর ফলে দুজনের সম্পর্কের দূরত্ব আরও বাড়ে। এ দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়, যখন সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে দলের মনোনয়ন পেতে লিটনের পাশাপাশি ডাবলু সরকারও মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। লিটন মনোনয়ন পাওয়ার পরে এক অনুষ্ঠানে ডাবলুর দিকে ইঙ্গিত দিয়ে তাঁকে আয়নায় নিজের মুখ দেখে আসার পরামর্শ দেন।

তারপর একদিন ডাবলু সরকারকে নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে মহল্লায় ঘুরতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তারপর আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না তাকে। প্রচারণায় ডাবলুর অনুপস্থিতিই আলোচনায় আনছে তাকে। শুধু তিনি একা নন, তার পরিবারের কেউই নির্বাচনী মাঠে সেভাবে নেই। ডাবলুর ভাই জেডু সরকার রাজশাহী মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। ভোটের মাঠে তাকেও দেখা যাচ্ছে না। আরেক ভাই শাহনেওয়াজ সরকার সেডুও নেই কোথাও। তিনি নগরীর ২২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

ডাবলুর ভাগ্নে মীর ইশতিয়াক আহমেদ লিমন মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। লিমনকেও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লিমনের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবাল মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। এখন দিব্যি তিনি অফিস করলেও ‘অসুস্থতার’ কারণ দেখিয়ে তিনি ভোটের প্রচারে নামছেন না। নির্বাচন পার করতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে কমিটি করা হয়েছে তার কোথাও এই নেতারা নেই।

দলীয় নেতারা জানিয়েছেন, শুধু ডাবলু সরকার এবং তার আত্মীয়-স্বজনেরাই নয়, তাদের অনুসারী নেতাকর্মীরাও নৌকার পক্ষে এখনও মাঠে নামেননি। এর মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে নৌকার কান্ডারী লিটনকে নিয়ে ‘কটুক্তি’ ও ‘অশালীন’ মন্তব্য করার অভিযোগে ২২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি শংকর ঘোষকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহনেওয়াজ সরকার সেডু হলেন- ডাবলু সরকারের ভাই। বহিষ্কৃত শংকর ঘোষ রাজনীতিতে ডাবলু সরকারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

নগরীর বোয়ালিয়া থানা (পূর্ব) আওয়ামী লীগের সভাপতি আতিকুর রহমান কালু ও সাধারণ সম্পাদক শ্যামল কুমার ঘোষ স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘লিটনকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়ার পর থেকেই শংকর ঘোষ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং মেয়রপ্রার্থীর সম্পর্কে অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে আসছেন। ফলে মহানগর ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ এবং মেয়রপ্রার্থীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। তার এ ধরনের কাজ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র পরিপন্থি। এ কারণে তাকে সব সাংগঠনিক পদ ও কার্যক্রম থেকে বহিষ্কার করা হলো।’

যা বলছে সরকার পরিবার: নির্বাচনের প্রচারণায় কেন দেখা যাচ্ছে না, তা জানতে চাইলে নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইশতিয়াক আহমেদ লিমন শুক্রবার (৯ জুন) দুপুরে রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি আমার মতো করে প্রচারণা করছি। আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, শহিদ পরিবারের সন্তান। নৌকা যেখানে, আমরাও সেখানে। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে নৌকার পক্ষে কথা বলছি, বলেও যাবো।’

লিমনের বাবা নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবাল কয়দিন অসুস্থ ছিলেন। এখন নিয়মিত অফিস করছেন। নৌকার পক্ষে ভোটের মাঠে কেন নেই, এমন প্রশ্নে মীর ইকবাল রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি অসুস্থ। কয়দিন আগে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম, এরপর ঢাকায় ছিলাম। এখন একমাসের বেড রেস্টে আছি। তাই দেখা যাচ্ছে না। তাও মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছি কাজ করতে। তবে শরীর একটু সুস্থ হলে নির্বাচনী প্রচারণায় দেখা যেতেও পারে।’

একই প্রশ্নে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘প্রচারণায় ব্যাপকভাবে নেই, কিন্তু আছি। যিনি নৌকার জন্য মনোনীত হয়েছেন, তাঁর সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে তিনিই চাননি আমি প্রচারণায় থাকি। তারপরও আমি নৌকার পক্ষেই আছি।’

ভাবছে না আ.লীগ: এবার দলের মনোনয়ন পেতে লিটন ও ডাবলুর পাশাপাশি দলের মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন নগর আওয়ামী লীগের আরেক সহসভাপতি মাহফুজুল আলম লোটন। তিনি খায়রুজ্জামান লিটনের চাচা। ভাতিজার ভোটের মাঠে লোটনকেও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। এই সমস্ত নেতা নৌকার ‘পাশে না থাকলেও’ ভাবছে না রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগ।

নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহসানুল হক পিন্টু রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি সূর্য। সূর্যের সংস্পর্শে যে আসবে সে আলোকিত হবে। বাইরে গেলেই সে অন্ধকারে পড়বে। যারা দূরে থাকছে, তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। নৌকার ক্ষতি হবে না।’

নৌকার প্রচারে না আসা নেতাদের ব্যাপারে দল কোন সিদ্ধান্ত নেবে কি না জানতে চাইলে আহসানুল হক পিন্টু বলেন, ‘এটা কেন্দ্রের ওপর নির্ভর করবে। এ ব্যাপারে আমাদের এখতিয়ার নেই। যিনি আসছেন না, সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়।  খায়রুজ্জামান লিটন প্রশ্নে আমরা সবাই এক।’

ভোটের আগে বিভেদ মিটছে না রাজশাহীতে: আওয়ামী লীগ নেতাদের বিভেদ নির্বাচনের কারণেই মিটছে না বলে জানিয়েছেন দলের রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘নেতাদের মধ্যে মান-অভিমান থাকতেই পারে, এটাই শুনছি। নির্বাচন বলেই সমস্যার সমাধান করতে দেরি হচ্ছে। তবে এই দূরত্ব মেটাতে কাজ করা হবে।’

এখন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার নৌকার পক্ষে আছেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ডাবলু সরকার নৌকার পক্ষেই ভোট দেবে, কাজ করবে। ডাবলু এখনও মহানগর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। সে তার জায়গা থেকে কাজ করবে। তবে বাস্তবতা তো আপনারাও বোঝেন।’

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়